মইনুল ইসলাম মিতুল : মোটরসাইকেল এখন প্রাণঘাতী বাহনে পরিণত হয়েছে। উচ্চগতির মোটরসাইকেল বেপরোয়াভাবে চালাতে গিয়েই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ। দুর্ঘটনার কবলে পড়াদের বড় একটা অংশ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এমন অল্পবয়সী শিশু-কিশোরদের সড়কে যানবাহন চালানোর কোনো বৈধতা নেই। লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ন্যূনতম বয়স ১৮। অথচ সড়কে মোটরসাইকেল দাপিয়ে বেড়ানোদের অনেকেরই বয়স আঠারোর কম।
সরকারি আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে লাইসেন্স দেওয়া হয় না। এটিই সবচেয়ে বড় মেসেজ। যেখানে সরকার পারমিশনই দিচ্ছে না, সেখানে অভিভাবকরা সন্তানদের আবদার রাখতে গিয়ে মোটরসাইকেল কিনে দিচ্ছেন। ফলে কয়েক বছরে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী অনেক শিশু-কিশোর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে।
বর্তমানে কিশোর ও যুবকদের কাছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বেশ লোভনীয়। উঠতি বয়সী এসব শিশু, কিশোর ও যুবকরাই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে বেশি। দুর্ঘটনার পরিণাম জানা সত্ত্বেও অনেক সচেতন অভিভাবক তাদের ১২-১৭ বছর বয়সী কিশোর সন্তানটিকে কিনে দিচ্ছেন মোটরসাইকেল। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত কিশোররা তিন-চারজন করে বন্ধু নিয়ে বাইক চালাচ্ছে সর্বোচ্চ গতিতে। তারা দল বেঁধে বাইক প্রতিযোগিতায় মেতে উঠছে। আবার কেউ কেউ মোটরসাইকেল অতিরিক্ত গতিতে চালিয়ে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করছে টিকটকের জন্য।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ বলছে, রাজধানীতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বেপরোয়া গতিতে চালানো, রাতে রেসিং করা, সিগন্যাল না মানার প্রবণতা, ফিটনেস না থাকা। অনেকের আবার বয়স কম, তারপরও লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা প্রয়োজন। রাজধানীতে কাগজে-কলমে আছে ৯ শতাংশ। প্রকৃতপক্ষে আছে ৬ শতাংশ। এ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সে কারণে দুর্ঘটনা কোনোভাবেই কমানো সম্ভব হচ্ছে না।
বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের (আরএসএফ) তথ্যানুসারে, গত ২৮ মাসে সারা দেশে (চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত) এক হাজার ৬৭৪ শিশু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এর মধ্যে ৬১ দশমিক ৩৫ শতাংশ শিশু রাস্তা পারাপারের সময় নিহত মারা যায়। এছাড়া ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ শিশু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায়।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত তিন বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৬৪৮টি, প্রাণহানি হয়েছে ৪ হাজার ৬২২ জনের। এ ছাড়া চলতি বছরের ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ১ হাজার ৮৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৯১১ জনের। নিহতদের মধ্যে শিশু-কিশোর রয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের গবেষণায় উঠে এসেছে, মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ চালক নিয়ম মানেন না। ট্রাফিক সিগন্যাল সম্পর্কে ধারণা না থাকায় শিশু-কিশোররা মোটরসাইকেল পেলেই নিয়ম মানছেন না সড়কের। এতে যেমন মোটরসাইকেলে শিশু-কিশোরদের প্রাণ ঝরছে সড়কে, অন্যদিকে পথচারী কিংবা অন্য যানবাহন চালকরাও পড়ছেন বিপদে। পাড়া-মহল্লা কিংবা মূল সড়কেও দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের প্রভাবে মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়া গতিতে রাজনৈতিক মহড়া ও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে কিশোর-যুবকরা। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অনেক সময় ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন এসব কিশোর-যুবকের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মৃত্যুফাঁদ মোটরসাইকেল।