আগাম তোলার পর এখন বাজারে এসেছে
নতুন আলু। দাম কমেছে ভোক্তা পর্যায়ে। তবে খেত থেকে বিক্রির হওয়া আলুর দামের সঙ্গে
বাজারে বিক্রি হওয়া দামের পার্থক্য অনেক। হাত ঘুরতেই আলুর দাম বাড়ে যাচ্ছে ৫০
শতাংশ। কৃষক পর্যায়ে ৩০ টাকা কেজি দরের আলু বাজারে বিক্রির হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫
টাকায়। দেশে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য রয়েছে আলুর ব্যবসায়। এ কারণে ঠকছেন কৃষক
ও ভোক্তারা।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন
জেলায় আলুর উচ্চফলন হলেও হিমাগার না থাকায় সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন না কৃষকরা। ফলে
পচনের ভয়ে কম দামেই আলু বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। পরে বছর শেষে কৃষককেই আলু কিনতে
হচ্ছে বিক্রির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় খোঁজ নিয়ে এই
অবস্থা দেখা গেছে। এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিভাগের
তৎপরতার কমতিকে দায়ী করছেন ক্রেতারা।
গতকাল বৃহস্পতিবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় খেত থেকে আলু বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৩৫
টাকায়। একই দিনে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে আলু খুচরা বিক্রির হচ্ছে ৪৫ টাকা দরে। তবে
রাজধানী ও আশপাশের এই দামের বৈচিত্র্য পাওয়া গেছে। ঢাকার ডেমরা এলাকায় ভ্রাম্যমাণ
বিক্রেতারা আলু বিক্রি করেছেন ৪০-৪৫ টাকা দরে। তবে মিরপুর এলাকায় আলু বিক্রি হয়েছে
৪৫-৫২ টাকা কেজি দরে। রাজধানীর বাসাবো এলাকায় আলু বিক্রির হয়েছে ৬০ টাকা কেজি
পর্যন্ত। রাজধানীর অদূরের জেলা নরসিংদীতেও আলু বিক্রি হয়েছে এই দামে।
রংপুর : জেলার পীরগাছা উপজেলার পারুল
ইউনিয়নে মাঠে আলু বিক্রি হয় কেজি ৩২-৩৫ টাকা, উপজেলা সদরের বাজারে আলু বিক্রি হয়
৩৮ টাকা। তবে জেলা শহরের মডার্ন মোড় পাইকারি বাজারে ৩৮ টাকা ও খুচরা বাজারে ৪০
টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হয়। গতকাল একই অবস্থা ছিল সিটি বাজারের।
বিভাগের পাঁচ জেলায় চলতি মৌসুমে ৯৮ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা
নির্ধারণ করা হয়। তবে আলুর চাষ হয়েছে ১ লাখ ৬০২ হেক্টর জমিতে। এতে লক্ষ্যমাত্রার
চেয়ে ২ হাজার ৯২ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ বেড়েছে। গত মৌসুমে এই অঞ্চলে ৯৭ হাজার ৩২৭
হেক্টর জমিতে আলুর চাষ করা হয়েছিল।
সংরক্ষণে হিমাগার সংকট
সৃষ্টি না হলেও আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে
চলতি বছর অতিরিক্ত কুয়াশায় লেটব্লাইটের শঙ্কা কাটাতে ওষুধ ছিটানোতে খরচ বাড়ছে
কৃষকের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুরের উপপরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘চলতি মৌসুমে রংপুরে ৫৩ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে, যা বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ অঞ্চলে আলু সংরক্ষণের ৬৭টি হিমাগারের মধ্যে ৪০টিই রংপুর জেলায় অবস্থিত।
সিরাজগঞ্জ : জেলায়
৩ হাজার ৭০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে ২
হাজার ৬৯৫ হেক্টর। এ থেকে আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার টন হয়েভে
বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি বিভাগ।
জেলায় সরকারি কোনো
হিমাগার না থাকায় চাষিরা সনাতন পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষণ করেন। ফলে অনেক সময় সংরক্ষিত
আলু নষ্ট হওয়ায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা।
ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা
সরাসরি মাঠে থেকে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায় মণ (কেজি ৩০-৩২) আলু কিনছেন। জেলার বাজারে
জাত ভেদে ৩০-৪৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে।
জেলার তাড়াশ উপজেলার
নাদোসৈয়দপুর গ্রামের আলু চাষি সালাম জানান, ‘এবার আলুর দাম ও ফলন ভালো। তবে হিমাগার
না থাকায় আলু সংরক্ষণ করতে পারি না। যে কারণে ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছে কম দামে আলু বিক্রি
করতে বাধ্য হই।’
তবে কৃষি সম্প্রসারণ
অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মশকর আলী আলুর ভালো ফলন হওয়ার পাশাপাশি
বাজারে দাম বেশি থাকায় কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন বলে দাবি করেছেন।
বগুড়া : বগুড়ায় এবার আগে বছরের চেয়ে ২
হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আলু চাষ হয়েছে। গত বছর ৫৩ হাজার ২১৫ হেক্টর জমি থেকে ১২
লাখ ২৪ হাজার ১২০ টন আলু উৎপাদন হয়। চলতি মৌসুমে আলু চাষ হয়েছে ৫৫ হাজার ২৬০
হেক্টর জমিতে। এখান থেকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ২০ হাজার ৪৭৫ টন।
বগুড়ায় পাকড়ি জাতের
আলু জমি থেকেই কৃষক বিক্রি করছেন প্রতি কেজি ৩৭-৩৮ টাকা দরে। সেই আলু শহরের
পাইকারি বাজার রাজাবাজারে এসে প্রতি কেজি ৪৪ টাকা ও খুচরা বাজারে ৪৫-৫০ টাকায়
বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া ডায়মন্ড, এস্টারিক্স, কার্ডিনাল জাতের আলু জমি থেকে ৩৪-৩৬ টাকা বিক্রি হলেও
পাইকারি বাজারে ৪০-৪৩ টাকা ও খুচরা বাজারে ৪৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
সদরের শাখারিয়া এলাকার
চাষি রফিকুল ইসলাম জানান, আগাম জাতের আলু তারা উত্তোলন করে জমি থেকেই বিক্রি
করছেন, এতে তাদের পরিবহন খরচ বেঁচে যাচ্ছে। তবে বাজার রাজাবাজারের পাইকারি
ব্যবসায়ী রায়হান আলী জানান, পরিবহন খরচ, খাজনা, বাছাই খরচ মিলে প্রতি কেজি ২ থেকে
৩ টাকা খরচ হয়।
মুন্সীগঞ্জ : চলতি বছর জেলায় ৩৪ হাজার ৩৫৫
হেক্টর জমিতে আলু আবাদ করা হয়েছে। মুন্সীগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের
তথ্য অনুযায়ী তা লক্ষ্যমাত্রা চেয়ে ১০ হেক্টর বেশি। তবে জেলায় এখনো আলু তোলা তেমন
শুরু হয়নি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. জাকির
হোসেন বলেন, আলু গাছে যেন আগাম নাভিদশা রোগ থেকে প্রতিকার ও প্রতিরোধে ছত্রাকনাশক
ওষুধ ছিটাতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
নরসিংদী : জেলার ছয় উপজেলার মধ্যে
শিবপুর, মনোহরদী, বেলাব ও রায়পুরায় সবচেয়ে বেশি আলু আবাদ হয়েছে। জেলায় এবার প্রায়
২ হাজার হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। কৃষি কার্যালয়ের তদারকির ফলে বিভিন্ন এলাকায়
বাম্পার ফল হয়েছে।
জেলার রায়পুরা উপজেলার
রংপুর গ্রামের চাষি মাহালম মিয়ার প্রায় দুই একর জমিতে ৪৭ মণ আলু হয়েছে। তিনি বলেন,
প্রথম দিকে প্রতি মণ আলু দুই হাজার টাকার বেশি দরে বিক্রি করেছেন। এখন ১ হাজার ৯০০
টাকায় বিক্রি করায় প্রতি কেজির দাম পড়ছে প্রায় ৪৮ টাকা। তবে বাজার ঘুরে প্রতি মণ
আলুর দাম পড়ছে ২ হাজার ৪০০ টাকা দরে। এতে প্রতি কেজি পড়ছে ৬০ টাকা। এদিকে
নরসিংদীতে আলু সংরক্ষণাগার (হিমাগার) না থাকার কারণে কৃষকরা সঠিক দাম পায় না।
পচনের ভয়ে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন তারা।
নীলফামারী :জেলায়
চলতি মৌসুমে জেলায় আলুর ভালো ফলন হলেও খেত ও বাজারের দামের ফারাকে হতাশ চাষিরা।
আলু খেত থেকে আলু বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ২৪-২৫ টাকা দরে। হাত ঘুরে বাজারে একই
আলু বিক্রি হচ্ছে কেজি ৪৫ টাকায়। সদর উপজেলার মুন্সীপাড়া গ্রামের মমতাজ উদ্দিনসহ
একাধিক চাষির সঙ্গে কথা বলে এই অবস্থা জানা গেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ
অধিদপ্তরের উপপরিচালক এস এম আবু বকর সাইফুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় আলু
চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয় ২১ হাজার ৭১২ হেক্টর জমি। তবে হঠাৎ আলু বাজার
ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় আরো ২৭৮ হেক্টর বেশি জমিতে আলু চাষ করেছেন কৃষকরা। এতে উৎপাদন
লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫ টন।
জেলার বড় বাজারের আলু
সরবরাহকারী আদম আলী জানান, জেলার ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা খেত থেকে আলু সংগ্রহ করা আলু
তাদের কাছে ২৭-২৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে তারা
এই আলু বিক্রি হচ্ছে ৩১-৩২ টাকা কেজি দরে।
শহরের ডাকবাংলো সড়কের
সার্কিট হাউজপাড়ার বাসিন্দা আজগার আলী জানান, চাষিরা আলু বিক্রি করছে ২৫ টাকা কেজি
দরে, সেই আলু খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে কেজি ৪৫ টাকায়। এজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠানের উদাসিনতাকে দায়ী করছেন তিনি।
জেলায় বার্ষিক খাওয়া
আলুর চাহিদা ৭৪ টন ও বীজ আলুর চাহিদা ৩৪ হাজার টন। জেলায় বিএডিসি ২টি ও
ব্যক্তিমালিকানাধীন ৯টি হিমাগারে আলুর ধারণক্ষমতা রয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ২৫০ টন।
ফলে জেলায় উৎপাদিত আলু স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকছে প্রায় ৪ লাখ ১৬ হাজার
৭৬১ টন।
বিরামপুর (দিনাজপুর) : উপজেলায় বিরামপুরের পাইকারি
ব্যবসায়ী আবদুল মজিদ জানান, গত সপ্তাহে ১ হাজার ৮০০ টাকা মণ কিনেছি, বৃহস্পতিবার
কেনা হয়েছে ১ হাজার ১০০ টাকা। এদিকে দেশি আলু গত সপ্তাহে ছিল ২ হাজার ৪০০ থেকে
আড়াই হাজার টাকা মণ, বৃহস্পতিবার এর দাম কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার
৪০০ টাকা মণ।
ফলে খুচরা ব্যবসায়ী ফারুক জানান, সপ্তাহের ব্যবধানে আলুর দাম কমেছে কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। গত সপ্তাহে প্রকার ভেদে দাম ছিল ৫৫-৬০ টাকা কেজি। বর্তমান বাজারে প্রকার ভেদে আলুর কেজি ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা পর্যন্ত। কৃষি কার্যালয় জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের আলু চাষ করা হয়েছে। গত মৌসুমের চেয়ে এবার আগাম আলুর ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকদের লোকসান হবে না।