অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ঃ
মানুষের জীবনটাকে কতটা আমরা জানি। সবটাই কি অভিনয় নাকি সবটাই জীবন। একটা হাসিমুখ আমরা দেখি তবে সেই হাসিমুখের পিছনে মানুষের প্রতিদিনের জীবনের সাথে যুদ্ধটা কি আমরা দেখি। হয়তো দেখি না।
মানুষের সেটা দেখার মতো যে একটা মন থাকতে হয় সেটা তো আমাদের অনেক আগেই মরে গেছে। যেমন সময়ের সাথে অনেক কিছুই মরেছে। সময়ের সাথে লাল চিঠির বাক্সটা এখন আবর্জনায় পরিণত হয়েছে। চিঠিটাও এখন ইতিহাস।
খট খট শব্দে আঙুলের বেদনায় আহত টাইপ রাইটার আর নেই। যে মানুষটা টাইপ রাইটার দিয়ে একদিন কালো অক্ষরের জাদুতে মাতিয়ে তুলতো মানুষকে সে মানুষটাও সময়ের সাথে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কম্পিউটার মতো আধুনিক প্রযুক্তি এসে টাইপ রাইটারকে অপ্রচলিত পণ্যে পরিণত করেছে।
আগে গ্রামে যাত্রাপালা হতো। কত মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল সে যাত্রাপালা। হায়, সেটাও তো আর নেই। একসময়ের মূল্যবান জিনিস আজকের সময়ে এসে মূল্যহীন হয়েছে। বায়োস্কোপ এখন আর চোখে পড়ে না। একটার পর একটা নির্বাক ছবি টেনে বায়োস্কোপওয়ালা আনন্দচিত্তে বলতেন, “এই বারেতে দেখা গেল, জরিনা সুন্দরী এলো। কোমরেতে বিছা ছিল, কানে তাহার দুল ছিল। আহা কি চমৎকার দেখা গেল। কি চমৎকার দেখা গেল, আরও কিছু রইয়া গেল, তারা জ্যোতি চইলা গেছে, দেখতে কত বাহার আছে, এইবারেতে দেখেন ভাল, আপন রাজা সামনে আছে। তীর-ধনুক হাতে আছে। ” মানুষকে আনন্দ দেবার সে মানুষটাও আর নেই।
একসময়ের দুরন্ত সময় আজ কেবল বিবর্ণ স্মৃতি। সময়ের সাথে সাথে মানুষ প্রযুক্তির জাদুকরী শক্তিতে বদলেছে। কিন্তু মাটির গন্ধও হারিয়েছে। সে মাটির গন্ধে বেগ হয়তো ছিল না তারপরও আবেগ ছিল। মনে পড়ছে পুতুল নাচের কথা। মানুষের অদৃশ্য আঙুলের নিপুণ কারুকাজে বোবা পুতুলগুলো নাচতো। মানুষ যেভাবে চাইতো সেভাবে পুতুলগুলো আছাড়ি-বিছাড়ি করে নেচেছে। অদৃশ্য মানুষটা এখন আর নেই, যেমন নেই পুতুল নাচের সেই ফেলে আসা দিনগুলো। তবে পুতুল নাচ আমাদের জীবনবোধের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। কখনো মনে হয় আমরাও যেন সেই পুতুলদের মতো নেচে চলেছি কোনো এক অদৃশ্য শক্তির আকর্ষণে। এমন করেই হয়তো শক্তির পিছনে শক্তি, তারও পিছনে শক্তি এ খেলায় মেতে উঠেছে। সবাই হয়তো তা জানে তবে বুঝতে পারে না।
সার্কাসের রং মেখে সং সাজা জোকারটার মুখটা খুব বেশি মনে পড়ছে। একটা কৃত্রিম হাসি মুখে ধরে রেখে জীবন যন্ত্রনায় জ্বলে-পুড়ে ছাই হওয়া মানুষটার ভিতরের বোবা আর্তনাদ বুকটাকে এখন কেমন যেন বুলেটবিদ্ধ করে যায়। জীবনকে বাজি রেখে জোকার নামের মানুষটা মানুষের মনোরঞ্জনের উপাদান হলেও তার ভিতরের কান্নাকে কেউ কখনো বুঝেও বুঝেনি।
সাদাকালো সিনেমার সময় যে মানুষটার অভিনয় সিনেমাকে রঙিন করেছিল সে মানুষটার নাম চার্লি চ্যাপলিন। চার্লি চ্যাপলিন সেই মহান অভিনেতা যিনি বুকে কষ্ট চেপে দর্শকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। পরনে নাক সিটকানো কোট-টাই, ঢিলেঢালা জরাজীর্ণ প্যান্ট, মাথায় কালো রঙের ডার্বি হ্যাট, হাতে একটি পাতলা ছড়ি, পায়ে এবড়ো থেবড়ো এক জোড়া বুট এবং ঠোঁটের ঠিক উপরে খাটো গোঁফ মানুষটার। নিজের জীবনকে টুকরো কাচের আয়নায় দেখে উপহাস করে তিনি বলেছেন “এমনকি একটি জেলীফিশের কাছেও জীবন অনেক সুন্দর ও দারুণ একটা জিনিস”। চার্লি চ্যাপলিন সব সময় বলতেন তার মা’ই তার অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার্লি চ্যাপলিন তাকে পরম যত্নে আগলে রেখেছিলেন; কোনো কষ্ট তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
অথচ তিনি আজীবন কষ্টকে ধারণ করে জীবনকে এগিয়ে নিয়েছেন। এখন তো সময় বদলেছে। মানুষ খুব কমার্শিয়াল হয়েছে। নিজের স্বার্থ নিয়ে যে মানুষরা প্রতিদিন একে অন্যের সাথে লড়ছে তারা কি মমতাময়ী মায়ের সেই ভালোবাসার মুখটা কখনো খুঁজেছে। না, তেমনটা ঠিক দেখছি না। মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন সে নাড়ির টানকে গলা টিপে হত্যা করেছে। নিজে ক্রীতদাসের হাসি হেসেছে আর মায়ের হাসিকে বৃদ্ধাশ্রমের চার দেওয়ালে আটকে রেখে নিজের শেকড়কে লাথি মেরে ছুড়ে ফেলেছে পিচ ঢালা রাজপথে। সত্য মিথ্যার গল্পটা বার বার বলতে ইচ্ছে করে।
আমরা যেটা হাসি সেটা সত্য না মিথ্যা। নাকি সেটা একটা নগ্ন রহস্য। ফেলে আসা পুরাতন কিছু। হয়তো একটা মানুষ, তার পিছনের মানুষ, তার সামনের মানুষ, তার ভিতরের মানুষ সবকটাই একটা মানুষ তবে অভিন্ন মানুষ নয়। যেমন যে সত্যকে আমরা দেখি তা হয়তো সত্য নয়। যা দেখি না সেটাই সত্য। মানুষের বাইরের শরীরের চেয়ে যেমন ভিতরের হাড় দিয়ে গড়া কংকালটা সত্য।
সত্য এমন আগুনে পোড়া নদীর মতো। জলীয় বাষ্পের মতো। মেঘে ঢাকা তারার মতো। যার গতিপথ জীবনের গতিপথকে হার মানায়।
সব কিছু মানুষের আজ কেমন করে যেন হারিয়ে গেছে। এক একটা মানুষ জীবন্ত লাশ হয়ে রাজপথের কোলাহলে নিজেদের অস্তিত্ব হারাচ্ছে। ঝুলন্ত বাদুড় হয়ে সত্য মিথ্যার পোশাক পড়ে মানুষের বিবেক বিক্রি হচ্ছে প্রতিদিন। তাও খুব চড়া দামে। তারপরও সব হারিয়েও জীবনবোধের বিশ্বাস তো কখনো হারাতে নেই। আবেগ তো কখনো হারাতে নেই। স্বপ্ন জয়ের হাসি তো কখনো হারাতে নেই। প্রতিদিন মানুষের মৃত্যুর খবর যেমন আসে তেমনি নবজাতকের ভূমিষ্ঠের খবরও আসে। সব পুরাতন পচে যায় না। নষ্ট হয়ে নষ্টের দড়িতে ঝুলে পড়ে না। যেমন সময়। যেমন সততা। যেমন মানবিক মূল্যবোধ। এমন আরও অনেক মূল্যহীন মানুষের বাজারের অনেক অদেখা মূল্যবান জিনিস।
চলন্ত ট্রেনটা মানুষকে পিষে ফেলার আগেই মানুষ সেখান থেকে বেরিয়ে আসুক। সব মানুষ রক্ত মাংসের মানুষ হোক। যেমন মানুষ, মানুষ তেমনটাই থাকুক। সবটাই এক ঝাপটায় মানবিক নগর হয়ে উঠুক মানুষের অতৃপ্ত যন্ত্রনায়। সেটা চোখে না দেখে মন দিয়ে দেখাটাতেই আনন্দ। তার থেকে বেশি কিছু নয়।