মো: হ্নদয় হোসাইন, মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধি
বাংলাদেশের ইতিহাসে শহীদ জিয়াউর রহমানের নাম উচ্চারিত হয় গভীর শ্রদ্ধা, আবেগ ও গর্বের সঙ্গে। তিনি শুধু একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন না—তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার ঘোষক, দক্ষ সংগঠক, দূরদর্শী কূটনীতিক এবং শক্তিশালী প্রশাসক। তাঁর দেশপ্রেম, স্বনির্ভরতার দর্শন, ও উন্নয়ন-কেন্দ্রিক নেতৃত্ব বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভিত্তিকে নতুনভাবে নির্মাণ করেছিল।
আজ ৩০ মে, তাঁর শাহাদাতবার্ষিকীতে জাতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে সেই নেতাকে, যিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বাংলাদেশকে আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বর হামলা চালায়, তখন মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে। ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জাতির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন—“আমি মেজর জিয়া বলছি… আমি স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে ঘোষণা দিচ্ছি।”
মেজর জিয়ার সেই ঘোষণাই লাখো মুক্তিযোদ্ধার মনোবল জোগায়।পরবর্তীতে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।

যুদ্ধাহত দেশকে পুনর্গঠনের নেতৃত্ব
স্বাধীনতার পর একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত, অনুন্নত দেশের সামনে অর্থনীতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক পুনর্গঠন ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আসেন জিয়াউর রহমান। প্রথমে তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে এবং পরে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের হাল ধরেন।
তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ফিরে পায় এক নতুন রাজনৈতিক দিশা, অর্থনৈতিক গতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক পরিচিতি।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন
একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে বের করে এনে জিয়াউর রহমান দেশের রাজনীতিতে পুনরায় বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন। তিনি সাংবাদিকতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সংগঠনের অধিকার ফিরিয়ে দেন। ১৯৭৮ সালে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি গণভিত্তিক জনসমর্থন অর্জন করেন।
তাঁর সময়েই দেশব্যাপী নির্বাচনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আজকের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি গড়তে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) জন্ম
১৯৭৮ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। দলটির মূল দর্শন ছিল “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ”, যার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জনগণের আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা।
দলটি স্বল্প সময়েই দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়, যার নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হয় বহু বছর।
অর্থনৈতিক সংস্কার ও আত্মনির্ভরতা
দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনে জিয়াউর রহমান নেন একাধিক সাহসী পদক্ষেপ। তাঁর সময়কালে,গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিপ্লব আসে “সবুজ বিপ্লব” নীতির মাধ্যমে।কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, সার ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা হয়।বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দিয়ে তিনি শিল্পায়নে গতি আনেন।ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও পল্লী শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো হয়।
তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় কর্মসূচি ছিল "নিজেকে সাহায্য করো" (Self-Help) — যা আত্মনির্ভরতার চেতনা জাগিয়ে তোলে সাধারণ মানুষের মাঝে।
উপজেলা ব্যবস্থা চালু: বিকেন্দ্রীকরণের রূপকার
দেশজুড়ে প্রশাসনিক কার্যকারিতা বাড়াতে তিনি চালু করেন উপজেলা পদ্ধতি—যার ফলে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হয় এবং জনগণের সঙ্গে প্রশাসনের সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হয়। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, যা প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণে নতুন অধ্যায় সূচনা করে।
উপজেলার চেয়ারম্যান, নির্বাচিত পরিষদ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও উন্নয়ন ছড়িয়ে দেয়।
স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা
সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়”—এই নীতিতে বিশ্বাসী রাষ্ট্রপতি জিয়া রহমান স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭৯ সালে ওআইসি, নিরপেক্ষ আন্দোলন জোট (NAM), ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকে (IDB) যুক্ত হয়। এসব সংস্থায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণ করেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন হয় সম্মানের ভিত্তিতে। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলায় সে অঞ্চলে প্রবাসী কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের সূচনা হয়। তার সময়েই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করে।তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত জরুরি।
জনসম্পৃক্ততা ও জনপ্রিয়তা
জিয়াউর রহমান সরাসরি জনগণের কাছে পৌঁছাতে বিশ্বাস করতেন। তাঁর শাসনামলে তিনি ৬৪ জেলাতেই সফর করেন, মাঠে-ঘাটে গিয়ে মানুষের কথা শোনেন। তিনি বিশ্বাস করতেন “শাসন নয়, সেবা”—এই আদর্শেই প্রশাসনকে গড়তে হবে।
তিনি “জাগো, গড়ো, বদলো”—এই স্লোগানে জাতিকে উদ্দীপ্ত করেন।
শহীদ রাষ্ট্রনায়ক: এক করুণ পরিসমাপ্তি
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে অবস্থানকালে একদল বিদ্রোহী সেনাসদস্য সার্কিট হাউসে হামলা চালিয়ে শহীদ করেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। তাঁর মৃত্যু জাতিকে স্তব্ধ করে দেয়। এই হত্যাকাণ্ড ছিল দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি এবং রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
তাঁর শাহাদাতের পর দেশের বিভিন্ন অংশে শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে রাজপথে নেমে আসে।
ঐতিহাসিক মূল্যায়ন ও প্রাসঙ্গিকতা
আজও জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বগুণ ও দেশপ্রেম রাজনৈতিক ইতিহাসে আলোচিত ও গবেষণার বিষয়। অনেক ইতিহাসবিদ তাঁর সময়কে "উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার যুগ" হিসেবে আখ্যা দেন।
তিনি ছিলেন একজন আদর্শনিষ্ঠ, পরিশ্রমী ও নির্লোভ রাষ্ট্রনায়ক—যার মূল দর্শন ছিল জনগণকে সাথে নিয়ে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া।