বুলবুল আহমেদ সোহেল; নারায়ণগঞ্জঃ
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে মা ও ছেলেকে জবাই করে হত্যার ঘটনার রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে। নিহতের পরিবার থেকে অভিযোগ উঠেছে সম্পত্তি গ্রাসের জন্যই মা ও ছেলেকে হত্যা করেছে নিকটাত্মীয়রা। তবে ঘটনার পর ১৮ ঘন্টা অতিবাহিত হলেও রোববার রাত ১২টা পর্যন্ত এ ঘটনায় কোন মামলা হয়নি। সন্দেহ ভাজন হিসেবেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
আড়াইহাজার উপজেলার উজান গোবিন্দপুর এলাকার মৃত আওয়াল নবীর স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা কাকলী ও তার ৮ বছর বয়সী ছেলে তালহাকে নিজ ঘরে শনিবার রাতে ধারালো বটি দিয়ে ও ইস্ত্রি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। প্রায় ৫ বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র মা ছেলেই বসবাস করতো এই ঘরে।
ঘটনার প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী নিহত তালহার চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী জান্নাত বেগম। ভোর সাড়ে ৪ টায় ঘরের কলাপসিবল গেইট খোলা দেখে তিনি ঘরে প্রবেশ করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে আলমীরা খোলা ও এলোমেলো দেখে। ঘরের সবকিছু এলোমেলো দেখতে পেলেও খাটের ওপর পরে থাকা তালহার রক্তাক্ত দেহ,মেঝেতে রক্ত ও পাশের ঘরে পরে থাকা চাচির মরদেহ দেখতে পায়নি সে। ঘর এলোমেলো দেখেই সে নাকি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তার আরেক চাচা শশুরকে ডেকে নিয়ে আসে। আর তার চাচা শশুরও তখন নাকি তাদের ঘরের পেছনে সিগারেট খাচ্ছিল। চাচাকে ডেকে নিয়ে আসার পরও তারা ঘরে কোন লাশ দেখতে পারেনি। তখন জান্নাত বেগম তার ঘর থেকে মোবাইল ফোন এনে লাইট জ্বালালে দেখতে পারে খাটে তালহার লাশ ও পাশের রুমে চাচি শাশুরীর লাশ। পরে তার চাচা ও সে আর্তচিৎকার করলে আশেপাশের লোকজন আসে। ঘরে লাইট থাকলেও তা না জ্বালিয়ে মোবাইলফোন এনে আলো জানালেন কেন? এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি।
ঘটনার পরদিন বাড়িতে গেলে দেখা যায় তাদের পরিবারের তেমন কোন শোক তাপ নেই। হাস্যজ্জ্বোল স্বাভাবিক ভাবেই এ গণ মাধ্যমকর্মী ও পুলিশের একটি তদন্ত দলের কাছে সাক্ষাৎকার দেন জান্নাত বেগম। তার সথে প্রথম লাশের প্রত্যক্ষদর্শী চাচা... কে ঘটনার দিন এবং পরেরদিন গিয়েও বাড়িতে পাওয়া যায়নি। তার কথা জিজ্ঞেস করলে জানান হাটে গেছে গরুর দুধ বিক্রি করতে।
তখন দুপুর দুইটা। নিহত মা ছেলের মরদেহ ময়না তদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে রয়েছে নিহত কাকলী বেগমের ভাই ও স্বজনরা। কিন্তু শশুর বাড়ির কেউই যায়নি সেখানে। তাদের দাফনের ব্যাপাড়েও এ বাড়িতে কোন আয়োজন নেই, জানা নেই সময়। কখন দাফন হবে জানতে চাইলে কাকলী বেগমের শশুর বাড়ির লোকজন জানায় তারা এসব কিছুই জানেনা। ঘটনার দিন পুলিশ লাশ নিয়ে গেছে। লাশের সঙ্গে নিহত কাকলীর ভাই ও স্বজনরা রয়েছে। তারাই দাফনের ব্যাবস্থা করবে। লাশ নিয়া আসলেই তারা ও বাড়িতে যাবে।
পাশের গ্রাম পাঁচগাও এলাকায় নিহতের বাবার বাড়িত গিয়ে দেখা যায় তারা সবাই শোকেহোত। ফোনে লাশের খবর নিচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর। আয়োজন করছেন দাফনের।
এসময় নিহতের স্বজনদের কাছে হত্যার রহস্য জানতে চাইলে তারা জানান,নিহতদের পাশের ঘরেই বসবাস করেন ভাতিজা বৌ জান্নাত। বিভিন্ন সময় কেচি গেইটের শব্দ পেলে এবং ফোনে কথা বললেও শুনতে পায় সে। আর সেদিন দুইটি মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করলো, তারা বাঁচার জন্য দাবরানো ও চিৎকারের কোন শব্দ পেলনা আশেপাশের ঘরের লোকজন। আলমারী ভাঙ্গার শব্দ পেলনা। প্রথম ঘরে প্রবেশ করে ডিম লাইট জালিয়ে আলমারী ও আশে পাশে এলোমেলো চোখে পড়লেও লাশ তার চোখে পরেনি। পরে গিয়ে চাচাকে ডেকে নিয়ে এসে মোবাইলের লাইট দিয়ে দেখলো এটাই বেশ রহস্যজনক। দেয়াল ঘেসে ঘেসে ৪/৫টি ঘর অন্তত একটু সময় নিয়ে ঘট এত বড় একটা হত্যার ঘটনা ঘটলো। কেউ কোন শব্দই পায়নি এটা হতেই পারেনা।
বোন শাহিনা সুলতানা তিথী জানান, সম্পত্তির বন্টন দিতে হবে বলেই মা ও ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। শশুর বাড়ির লোকজন সম্মেলিত ভাবেই এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। এছাড়াও কাকলী বেগমের চাচাতো দেবর ৪ বছর আগে দেরলাখ টাকা নিয়েছে ব্যাবসার কথা বলে। সেই টাকার জন্যও ইদানিং চাপ দেয়া হচ্ছিল। সেই ঘটনাটি নিয়েও সন্দেহ করছেন তারা। তিথী বলেন হত্যাকারীদের একজন অবশ্যই নারী। কারণ তারবোন পর্দাশীল। ঘুমানোর পোশাক পড়া অবস্থায় নিকটাত্মীয় কোন নারী ছাড়া কখনোই দরজা খুলতো না। যেহেতু হত্যার জন্য গেইটের তালা ভাঙতে হয়নি খুনিদের। এবং হত্যার কাজে ব্যাবহৃত বটি এবং ইস্ত্রী তাদের ঘরেরই। তাহলে নিকটাত্মীয় ঘরে আসা যাওয়া করে এমন না হলে খুনিরা বটি ও স্ত্রী কোথায় আছে তা জানতো না। আলমিরা ভেঙ্গে এলোমেলো করে ডাকাতির ঘটনা সাজানোর চেষ্টা করেছে খুনিরা। কারণ ঘর থেকে কিছুই খোয়া যায়নি।
এদিকে এলাকাবাসী নিহত কাকলী বেগম ও তাদের পরিবারের লোকজনকে খুবই শান্তশিষ্ট হিসেবে চিনেন। কাকলী বেগমের সঙ্গে কারো সত্রুতা আছে বা ঝগড়া হয়েছে এমন কোন খবর তাদের জানা নেই এবং খুবই নম্র সভাবের শিশু তালহাকেও হত্যা করতে হবে এমন শত্রুতা তো দূরের কথা কারো সঙ্গে সামান্য বিবাদ আছে কাকলী বেগমের এমন খবরও তাদের জানা নেই। আত্মীয় স্বজন ছাড়া কারো সাথে চলেফেরা নেই নিহতের। তাই হত্যার রহস্য কি তারা তা চিন্তাই করতে পারছেন না।
স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীরাও মনে করছেন সম্পদ আত্মসাত জনিত কোন কারনেই এই হত্যাকান্ড বলে প্রাথমিক ধারণা করছেন তারা। আড়াইহাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি হারাধন চন্দ্র দে বলেন- খুনের পর ঘটনাস্থলের আলামত, খুনীদের মধ্য নিকটাত্মীয় কেউ যে জড়িত তেমনি ইঙ্গিত দেয়।
রোববার রাত ১২টায় শেষ খবর নেয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে থানায় মামলা রুজু হয়নি। পুলিশ হত্যার কোন ক্লু ও সন্দেহভাজন এমন কাউকেও শনাক্ত করতে পারেননি তারা। জেলার অপরাধ বিষয়ক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন,বেশ কয়েকটি দিককে প্রধান্য দিয়ে তারা তদন্ত কাজ শুরু করেছেন। থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবি,পিবিআই সহ কয়েকটি টিম কাজ করছে। অভিযোগ যার নাম পাওয়া যাবে এবং খুনের রহস্য উদঘাটন করে খুনিদের স্বল্প সময়ের মধ্যেই আইনের আওতায় আনা হবে বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করেন তিনি।
নিহতের পরিবার থেকে জানানো হয়, লাশ দাফন শেষ না হওয়ায় তারা থানায় অভিযোগ নিয়ে জাননি। রোববার সন্ধ্যায় বাদ মাগরিব দুইজনের দাফন কার্য্য সম্পন্ন করা হয়। আজ সোমবার মামলার জন্য থানায় যবেন বলে জানান।