
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী, শিক্ষাবিদ :
জালাল উদ্দিন রুমি খুব মূল্যবান একটা কথা
বলেছেন, আমি অনেক মানুষ দেখেছি যাদের শরীরে কোন পোশাক
নেই, আমি অনেক পোশাক দেখেছি যার ভেতরে মানুষ নেই।
ছোটবেলায় স্কুলে চয়নিকা নামের
একটি বই আমাদের পড়ানো হতো | কতগুলো ছোট
ছোট গল্প সেই বইটিতে থাকতো | সেখানে রাজার পোশাক সংক্রান্ত একটা গল্প ছিল
| তখন গল্পটার
মর্ম বুঝি নাই, এখন বুঝি, তবে বোবা হয়ে থাকি | কারণ বোবার
শত্রু নাই | সমাজের কাছে বোবারা জনপ্রিয়, সত্যবাদীরা
ঘৃণিত | গল্পটা হুবহু মনে নেই, তবে গল্পটা
মোটামুটি এইরকম ছিল, এক রাজার খুব ইচ্ছে হলো, পৃথিবীর
সবচেয়ে সুন্দর ও দামি পোশাকটি তিনি পরবেন | অনেক খোজাখুঁজির পর দুজন ভালো দর্জির খবর
পাওয়া গেলো | তাদের দুজনকে রাজার পোশাক তৈরীর দায়িত্ব
দেওয়া হলো |রাতদিন ধরে পোশাক বানানোর কাজ চলছে তো চলছেই, এতটুকু বিরাম
নেই | দর্জিদের পোশাক বানাতে চাহিদারও শেষ নেই | রাজার পোশাক
বলে কথা, তাই রাজার কোষাগার থেকে দেদারসে সোনা, রুপা, হিরা, জহরত, মনিমুক্তা, অর্থ যখন যা
দরকার তা দর্জিদের চাহিদা অনুযায়ী দেওয়া হচ্ছে | দর্জিরা সবাইকে জানিয়ে দিল যারা মূর্খ ও পাগল তারা এই
পোশাক দেখতে পাবেনা। পোশাক ঠিকমতো তৈরী হচ্ছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব রাজা তার
একজন মন্ত্রীকে দিলেন | গভীর রাত অবধি সবার কানে পৌঁছাচ্ছে কাঁচির
শব্দ |
মন্ত্রীর একদিন শখ হলো, দর্জিরা
কিভাবে কাজ করছে সেটি দেখার | মন্ত্রী দেখলেন, দর্জিরা কাজ
নিয়ে খুব ব্যস্ত | এদের মধ্যে একজন শুন্যের উপর কাঁচি চালাচ্ছে, আরেকজন সুই
দিয়ে শুন্যের উপর সেলাই করছেন, কখনো কাপড় ভাঁজ করছেন | মন্ত্রী কোনও
কাপড় দেখতে পেলোনা, কিন্তু মনে মনে ভয় পেলো, এখন যদি তিনি
বলেন কোনও কাপড় দেখতে পাচ্ছেননা, তাহলে সবাই তাকে মূর্খ ও পাগল বলবে | তখন
মন্ত্রিত্বের মতো লোভনীয় পদ হারাতে হবে | মন্ত্রী মশাই পোশাকের অনেক প্রশংসা করলেন | মন্ত্রীর পর
আরও যারা পোশাক তৈরীর কাজ দেখতে এলো, সবাই পোশাকের প্রশংসা করলো |
পোশাক বানানোর কাজ শেষ হলে রাজা পোশাক দেখতে
এলো | দর্জিরা নানাভাবে পোশাকটি রাজাকে দেখাতে
লাগলেন | আসলে রাজা মশাই কিছুই দেখতে পেলেননা | কিন্তু
মন্ত্রী মশাইয়ের মতো তিনিও ভয় পেলেন এই ভেবে যে, এতো বড় রাজ্যের রাজা উনি, তিনি যদি বলেন
কোনও পোশাক দেখতে পাচ্ছেননা, তখন তাকে সবাই মূর্খ ও পাগল ভাববে, প্রজাদের কাছে
তার কোনও মূল্যই থাকবেনা | তাই রাজা নিজেও পোশাকের ভূয়সী প্রশংসা করে
দর্জিদের পুরস্কৃত করলেন |
রাজার খুব ইচ্ছে হলো, প্রজাদের
মহাসমাবেশ করে তিনি এই পোশাক পরে বের হবেন | চারিদিকে এই নিয়ে উৎসব উৎসব আমেজ সৃষ্টি হলো | রাজা দর্জিদের
বানানো পোশাকে জন সম্মুখে আসলেন | কেউ কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা, কিন্তু রাজাকে
খুশি করতে সবাই পোশাকের প্রশংসা করতে লাগলো | রাজা সবার এমন প্রশংসা শুনতে পেয়ে মহাখুশি
হয়ে উঠলেন |
কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে একটা ছোট
ছেলে বলে উঠলো, ”একি আমাদের রাজা যে ল্যাংটা।” গল্পের শেষটা
কি ছিল তা মনে নেই | হয়তো এখানে এসেই গল্পটা শেষ হয়েছিল বা আরও
দুই-একটা লাইন ছিল |
তবে সবাই মিথ্যের ঘোরের মধ্যে থাকলেও ছোট
ছেলেটা অপ্রিয় সত্য বলেছে | কারণ তার তখনও জ্ঞান হয়নি, অপ্রিয় সত্য
কথা সবখানে বলতে নেই |
গল্পের মতো করে আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষ নিজে যা
বিশ্বাস করেনা, সেটি বিশ্বাস করার অভিনয় করে যাচ্ছে | নিজে যা
মানছেনা, সেটি মানার মিথ্যে দাবি
করে যাচ্ছে | সত্য মিথ্যার ভিতরে, মিথ্যা সত্যের
ভিতরে ঢুকে পড়ছে | বুঝা যাচ্ছেনা, মানুষ কি মন্দকে ভালো বলছে, নাকি ভালোকে
মন্দ বলছে | সারা পৃথিবীতে যেন এই মিথ্যের অভিনয় চলছে | বিষয়গুলো খুব
সেনসেটিভ | তবে এখন আর বেশিরভাগ মানুষদের
শরীরেও পোশাক নেই, পোশাকের ভিতরেও মানুষগুলো নেই |
জালাল উদ্দিন রুমি খুব মূল্যবান একটা কথা
বলেছেন, আমি অনেক মানুষ দেখেছি যাদের শরীরে কোন পোশাক
নেই, আমি অনেক পোশাক দেখেছি যার ভেতরে মানুষ নেই।
ছোটবেলায় স্কুলে চয়নিকা নামের
একটি বই আমাদের পড়ানো হতো | কতগুলো ছোট
ছোট গল্প সেই বইটিতে থাকতো | সেখানে রাজার পোশাক সংক্রান্ত একটা গল্প ছিল
| তখন গল্পটার
মর্ম বুঝি নাই, এখন বুঝি, তবে বোবা হয়ে থাকি | কারণ বোবার
শত্রু নাই | সমাজের কাছে বোবারা জনপ্রিয়, সত্যবাদীরা
ঘৃণিত | গল্পটা হুবহু মনে নেই, তবে গল্পটা
মোটামুটি এইরকম ছিল, এক রাজার খুব ইচ্ছে হলো, পৃথিবীর
সবচেয়ে সুন্দর ও দামি পোশাকটি তিনি পরবেন | অনেক খোজাখুঁজির পর দুজন ভালো দর্জির খবর
পাওয়া গেলো | তাদের দুজনকে রাজার পোশাক তৈরীর দায়িত্ব
দেওয়া হলো |রাতদিন ধরে পোশাক বানানোর কাজ চলছে তো চলছেই, এতটুকু বিরাম
নেই | দর্জিদের পোশাক বানাতে চাহিদারও শেষ নেই | রাজার পোশাক
বলে কথা, তাই রাজার কোষাগার থেকে দেদারসে সোনা, রুপা, হিরা, জহরত, মনিমুক্তা, অর্থ যখন যা
দরকার তা দর্জিদের চাহিদা অনুযায়ী দেওয়া হচ্ছে | দর্জিরা সবাইকে জানিয়ে দিল যারা মূর্খ ও পাগল তারা এই
পোশাক দেখতে পাবেনা। পোশাক ঠিকমতো তৈরী হচ্ছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব রাজা তার
একজন মন্ত্রীকে দিলেন | গভীর রাত অবধি সবার কানে পৌঁছাচ্ছে কাঁচির
শব্দ |
মন্ত্রীর একদিন শখ হলো, দর্জিরা
কিভাবে কাজ করছে সেটি দেখার | মন্ত্রী দেখলেন, দর্জিরা কাজ
নিয়ে খুব ব্যস্ত | এদের মধ্যে একজন শুন্যের উপর কাঁচি চালাচ্ছে, আরেকজন সুই
দিয়ে শুন্যের উপর সেলাই করছেন, কখনো কাপড় ভাঁজ করছেন | মন্ত্রী কোনও
কাপড় দেখতে পেলোনা, কিন্তু মনে মনে ভয় পেলো, এখন যদি তিনি
বলেন কোনও কাপড় দেখতে পাচ্ছেননা, তাহলে সবাই তাকে মূর্খ ও পাগল বলবে | তখন
মন্ত্রিত্বের মতো লোভনীয় পদ হারাতে হবে | মন্ত্রী মশাই পোশাকের অনেক প্রশংসা করলেন | মন্ত্রীর পর
আরও যারা পোশাক তৈরীর কাজ দেখতে এলো, সবাই পোশাকের প্রশংসা করলো |
পোশাক বানানোর কাজ শেষ হলে রাজা পোশাক দেখতে
এলো | দর্জিরা নানাভাবে পোশাকটি রাজাকে দেখাতে
লাগলেন | আসলে রাজা মশাই কিছুই দেখতে পেলেননা | কিন্তু
মন্ত্রী মশাইয়ের মতো তিনিও ভয় পেলেন এই ভেবে যে, এতো বড় রাজ্যের রাজা উনি, তিনি যদি বলেন
কোনও পোশাক দেখতে পাচ্ছেননা, তখন তাকে সবাই মূর্খ ও পাগল ভাববে, প্রজাদের কাছে
তার কোনও মূল্যই থাকবেনা | তাই রাজা নিজেও পোশাকের ভূয়সী প্রশংসা করে
দর্জিদের পুরস্কৃত করলেন |
রাজার খুব ইচ্ছে হলো, প্রজাদের
মহাসমাবেশ করে তিনি এই পোশাক পরে বের হবেন | চারিদিকে এই নিয়ে উৎসব উৎসব আমেজ সৃষ্টি হলো | রাজা দর্জিদের
বানানো পোশাকে জন সম্মুখে আসলেন | কেউ কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা, কিন্তু রাজাকে
খুশি করতে সবাই পোশাকের প্রশংসা করতে লাগলো | রাজা সবার এমন প্রশংসা শুনতে পেয়ে মহাখুশি
হয়ে উঠলেন |
কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে একটা ছোট
ছেলে বলে উঠলো, ”একি আমাদের রাজা যে ল্যাংটা।” গল্পের শেষটা
কি ছিল তা মনে নেই | হয়তো এখানে এসেই গল্পটা শেষ হয়েছিল বা আরও
দুই-একটা লাইন ছিল |
তবে সবাই মিথ্যের ঘোরের মধ্যে থাকলেও ছোট
ছেলেটা অপ্রিয় সত্য বলেছে | কারণ তার তখনও জ্ঞান হয়নি, অপ্রিয় সত্য
কথা সবখানে বলতে নেই |
গল্পের মতো করে আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষ নিজে যা
বিশ্বাস করেনা, সেটি বিশ্বাস করার অভিনয় করে যাচ্ছে | নিজে যা
মানছেনা, সেটি মানার মিথ্যে দাবি
করে যাচ্ছে | সত্য মিথ্যার ভিতরে, মিথ্যা সত্যের
ভিতরে ঢুকে পড়ছে | বুঝা যাচ্ছেনা, মানুষ কি মন্দকে ভালো বলছে, নাকি ভালোকে
মন্দ বলছে | সারা পৃথিবীতে যেন এই মিথ্যের অভিনয় চলছে | বিষয়গুলো খুব
সেনসেটিভ | তবে এখন আর বেশিরভাগ মানুষদের
শরীরেও পোশাক নেই, পোশাকের ভিতরেও মানুষগুলো নেই |