মুহাম্মদ মাসুম খান: মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার মেঘনা ও ফুলদী নদীর তীরে থ্রিএঙ্গেল শীপ ইয়ার্ড কোম্পানী বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত একটি কোম্পানী।
২০১০ সালে এই কোম্পানি নয়ানগর মৌজায় জমি কেনার নাম করে প্রান্তিক শ্রেনীর জনগনের কৃষিজ জমি,বিল, হাওড়,খাস জমি, খাল এবং নদী দখল শুরু করে।
শুরু থেকেই এই কোম্পানীর কৃষিজ জমি, খাস জমি এবং খাল দখলের বিরুদ্ধে এলাকার জনগন বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ আন্দোলন করেছে, স্থানীয় এবং প্রায় সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এই কোম্পানির অপকর্মের বিরুদ্ধে একাধিকবার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
একাত্তর,ইন্ডিপেন্ডেটস টিভি সহ বেশ কয়েকটি টেলিভিশনে বিশদ প্রতিবেদন হয়েছে। থ্রিএঙ্গেলের নানা অনিয়ম অপকর্মের কারনে তার আইপিও বাতিল করেছিল বিসিইসি। ২০১৯ সালে জাতীয় নদী কমিশন থ্রিএঙ্গেলকে মুন্সীগঞ্জ জেলার ১ নম্বর নদী দখলদার কোম্পানী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
২০২০ সালে হাইকোর্টে কোম্পানির বিরুদ্ধে রিট করা হয় যে রিট পিটিশন নম্বরঃ 8768 of 2020। রিটে বলা হয় সংশ্লিষ্ঠ ১২ কর্তৃপক্ষকে এই মর্মে নোটিশ দেয়া হয় যে,কেন থ্রিএঙ্গেলের নদী,খাল,কৃষিজ জমি এবং খাস জমি দখলের বিরুদ্ধে একশন না নেয়া এবং এসব বন্দ না করা তাদের ব্যর্থতা বলে গন্য হবে না এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে না?
নোটিশে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জবাব দেয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল। ফলে সংশ্লিষ্ঠ বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময় থ্রিএঙ্গেলকে অবৈধ স্থাপনা বন্ধে চিঠি প্রদান ওতদন্ত করেন। কিন্তু থ্রিএঙ্গেল কোম্পানি এসবের কোন তোয়াক্কা না করে তাদের স্থাপনা চালিয়ে যায়। পরবর্তিতে সাংবাদিক,শিক্ষক,আইনজীবী এবং পরিবেশ সচেতন বিভিন্ন শ্রেনি পেশার মানুষের সম্বনয়ে নদী-খাল ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলা হয়।
তারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে থ্রিএঙ্গেলের নদী-খাল ও কৃষিজ জমি দখলের বিষয়টির ভয়াবহ পরিনতি সম্পর্কে জনগনকে সচেতন করে তুলেন। নখাপরক এর সভাপতি বিশিষ্ঠ আলোকচিত্র সাংবাদিক, গবেষক সাহাদাত পারভেজের তোলা একটি ছবি দিয়ে,"মেঘনা-ফুলদীর বুকে কারখান " শীর্ষক একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দেশ রুপান্তর পত্রিকায় ২৮ জুলাই ২০২১ সালে।
পরবর্তিতে ২ আগস্ট মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়কে চিঠি দেয় তদন্ত করার জন্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন তদন্ত করে। ২০ অক্টোবর প্রশাসন নদী, খাল ও সরকারের খাসজমি দখলের অভিযোগের সত্যতা পায়নি বলে প্রতিবেদন জমা দেয়।
এরপর ১৬ নভেম্বর দেশ রুপান্তর, ডেইলি স্টার সহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায়" দেখল না ‘অন্ধ’ প্রশাসন” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে মন্ত্রিপরিষদ ফের তদন্ত করার নির্দেশ দেয়। তার প্রেক্ষিতে ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২২ তারিখে কমিটি সরেজমিন গিয়ে দুটি খাল ভরাটের সত্যতা পায় এবং সাংবাদিক,কৃষক এবং জনতার সামনে স্বিকার করেন যে থ্রিএঙ্গেল কোম্পানি দুটি খাল দখল করেছে তবে নদী দখল হয়নি। যদিও নদী কমিশন, জেলা প্রশাসন ২০১৯ সালে থ্রিএঙ্গেলকে ১নম্বর নদী দখলদার হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিলেন।
তবে পরিবেশকর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞরা সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে করা কমিটির বিরোধিতা করেছেন। তারা ফুলদী ও মেঘনা নদী দখলমুক্ত করতে দ্রুত একটি বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন। তাদের যুক্তি, যেখান দিয়ে নদীর পানি প্রবাহিত হয় সেটাই নদী। সরকারের রেকর্ডপত্রে কী আছে, তা বিবেচ্য নয়।
তদন্ত কমিটির প্রধান সরকারের উপসচিব মোহাম্মদ এনামুল আহসান বলেন, ‘নয়ানগর মৌজায় দুটি খাল থ্রিএঙ্গেল মেরিন দখল করেছে। এ দুটি খাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে উদ্ধার করা হবে।’ পরবর্তীতে থ্রিএঙ্গেলের দখলকৃত জায়গায় জেলা প্রশাসন সাইন বোর্ড লাগিয়ে দেয় যাতে লিখা হয়" এই জমির মালিক জেলা প্রশাসন"
কিন্তু অদ্যাবধি কেন ৩০০ বছরের পুরানো জীবন্ত খাল দুটি উদ্ধার করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নি। মুন্সিগঞ্জ উপ বিভাগ,পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী রাকিব এবং কতিপয় কর্মকর্তা থ্রিএঙ্গেলের সাথে কারসাজি করে এই খনন প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছেন বলে গোপন সূত্র থেকে জানা যায়।
এদিকে এলাকায় ভুক্তভোগী কৃষক জমি হারিয়ে নিস্ব হওয়াসহ,খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় এলাকার জীব বৈচিত্র মারাত্মক ভাবে নষ্ট হচ্ছে, কৃষিক সংস্কৃতি বিলীন হয়ে যাচ্ছে,ফুলদী নদীর মুখ সরু হয়ে গেছে,ফুলদী নদীর নাব্যতা কমে গেছে। ফলশ্রুতিতে পুরো গজারিয়া উপজেলার সকল খালগুলি শুকিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ পরিনতির দিকে এগুচ্ছে সুজলা সুফলা ফুলদী এবং মেঘনা নদীর জল ধারায় সিক্ত গজারিয়া উপজেলা।
উল্লেখ্য বর্তমান সরকার নদী-খাল রক্ষায় অত্যন্ত কঠোর। অতিসম্প্রতি ঢাকার মুহাম্মদ্দপুরে বসিলা খাল সহ সারাদেশ ব্যাপী দখলকৃত অনেক নদী-খাল উদ্ধার করা হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে থ্রিএঙ্গেলের দখলকৃত গজারিয়ার ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী বোরোচক, কুমোরিয়া খাল দুটি কেন উদ্ধার হবে না? শান্তিপ্রিয় নিরীহ এলাকাবাসীর মধ্যে থ্রিএঙ্গেলের বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভ জমে উঠছে ক্রমশ।
নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় এলাকার পরিবেশ বাচাতে সচেতন মানুষের নেতৃত্বে আপামর জনগন যে কোন সময় কঠোর আন্দোলন দিতে বাধ্য হবে।