রোকসানা মনোয়ার :কয়েক মাস না যেতেই ফের ভাড়া নৈরাজ্য শুরু হয়েছে ঢাকার লোকাল বাসে। গায়েব হয়ে গেছে ই-টিকিট যন্ত্রও নেই অধিকাংশ বাসে। ‘ওয়েবিল পদ্ধতি’ ফেরাতেই এই পথ বেছে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে যাত্রী যেখানেই নামুন, দূরবর্তী গন্তব্যের হিসাবে বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে। শ্রমিকরা বলছেন, তারা দৈনিক ৪০০ এবং চালকরা ৬০০ টাকা মজুরি পান। মাসে ২০ থেকে ২২ দিনের বেশি কাজ পান না। এতে মাসে আয় ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা। এ টাকায় ঢাকা শহরে সংসার চলে না। হাতে ভাড়া নিলে দিনে ৪০০-৫০০ টাকা ‘উপরি আয়’ করতে পারেন। ই-টিকিট থাকলে তা হয় না।
মোহাম্মদপুর থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটের রমজান পরিবহনের বাসে পুরোনো ওয়েবিল পদ্ধতিই দেখা গেছে। চেকার ছক কাটা ক্লিপ বোর্ডে বাসে যাত্রীর সংখ্যা গুনে লিখে হেলপারকে ফেরত দেন। হেলপার চেকারকে ৩০ টাকা দেন। বাসের গায়ে লেখা স্টপেজ হিসেবে মোহাম্মপুর, শংকর, ধানমন্ডি-১৫, জিগাতলা, সায়েন্স ল্যাব, শাহবাগ, মৎস্যভবন, কাকরাইল, মৌচাক, বাড্ডা, বনশ্রী, মেরাদিয়া, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার লেখা রয়েছে। বিআরটিএ’র তালিকা অনুযায়ী, জিগাতলা থেকে মৎস্য ভবনের ভাড়া ১০ টাকা। কিন্তু বাসটিতে যাত্রীদের কাছ থেকে ১৫ টাকা নেওয়া হয়।
সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তালিকা অনুযায়ী, মিরপুর-২ থেকে শেওড়াপাড়ার দূরত্ব চার দশমিক ১ কিলোমিটার। ভাড়া ১০ টাকা। দুজনের ভাড়া ২০ টাকা। কেন ৩০ টাকা নেওয়া হলো এ প্রশ্নে চালকের সহকারীর দাবি, কাজীপাড়া পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা। কাজীপাড়া পার হলেই ১৫ টাকা।
ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বাসের ভাড়া বেড়ে হয়েছে কিলোমিটারে ২ টাকা ৪৫ পয়সা। সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। কিন্তু অধিকাংশ বাসে তা মানা হয় না। মামলা ও জরিমানায়ও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বাড়তি ভাড়ার জন্য ওয়েবিল পদ্ধতিকে দায়ী করা হয়। এ পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে ‘চেকার’ রাখেন মালিকরা। যাত্রী যেখানেই নামুন, অনুমোদিত স্টপেজ নয়, চেকিংয়ের স্থান হিসেবে ভাড়া আদায় করা হয়। এতে অল্প পথে বেশি ভাড়া দিতে হতো যাত্রীকে। সমালোচনার মুখে ওয়েবিল বন্ধ করে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। চেকিং উঠে যাওয়ায়, চালক-শ্রমিকদের কাছ থেকে যাত্রীর সঠিক হিসাব না পাওয়ায় মালিকের আয় কমে যায়। চুরি ঠেকাতে পরে ই-টিকিট চালু করে সমিতি।
গত ১৩ নভেম্বর মিরপুর অঞ্চলের ৩০টি কোম্পানির ১ হাজার ৬৪৩টি বাসে চালু হয় ই-টিকিট। ৯ জানুয়ারি মোহাম্মদপুর, গাবতলী ও আজিমপুর রুটের ১৫টি কোম্পানির ৭১১টি বাসে ই-টিকিট চালু হয়। এতে বিভিন্ন রুটে ২ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া কমেছিল। সমিতির ঘোষণা ছিল, ই-টিকিট কার্যকরে নজরদারি থাকবে। নিয়ম না মানা বাসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২০টি বাসের ১৯টিতেই ই-টিকিটের মেশিন না পাওয়া এবং বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়ে সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, কয়েকটি বাস এখনো চুক্তিতে চলছে, এমন তথ্য পাচ্ছি। যে অনিয়ম বহু বছর ধরে চলছে, তা রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে সময় লাগবে। ই-টিকিট কার্যকরে খুবই বেগ পেতে হচ্ছে। তারপরও চেষ্টা অব্যাহত আছে। ৯টি ভিজিল্যান্স টিম কাজ করছে। আগামী ১ মার্চ থেকে ঢাকার বাকি রুটের বাসেও ই-টিকিট চালু হবে।
সমিতি সব বাসে ই-টিকিট দেওয়ার কথা বললেও মাঠের চিত্র ভিন্ন। ধানমন্ডির জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান করে দেখা যায়, কোনো বাসেই মেশিন নেই। মোহাম্মদপুর-দয়াগঞ্জ রুটের মালঞ্চ পরিবহনের পরপর দুটি বাস (ঢাকা মেট্রো ব-১৫-৫৭৫২ এবং ঢাকা মেট্রো ব-১৫-২২৪০) আসে। একটিতে টিকিট দেওয়ার মেশিন নেই। মেশিন কোথায় এ প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে চেকার বলেন, বাসের ভেতরেই আছে। কিন্তু কারও কাছে তা পাওয়া যায়নি। পরের বাসের হেলাপার রসিকতা করে বললেন, মেশিন দিয়া রাইতে বাসায় টিকিট কাটি।
নাম প্রকাশ করতে রাজি না হওয়া চেকার বললেন, মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করতে সমিতিকে দেওয়া হয়েছে। পরে আবার বললেন, মেশিনের কাজ শেষ। কয়েক মিনিট পর তিনি দাবি করেন, মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। মেশিনের ভাড়ার তালিকা ঠিক নেই। তালিকা হালনাগাদে সমিতিতে মেশিন পাঠানো হয়েছে।
তবে সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, কোনো বাস থেকে মেশিন নেওয়া হয়নি। সব মেশিন বাস কোম্পানির কাছে রয়েছে। টিকিটের গায়ে দূরত্ব উল্লেখ না থাকায় ভাড়া নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে। তা হালনাগাদ করা হবে। কিন্তু এর জন্য কোনো মেশিন সমিতি এখনও নেয়নি।
মিডলাইন পরিবহনের বাসেও (ঢাকা মেট্রো ব-১১১২) ই-টিকিটের মেশিন দেখা যায়নি। ওয়েবিলের পুরোনো কৌশলে বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে বাসটিতে। জিগাতলা থেকে শাহবাগের ভাড়া ১০ টাকা। শাহবাগ পার হলেই মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকা। অথচ বিআরটিএর তালিকা অনুযায়ী মতিঝিলের ভাড়া ১৬ টাকা। মৎস্যভবন, প্রেস ক্লাবের ভাড়াও ১০ টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে দ্বিগুণ। হেলপারের যুক্তি, শাহবাগের পর তাদের স্টপেজ নেই। তাই যাত্রী যেখানেই নামুক গুলিস্তান, মতিঝিলের ভাড়া দিতে হবে।