সাংবাদিক রাজিব নুরের ফেসবুক ওয়াল থেকে ঃ
আমি ভালো আছি। শরীর একদম ঠিকঠাক। একটু অবসন্ন। অনেকখানি ট্রমাটাইজড হয়ে আছি।
হামলাটা আমার ওপর যতখানি হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে আলমগীর রেজার ওপর। সেলফিটা ওরই তোলা।
আলমগীরের সঙ্গে আমার ওই দিন, ১১ সেপ্টেম্বরেই প্রথম পরিচয় হয়েছে। ও ‘দেশসেবা’ পত্রিকার বানিয়াচং উপজেলা প্রতিনিধি। তবে প্রথম পরিচয়ে আমাকে বলেছিল, সে আর্টিস্ট। টুকটাক আঁকাআঁকি এবং কম্পিউটার গ্রাফিকস করে জীবিকা নির্বাহ করে। বেশির ভাগ উপজেলা প্রতিনিধিরই বিশাল সহায়সম্পত্তি না থাকলে তা-ই করতে হয়।
আলমগীরকে ইট দিয়ে মারতে গিয়েছিল ওয়াহেদের ছেলে ওয়ালিদ। ও গ্রেপ্তার হয়েছে। মোশাহেদ পেছন থেকে ওয়ালিদকে আটকাতে না পারলে হয়তো আলমগীরের জন্য বাকি জীবন আমার অনুশোচনা করতে হতো।
মোশাহেদ মিয়া ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকার বানিয়াচং প্রতিনিধি। এর আগে ছিলেন ‘প্রথম আলো’তে। আমিও তখন ‘প্রথম আলো’য় কাজ করতাম। পুরোনো সহকর্মীকে পেয়ে মোশাহেদ ছিলেন উৎফুল্ল। হবিগঞ্জ থেকে আমি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম ওখানকার স্থানীয় দৈনিক সমাচারের নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদ মিয়াকে।
ছবিতে আমার আর আলমগীরের মাঝে আছে তৌহিদ মিয়া।
আমরা হবিগঞ্জ থেকে রওয়ানা দেওয়ার আগেই তৌহিদ মোশাহেদকে জানিয়ে রেখেছিল। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মোশাহেদ।ওয়াহেদের পরিবারের লোকজন মোশাহেদ ছাড়া আমাদের সবাইকে মারধর করেছে। মোশাহেদকে বানিয়াচংয়ের গাছপালাও চেনে বলে আমার ধারণা। তাই যে বাড়ির মেয়েরাও বাইরের চার জন লোককে মারতে আসতে পারে, সেই বাড়িতেও তিনি রেহাই পেয়ে গেছেন।
আলমগীরের তোলা সেলফিতে একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা মানুষটা হলেন মোশাহেদ মিয়া।
আহত তিন জনের মধ্যে তুলনায় আমি কম আঘাত পেয়েছি। আমার মোবাইল কেড়ে নিতে গিয়ে হাত মচকে দিয়েছে ওয়াহেদের ছেলেরা। আমাকে ওরা বাধ্য করেছে প্যাটার্ন লক জানাতে।তখন মারধরও করেছে।
আমার ওপর হামলার প্রতিবাদ করায় অন্যদের ওপর হামলে পড়ে ওরা। আলমগীর রেজা পাশের গ্রামের ছেলে। তাই ওর প্রতিবাদ ছিল জোরালো। ওকেই মেরেছে বেশি ওরা। ইট দিয়ে ওয়ালিদ যে আঘাতটা করতে চেয়েছিল, তাকে বোধ হয় আইনের ভাষায় ‘হত্যাচেষ্টা’ বলা চলে।
আমার আইনজ্ঞ বন্ধুরা বলছেন, ‘মামলা শক্ত হয়নি।’
শোরগোল তুলে আমাদের মনে যে আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে, তা-ও কি কম অপরাধ? আমার তখন মনে হয়েছিল, প্রাণসংশয় হতে পারে আজ। আমি ওই আতঙ্কঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। ট্রমাটাইজড বাংলা কি আতঙ্কঘোর হবে? এখনও কাজে মনে দিতে পারছি না। ওয়াহেদের মতো ভয়ঙ্কর লোক আমি খুব একটা দেখিনি। মোটর সাইকেল ছেড়ে দেওয়ার পরও লোকটা আমাদের পেছন পেছন দৌড়ে আসছিলেন।
মামলা শক্ত হলো কিনা জানি না। করার দরকারও নেই। ওয়াহেদের কাছ থেকে তো রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি আমি দখল করে নিতে চাইনি। রামনাথ বিশ্বাস নামে একজন ভূপর্যটক, যিনি পৃথিবী ঘুরে এসে বলেছিলেন বানিয়াচং তাঁর পৃথিবী, সেই মানুষের বাড়িটা দখল হয়ে গেছে, এই খবর আমি আমাদের পাঠককে জানাতে জানাতে চেয়েছি।
হাওরাঞ্চলের তিন বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমাঙ্গ বিশ্বাস আর রামনাথ বিশ্বাস আমাকে সংগীতে এবং ভ্রমণে বিশ্বস্ত হতে শিখিয়েছেন।আমি যদি নির্বাসনে বাধ্য হই, বাধ্যবাধকতা থাকে নির্বাসনদণ্ডে শুধু একজন শিল্পীকেই শুনতে হবে আমার, তবে দেবব্রতকে সঙ্গে নিয়ে যাব। ১০ জন হলে নিশ্চয়ই হেমাঙ্গ বিশ্বাসও থাকবেন সঙ্গে। পাঠক হিসেবে আমার কাছে রামনাথ বিশ্বাস অত অনিবার্য নন।তাঁর গোটা তিরিশেক ভ্রমণকাহিনি আছে, পড়েছিও বেশ কিছু।সেই কবে মনে নেই, যখন জেনেছিলাম, অনেক দিন আগে রামনাথ বিশ্বাস বাই-সাইকেলে করে পৃথিবী ঘুরে এসেছেন, তখন ভেবেছিলাম আমি হেঁটে হেঁটে ঘুরব দেশটা। হেঁটে না হলেও আমি তো ঘুরেছি দেশটা। এক বানিয়াচংয়েই অন্তত পাঁচবার গিয়েছি। আবারও যাব নিশ্চয়ই।আমি তো এখন রামনাথ বিশ্বাসের পক্ষভুক্ত হয়ে গিয়েছি।
আমাদের ওপর হামলার বিচার চেয়ে অনেক মানুষ মাঠে নেমেছেন দেখতে পাচ্ছি।আপনাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। আমিও বিচার চাই আমাদের ওপর হামলার। আইনানুযায়ী যতটা শাস্তি ওয়াহেদ ও তাঁর ছেলেদের পাওনা হয়, তার চেয়ে একটু যেন কম না হয় বিচারটা। সেই সঙ্গে চাই, সবাই যেন রামনাথ বিশ্বাসের দখল হয়ে যাওয়া বাড়িটি উদ্ধার করে সংরক্ষণের দাবি জানান।
বানিয়াচংয়ে কমলারাণীর সাগরদীঘি বলে একটা দীঘি আছে। পুরানকথার সেই দীঘির পাড়ে আমাদের চারজনের এই ছবিটা তোলা হয়েছিল।