
মাজহারুল ইসলাম মাসুম , সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক :
চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা ইমাম
সুলতানুল হিন্দ খাজায়ে খাজেগান গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈন উদ্দীন হাসান চিশতী
সানজরী রহ.। কাদেরিয়া ও চিশতিয়া এই উভয় তরিকারই উদ্ভব ঘটিয়াছে হযরত আলী রা. হইতে।
চিশতিয়া তরিকার শাজারা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সা. হইতে শুরু করিয়া হযরত আলী রা. হইতে
হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী রহ. খেলাফত প্রাপ্তির সপ্তদশ খলিফা।
হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী রহ. শরিয়তের সকল বিধি নিষেধ পালনের
প্রতি সর্বদা সজাগ থাকিতেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন ভাবেই শরিয়তের কোন ব্যত্যয়
তিনি সহ্য করিতেন না। তিনি ভক্ত-অনুসারীদিগকে শরিয়তে পাবন্দ থাকিবার জন্য কঠোর
নির্দেশ দিতেন। এমন কি চিশতিয়া তরিকার অনুসারীগণ যেন কখনও শরিয়তের বরখেলাপ না
করিতে পারে, সেই জন্য আহলে চিশতের পরিপালনীয়
একটি অজিফা রচনা করিয়া হযরত খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহ.কে প্রদান
করিয়াছিলেন; যাহা হযরত কাকী রহ.-এর স্ব-রচিত ‘দলিলুল আরেফীন’ গ্রন্থের অষ্টম
অধ্যায়ে বিধৃত হইয়াছে।
আহলে চিশতের জন্য প্রদত্ত এই অজিফা দান কালে তিনি বলেন, “বুজুর্গানে দ্বীন হইতে আমি যে অজিফা লাভ করিয়াছি, তাহা পালনে সুদৃঢ় রহিয়াছি। মনে রাখিও, রাসূল সা. বলিয়াছেন: “তারিকুল বিরদি মালউন অর্থাৎ অজিফা ত্যাগকারী অভিশপ্ত।”
একই ভাবে তিনি তাহাদিগকে সূফী দর্শনের গূঢ় রহস্য পূর্ণ বিষয় গুলি
সম্পর্কেও দীক্ষা প্রদান করিতেন। চিশতিয়া তরিকায় নিজকে জানিবার বা দেহ তত্ত্বের
তালিম গ্রহণের বিশেষ গুরুত্ব রহিয়াছে। এই তালিমের চূড়ান্ত পর্য্যায়ে উন্নীত না
হওয়া পর্য্যন্ত কেহ এই তরিকায় কামালিয়ত অর্জন করিতে পারে না বা তাহার পক্ষে
সূফী-দরবেশ পর্য্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। দেহ তত্ত্বের প্রধান সাধনা হইল
আনাসির-এ-খামসা বা পঞ্চভূত (পঞ্চ উপাদান)। এই সাধনার গুরু হযরত মুহাম্মদ সা.।
তাঁহার নিকট হইতে হযরত আলী রা., হযরত আলী রা.
হইতে হযরত হাসান বসরী রহ. এই তালিম লাভ করেন। সিনা-ব-সিনা চলিয়া আসা এই তালিম হযরত
ওসমান হারুনী রহ.ও লাভ করেন। এই তালিম গুলি লিপিবদ্ধ ছিল না। হযরত খাজা মঈন উদ্দীন
চিশতী রহ. তালিম গুলি সু-শৃঙ্খল ভাবে সাজাইয়া গুছাইয়া লিপিবদ্ধ করেন।
চিশতিয়া তরিকা মতে আব, আতশ, খাক, বাদ ও নূর যথাক্রমে পানি, আগুন, মাটি, বায়ু এবং নূরকে আনাসির-এ-খামসা বা পঞ্চ উপাদান নামে অভিহিত করা হয়।
সমুদয় সৃষ্টি জগতের মূল উৎস এই পঞ্চ উপাদান। সমুদয় জড় বস্তু ও প্রাণী দেহে ‘আনাসিরে আরবায়া’ বা চার উপাদান
যেমন পানি, আগুন, মাটি ও বায়ুর সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে। আর চার উপাদানের মূলে রহিয়াছে নূর
বা এক জ্যোতির্ম্ময় সত্তা। প্রত্যেক উপাদানে রহিয়াছে পাঁচটি গুণ বা সিফাত।
উহা আবার তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। যথা:
১. আহাদিয়াত : এই স্তরে মহিমান্বিত আল্লাহ আপনাতেই বিদ্যমান এবং
অতি সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম দরিয়া রূপে রহিয়াছেন। এই পর্য্যায়ে তিনি একক ও অদ্বৈত।
২. ওয়াহিদাত : এই স্তরে তিনি তাঁহার ইরাদা বা আকাক্সক্ষা বা এশক
(প্রেম) হইতে নূরে মুহাম্মদী সা. সৃষ্টি করেন।
৩. ওয়াহেদিয়াত : এই স্তরে নূরে মুহাম্মদী সা. হইতে তিনি নিজেকে
বিশ্ব চরাচর সৃষ্টির সঙ্গে ‘আহমদ’ রূপে প্রকাশ করেন। এই কারণেই কুরআনের পূর্বে সকল ধর্ম্ম গ্রন্থে
হযরত মুহাম্মদ সা.কে ‘আহমদ’ উল্লেখ করা হইয়াছে।
হযরত সুরেশ্বরী রহ. তাঁহার রচিত আধ্যাত্মিক ঊর্দু গ্রন্থ “সিররেহক্ক জামেনূর”- লেখকের ভূমিকায় লিখেছেন “আহাদ” এবং “আহমাদ” এর মধ্যে “মীম” এর পার্থক্য কেবল হামদ্ ও নাতের
জন্য।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের
কাব্য পংক্তিতে সেই সুরই ধ্বনিত হইয়াছে এই ভাবে
আহমদের ঐ মীমের পর্দা উঠিয়ে দেখ মন
আহাদ সেথায় বিরাজ করে হেরে গুণীজন
॥
যে চিনতে পারে রয় না ঘরে হয় সে উদাসী
সে সকল ত্যাজি ভজে শুধু নবীজীর
চরণ ॥
এই তালিমকে ‘মান আরাফা
নাফসাহু’ এর তালিমও বলা হয়। এই তালিম রপ্ত
না করা পর্যন্ত কেহই প্রকৃত সূফী বা চিশতিয়া তরিকার পীর হইবার যোগ্য নহে।
চিশতিয়া তরিকায় সামা প্রচলিত রহিয়াছে। মাঝে মাঝে এই তরিকা পন্থীগণ
সামার অনুষ্ঠান করেন। ইহাতে তাহারা জজবার হালতে পৌঁছেন। সামার দ্বারা আল্লাহর
প্রেম বর্ধিত হয়। তাই চিশতিয়া তরিকার মাশায়েখগণ সামাকে ‘রুহানী গেজা বা আত্মার খোরাক’ বলেন।
একই ভাবে চিশতিয়া তরিকায়ও কালেমা তাইয়্যেবা “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” যথা : লাম, আলিফ, আলিফ, লাম, হা, আলিফ, লাম, আলিফ, আলিফ, লাম, লাম, হা নোক্তা বিহীন এই বারোটি বর্ণের
খাস তালিমের বিধান রহিয়াছে। এই তরিকার প্রধান দুইটি উপ তরিকা হইল: প্রধান খলিফা
সুলতানুল মাশায়েখ হযরত নিজাম উদ্দিন রা.-এর নামানুসারে ‘নিজামিয়া’ ও অন্যতম খলিফা হযরত মখদুম আলী
কালিয়ারী রা.-এর নামানুসারে ‘সাবেরিয়া’ পৃথিবীতে অদ্যাবধি রহিয়াছে।