Logo
শিরোনাম

ঝালকাঠিতে ধান কেনাকে কেন্দ্র করে তিন ভাইকে কুপিয়ে জখম,

প্রকাশিত:বুধবার ৩০ এপ্রিল ২০২৫ | হালনাগাদ:শুক্রবার ১৬ মে ২০২৫ |

Image

হাসিবুর রহমান, ঝালকাঠি প্রতিনিধি:

নলছিটি উপজেলার পৌরসভা এলাকার সূর্যপাশা গ্রামে ধান কেনার নামে ডেকে নিয়ে এক ব্যবসায়ীর তিন ছেলেকে ধারালো দা ও রড দিয়ে কুপিয়ে,পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ঘটনাস্থল থেকে নগদ ৮৭ হাজার টাকা ও একটি স্মার্টফোন ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।


ঘটনাটি ঘটে সোমবার (২৮ এপ্রিল) বিকেল ৫টার দিকে সূর্যপাশা এলাকার মোনাই বাড়িতে।


এ বিষয়ে আহতদের পিতা বাদী হয়ে নলছিটি থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন।  এজাহার সূত্রে জানা গেছে, সূর্যপাশার বাসিন্দা ও ধান ব্যবসায়ী মো. নুরে আলম হাওলাদারের তিন ছেলে তারেক, তুহিন ও তাহিন হাওলাদার স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার কাজে জড়িত। ঘটনার দিন আসামিরা তাদের মোনাই বাড়িতে ধান বিক্রির কথা বলে ডেকে নেয়। সেখানে গিয়ে ধানগুলো কাঁচা ও ভিজা দেখে তারা না নিতে চাইলে দুই পক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়।


পরে উত্তেজনার একপর্যায়ে আসামিরা তাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন হিরন তালুকদার, হারুন তালুকদার, মজিবর তালুকদার, মাহফুজ তালুকদার, শরিফুল হাওলাদার ও রিয়াম।

এজাহারে উল্লেখ করা হয়, হিরন তালুকদার দা দিয়ে তারেক হাওলাদারের মাথায় পরপর দুটি কোপ মারে, হারুন তালুকদার লোহার রড দিয়ে তার ডান হাতে আঘাত করে। অন্য দুই ভাইকেও বেধড়ক মারধর করা হয়।


হামলার সময় তারেক হাওলাদারের পকেটে থাকা ধান কেনার নগদ ৮৭ হাজার টাকা এবং একটি রেডমি ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয় বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।

আহতদের চিৎকারে স্থানীয়রা ছুটে এসে তাদের উদ্ধার করে প্রথমে নলছিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান, পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ভুক্তভোগী পিতা মো. নূরে আলম হাওলাদার বলেন,আমার ছেলেরা দীর্ঘদিন ধরে ধান কেনাবেচার ব্যবসায় যুক্ত। সেদিন ধান দেখেই না নেওয়ার সিদ্ধান্তে বিরক্ত হয়ে পরিকল্পিতভাবে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। তারা মারার জন্যই কুপিয়েছে। এমনকি টাকাও নিয়ে গেছে। আমি থানায় মামলা করেছি, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

এ বিষয়ে নলছিটি থানার অফিসার ইনচার্জ জানান, “লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

এ ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি  করছে। স্থানীয়রা দ্রুত দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেছেন।


আরও খবর



পাঁচ দশকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস

প্রকাশিত:শনিবার ২৬ এপ্রিল ২০২৫ | হালনাগাদ:বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫ |

Image

দেশে ১৯৭৬ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পর পর ২০২৩ ও ২০২৪ সালে তা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ায়। সে হিসাবে পাঁচ দশকের বেশি সময়ের ব্যবধানে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপের পারদ চড়ছে চলতি বছরও। পরিবেশগত বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিকভাবেই তাপমাত্রা বাড়ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তবে সে তুলনায় বাংলাদেশে বৃদ্ধির হারটা একটু বেশি। এতে জনজীবনের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এভাবে উচ্চ তাপমাত্রা অব্যাহত থাকলে ভেঙে পড়তে পারে জনস্বাস্থ্য।

 

একজন মানুষ ঠিক কতটা তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে, তা নিয়ে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব অটোয়ার একটি গবেষণা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা অনেকের ওপর পরীক্ষাটি চালিয়েছেন। তাদের ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও ৫৭ শতাংশ আর্দ্রতায় টানা ৯ ঘণ্টা রেখে দেখেছেন, বেশির ভাগই অসুস্থ হয়ে পড়ে। কেউ টানা ৯ ঘণ্টা থাকতেই পারেনি, আর যারা বেশি সময় ছিল তাদের বমি, ডায়েরিয়া, ডিহাইড্রেশনের মতো সমস্যা দেখা দিয়েছে।

দেশে বিগত কয়েক বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে তাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে হিট স্ট্রোক, ডায়রিয়া, ডিহাইড্রেশন বেড়ে গেছে অনেক বেশি। রাজধানী ঢাকার মতো জনবহুল শহরে মানুষের শারীরিক ও মনোজগতে বড় পরিবর্তন হচ্ছে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মানুষ ও প্রাণিকুলে মহামারীসহ নানা রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটবে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘‌জনস্বাস্থ্যের ভাষায় স্বাস্থ্য হলো মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার নাম। প্রকৃতি কোথাও আক্রান্ত হলে সেটা মানুষকেও কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত করবেই। আমাদের তাপমাত্রা যেভাবে বেড়ে চলছে, প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য তো বটেই, মানবস্বাস্থ্যের জন্যও এটা হুমকি। আমরা গত কয়েক দশকে অনেক নতুন নতুন রোগ-বালাইয়ের নাম শুনেছি। তাছাড়া অনেক বিরল রোগের প্রাদুর্ভাবও বাড়তে দেখা গেছে। এগুলো সবই প্রকৃতিকে আক্রান্ত করার ফল।

বাংলাদেশে যেভাবে প্রকৃত তাপমাত্রা ও অনুভূত তাপমাত্রা বাড়ছে, এতে গোটা বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখ করে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমরা বলি, মানুষ হলো প্রকৃতির সন্তান। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির একটা কারণ তো আছেই। এর বাইরে যেভাবে দ্রুত তাপমাত্রা বেড়ে চলছে, এটা চলতে থাকলে ইকোসিস্টেমে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এরই মধ্যে আমরা বায়ুদূষণের কারণে ভুগছি। বায়ুদূষণের কারণে যেসব রোগ-বালাই বাড়ছে, সেগুলো সামাল দেয়া যাচ্ছে না। আমরা ডেঙ্গু নিয়ে ভুগছি। ডায়রিয়ার প্রকোপও বাড়ছে। এগুলো সবই অতিরিক্ত তাপমাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত।

বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ে গত বছর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালএ পাঁচ দশকের তাপমাত্রা পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পাঁচ দশকের বেশি সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ৫ ডিগ্রির বেশি। এ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বেড়েছে দক্ষিণাঞ্চলে, ৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তরাঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ৪ দশমিক ৯ ডিগ্রি। আর রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৮০ সালের পর থেকে দেশের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়েই বেড়েছে। সেই সময় থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময়ে প্রতি বছর গড়ে বেড়েছে শূন্য দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে। বাংলাদেশের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশগত বিপর্যয়সহ নানা কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। আর ঢাকায় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে গণপরিসর, সবুজ ও জলাশয়ের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়াকে।

দেশের সবচেয়ে উষ্ণ মাস হিসেবে বিবেচনা করা হয় এপ্রিলকে। এ বছর চলতি মাসে দেশে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়, ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকালও দেশের সাত জেলায় তাপপ্রবাহ ছিল। তাপ বাড়ার এ প্রবণতা আজও অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

বাংলাদেশে যেভাবে প্রকৃত তাপমাত্রা ও অনুভূত তাপমাত্রা বাড়ছে এতে গোটা বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে বলে মন্তব্য করছেন বিশেষজ্ঞরা। জলাবায়ু পরিবর্তনের কারণ ছাড়াও মানবসৃষ্ট নানাবিধ কারণে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা ব্যাপকতর হচ্ছে বলে জানান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌বাংলাদেশে এপ্রিলে গরমের তীব্রতা বাড়তে থাকে। মে মাসে তীব্র গরম থাকার পর জুনে মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে বর্ষার আগমন ঘটলে তাপমাত্রার তীব্রতা কমতে থাকে। গত বছরটা ছিল আমাদের জন্য ব্যতিক্রম। তবে চলতি বছর এখন পর্যন্ত গরম তার স্বাভাবিক মাত্রাতেই আছে।

আন্তর্জাতিক ওয়েদার বিশ্লেষণ বলছে, এ বছর তাপমাত্রা গতবারের মতো রেকর্ড ভাঙবে না। বৃষ্টিবাদলও হবেএমনটা জানিয়ে ড. মনিরুজ্জামান বলেন, এখানে সমস্যা যেটা হচ্ছে, ঢাকাসহ দেশের নগর এলাকায় মানবঘটিত কারণে গরমের তীব্রতা বেশি অনুভূত হচ্ছে। বিশেষ করে ইটভাটা, অত্যধিক কলকারখানা, আনফিট যানবাহন, বাসাবাড়ি ও অফিস-আদালতে এসির সংখ্যা বৃদ্ধি, উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের কারণে তীব্র বায়ুদূষণ, অবৈজ্ঞানিক উপায়ে বর্জ্য পোড়ানোএসবই গরমের অনুভূতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে তাপমাত্রা হয়তো আগের চেয়ে অল্প বেড়েছে, কিন্তু গরমের অনুভূতি ৫-৭ ডিগ্রির মতো বেশি মনে হয়। এজন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো বন্ধ করাসহ টেকসই উদ্যোগ না নিলে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের মতো এলাকায় মরুভূমির গরম অনুভূত হবে। ফলে এখানের জনস্বাস্থ্য ও কৃষি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির আধার, বৃক্ষ নিধন আর কংক্রিটের আচ্ছাদনের কারণে ঢাকা পরিণত হয়েছে আরবান হিট আইল্যান্ডে। ফলে নগরীর তাপমাত্রা ৩৪-৩৬ ডিগ্রি থাকলেও তার অনুভূতি ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রিতে গিয়ে পৌঁছে। যে কারণে গরমের মৌসুমে এ নগরীর তাপমাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে। বিভিন্ন এলাকায় পানিরও তীব্র সংকট তৈরি হয়। বাড়ে রোগ-বালাইয়ের প্রবণতাও।

প্রায় চারদিন ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় উষ্ণ তাপপ্রবাহ চলছে। এর মধ্যে কিছু এলাকায় বৃষ্টি হলেও তাতে তাপ কমেনি। আবহাওয়ার বার্তায় বলা হয়েছে, এখন যে তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে তা আজ পর্যন্তও চলতে পারে। রোববার থেকে দেশের কিছু স্থানে বৃষ্টি শুরু হতে পারে। তাতে কিছুটা কমতে পারে তাপমাত্রা।

ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও উষ্ণ তাপপ্রবাহের বেশ কয়েকটি কারণ দেখছেন পরিবেশবিদরা। তারা বলছেন, এর মূলে রয়েছে ভূমি আচ্ছাদনের (সবুজ, পানি ও ধূসর বা কংক্রিট আচ্ছাদন) মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট, কংক্রিটের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি। সেই সঙ্গে ভবনের নকশায় পরিবেশ ও জলবায়ুর ধারণা অনুপস্থিত, কাচনির্মিত ভবন ও এসিনির্ভর ভবনের নকশা তৈরি, সবুজ এলাকা নষ্ট করে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, বনায়ন না করাসহ বহুবিধ কারণ রয়েছে। ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্প-কারখানার ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণে নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি বায়ুদূষণে সৃষ্ট অতিক্ষুদ্র কণার কারণেও নগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রাকৃতিকভাবেই ঢাকা শহরে কয়েক দশক আগেও নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ সবুজ এলাকা ও জলাশয় বিদ্যমান ছিল। কিন্তু নগর এলাকায় সরু রাস্তার পাশেই সুউচ্চ ভবন নির্মাণ, সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে জলাশয়-জলাধার-সবুজ এলাকা ধ্বংস করা হচ্ছে। নির্মল বাতাস, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, শীত ও গরমের তীব্রতা থেকে নগরবাসীকে সুরক্ষা দেয়া নগর কর্তৃপক্ষের আবশ্যিক দায়িত্ব বলে মনে করেন খোদ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, নগরবাসীকে পরিবেশগত ক্ষতি থেকে বাঁচাতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। প্রথমত, আমরা গণপরিসর ও জলাশয় ব্যবস্থাপনার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। যেগুলো বেদখল, সেগুলো উচ্ছেদ চালিয়ে দখলমুক্ত করছি। আবার নতুন নতুন জায়গায় গণপরিসর সৃষ্টি করছি। দ্বিতীয়ত, রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে আমরা সবুজায়নের কাজ করছি। এতে বস্তিবাসী আমাদের সঙ্গে কাজ করছে।

তাপপ্রবাহের কারণে দেশে কৃষির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় দেখা দিয়েছে পানির সংকট। এতে ফল ও ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। কৃষি গবেষকরা বলছেন, রোদ বা সূর্যের আলো কৃষির জন্য ক্ষতিকারক নয়, বরং উপকারী। কিন্তু অতি তাপমাত্রা বা তাপপ্রবাহ কিংবা শৈত্যপ্রবাহ কৃষির জন্য সহায়ক নয়। সেই অসহিষ্ণু পরিস্থিতির ওপর দিয়েই যাচ্ছে এখন দেশের মানুষ।

কৃষিবিদরা বলছেন, তাপপ্রবাহের কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। ভালো ফলনের জন্য ফলমূল ও ফসলের গাছের গোড়ায় পানি পৌঁছানো জরুরি। গাছের গোড়ায় পানি নিশ্চিত করা গেলে তাপমাত্রা আরো ২-৪ ডিগ্রি বৃদ্ধিতে গাছের কোনো ক্ষতি হবে না। গাছের ক্ষতি না হলে ফল ও ফসলেরও কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা না। কিন্তু তাপপ্রবাহ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে বৃষ্টির প্রবণতাও। বৃষ্টি না হওয়ায় পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। ফলে সামনের দিনগুলোয় ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তাপপ্রবাহ তথা হিট শকে মাঠের বোরো ধানের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটছে, বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে গেলে ধানে চিটা ধরার আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থায় ধানে ফুল অবস্থায় পানি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধানগাছের গোড়ায় সর্বদা দুই-তিন ইঞ্চি পানি ধরে রাখা দরকার।

আম, লিচু, কাঁঠাল, জাম, জামরুলসহ সব ধরনের ফল ও ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আম ও লিচু ঝরে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে কৃষিবিদরা বলছেন, তীব্র তাপপ্রবাহে বোরো ধানসহ অন্যান্য ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বর্তমানে পোকামাকড় ও রোগ-বালাই তেমন না থাকলেও দীর্ঘমাত্রায় তাপপ্রবাহে ধান নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে, এতে আমাদের দেশেও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আমরা যেভাবে কংক্রিট আচ্ছাদন দিয়েছি, তাতে তাপমাত্রাকে সহনশীল রাখার চেষ্টা না করে আমরা তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছি। ঢাকা শহরে তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কারণ মূলত অতিমাত্রায় কংক্রিটের আচ্ছাদন। সেই সঙ্গে সবুজ, জলাশয় ও গণপরিসর কমে আসা। তাপমাত্রা মোকাবেলায় স্বল্প, মধ্য আর দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নিতে হবে। আপাতত অতিরিক্ত তাপ থেকে স্বস্তি দিতে তীব্র গরমের দিনে ওয়ার্ক ফ্রম হোম, স্কুল বন্ধ রাখা, রাস্তায় সুপেয় পানি সরবরাহ করাসহ নানা উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। আমরা পরিকল্পনা করছি রাজধানীতে গাছের আধিক্য কীভাবে বাড়ানো যায়। তবে এ তাপপ্রবাহ সমস্যার স্বল্পমেয়াদি কোনো সমাধান নেই। রাজধানীর ক্ষেত্রে মধ্যমমেয়াদি সমাধান হলো ঢাকাকে সবুজায়ন করা আর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হলো বিকেন্দ্রীকরণ, যার নীতিগত সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে।



আরও খবর



হজ বিধি লঙ্ঘনে জরিমানা ঘোষণা করল সৌদি আরব

প্রকাশিত:বুধবার ৩০ এপ্রিল ২০২৫ | হালনাগাদ:শুক্রবার ১৬ মে ২০২৫ |

Image

সৌদি আরব হজ পারমিট নির্দেশিকা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পারমিট ছাড়া হজ পালনের চেষ্টা করা ব্যক্তি এবং এতে সহযোগিতা করা যেকোনো পক্ষকে জরিমানা, বহিষ্কার ও নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হবে। খবর অ্যারাবিয়ান বিজনেস।

চাঁদ্র মাসের দুল-ক্বিদা ১ তারিখ থেকে শুরু করে দুল-হিজ্জা ১৪ তারিখ পর্যন্ত এই বিধিনিষেধ এবং জরিমানা কার্যকর থাকবে। এই সময়ের মধ্যে হজ পারমিট ছাড়া মক্কা নগরী বা পবিত্র স্থানগুলোতে প্রবেশ বা অবস্থান করার চেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে নিচের বিধানগুলো কার্যকর হবে

প্রথমত, হজ পারমিট ছাড়া হজ পালন বা পালনের চেষ্টা করলে, বা যেকোনো ধরনের ভিজিট ভিসাধারী যদি মক্কা নগরী বা পবিত্র স্থানগুলোতে প্রবেশ বা অবস্থান করার চেষ্টা করেন, তবে তাদের সর্বোচ্চ ২০,০০০ সৌদি রিয়াল (প্রায় ৫,৩০০ মার্কিন ডলার) জরিমানা করা হবে।

দ্বিতীয়ত, কোনো ব্যক্তি যদি এমন কারো জন্য ভিজিট ভিসার আবেদন করেন, যিনি হজ পারমিট ছাড়াই হজ পালন করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন, বা যিনি উল্লিখিত সময়ে মক্কা শহর ও পবিত্র স্থানে প্রবেশ করেছেন, তার বিরুদ্ধেও সর্বোচ্চ ১,০০,০০০ সৌদি রিয়াল (প্রায় ২৬,৭০০ মার্কিন ডলার) জরিমানা করা হবে। এই জরিমানা প্রতি ব্যক্তির জন্য আলাদাভাবে গণ্য হবে।

একই জরিমানা কার্যকর হবে তাদের ওপর যারা ভিজিট ভিসাধারীদের মক্কা নগরী বা পবিত্র স্থানে পরিবহন করেন বা করার চেষ্টা করেন। এ ছাড়াও যারা ভিজিট ভিসাধারীদের কোনো হোটেল, ফ্ল্যাট, ব্যক্তিগত বাসভবন, আশ্রয়কেন্দ্র বা হজযাত্রীদের জন্য নির্ধারিত বাসস্থানে আশ্রয় দেন বা দেয়ার চেষ্টা করেন, তাদের বিরুদ্ধেও একই শাস্তি প্রযোজ্য হবে।

যারা ওই ব্যক্তিদের অবস্থান গোপন রাখেন অথবা তাদের থাকার জন্য সহায়তা করেন, তারাও এই জরিমানার আওতাভুক্ত হবেন। প্রতিটি আশ্রয়প্রাপ্ত বা সহায়তাপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য জরিমানা বহুগুণে বাড়বে।

তৃতীয়ত, যেসব অবৈধ অনুপ্রবেশকারী (থাকার অনুমতি শেষ হয়ে যাওয়া বা অনিবন্ধিত অভিবাসী) হজ পালনের চেষ্টা করবেন, তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে এবং ভবিষ্যতে ১০ বছরের জন্য সৌদি আরবে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হবে।

চতুর্থত, উল্লিখিত সময়ে যারা ভিজিট ভিসাধারীদের পরিবহনে নিজস্ব যানবাহন ব্যবহার করবেন বা করাবেন, তাদের যানবাহন যদি তাদের নিজস্ব মালিকানাধীন হয়, তাহলে তা জব্দ করার জন্য সৌদি আদালতে আবেদন জানানো হবে।

সৌদি কর্তৃপক্ষের এই কঠোর পদক্ষেপ হজ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে নেয়া হয়েছে। হজ মৌসুমে বিদেশী ও অভ্যন্তরীণ সব নাগরিকদের এই নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।


আরও খবর



ভবিষ্যতের আবাসন ভাবনায় ভেনিস বিয়েন্নালে বাংলাদেশ

প্রকাশিত:শনিবার ১০ মে ২০২৫ | হালনাগাদ:শুক্রবার ১৬ মে ২০২৫ |

Image

পলাশ রহমান :

বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ আর্কিটেকচার প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ইতালির ভেনিসে। ভেনিস বিয়েন্নালে নামে পরিচিত এই প্রদর্শনী হয় প্রতি দু'বছরে একবার। এ বছরের প্রদর্শনীতে সরব উপস্থিতি দেখা যায় ভবিষ্যতের নির্মাণ ভাবনার।

বিয়েন্নালের দুই প্রধান ভেন্যু-জারদিনি ও আরসেনালেসহ গোটা শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে ৬৬টি দেশের প্যাভিলিয়ন। হাজারো দর্শকের ভিড়ে স্থান পেয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর টেকসই বাসস্থান ও জলবায়ু সচেতন ডিজাইনের ধারণা।


উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাংবাদিক হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে আমি ঘুরে দেখি- বৃটেন, ডেনমার্ক, স্পেন, হাঙ্গেরি, জাপান, ফিনল্যান্ড, ওম্যানসহ অনেকগুলো দেশের প্যাভিলিয়ন। প্রতিটি প্যাভিলিয়নে উঠে এসেছে জলবায়ুর পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার পরিকল্পনা। 

ভেনিসের খালের পানি পরিশোধন করে তা দিয়ে বানানো কফি পরিবেশন করা হয় আরসেনালের ভেন্যুতে। অনেকের সাথে আমিও এই অভিনব প্রযুক্তি দিয়ে বানানো কফি উপভোগ করি।

এ বছর স্থাপত্য বিয়েন্নালের একটি ব্যতিক্রমী দিক হলো- বাংলাদেশের প্রভাব। ইতালীয় অধ্যাপক এলিজা বেরতুচ্ছো- বাংলাদেশের প্রতি তার ভালোবাসা ও গবেষণার স্মৃতি তুলে ধরেন। তিনি জানান, ইতালিতে এখন বহু প্রবাসী বাংলাদেশি কৃষিজমিতে লাউ, শিম, করলাসহ নানা দেশি সবজি চাষ করছেন, যা একসময় ছিল কেবল শখের ব্যাপার, এখন তা বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে। এলিজার এই গবেষণাভিত্তিক প্রজেক্ট বিয়েন্নালে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে।

আরসেনালের প্রধান ভেন্যুতে বাংলাদেশের স্থপতি মারিনা তাবাচ্চুমের একটি প্রজেক্ট সবার দৃষ্টি কেড়েছে। তার উপস্থাপনায় উঠে এসেছে জলবায়ুর বিপর্যয় মোকাবিলায় টেকসই, পরিবেশবান্ধব গৃহনির্মাণের সম্ভাবনা। বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবিলার বাস্তব অভিজ্ঞতা তার পরিকল্পনায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।


আরও খবর



বাঁধ নিয়ে থামেনি বিতর্ক বিরোধ দোষারোপ

প্রকাশিত:শনিবার ০৩ মে ২০২৫ | হালনাগাদ:বুধবার ১৪ মে ২০২৫ |

Image

ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে বেশিদিন ধরে অস্বস্তির কারণ হয়ে থেকেছে যে বিষয়টি, সেটি নিঃসন্দেহে ফারাক্কা বাঁধ। ভারতে এটির পোশাকি নাম ‘ফারাক্কা ব্যারাজ প্রজেক্ট’, এবং বহু আলোচনা ও বিতর্ক পেরিয়ে চলতি বছরের এই মে মাসে প্রকল্পটি পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করছে।

বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান অভিযোগ ছিল এই ফারাক্কার ফলেই প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে গেছে। অন্য দিকে ভারত বরাবর যুক্তি দিয়ে এসেছে কলকাতা বন্দরকে রক্ষা করার জন্য ফারাক্কা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না!

ফারাক্কা চালু হওয়ার দু’দশকেরও বেশি সময় পর ১৯৯৬-এ ভারত ও বাংলাদেশ যে ঐতিহাসিক গঙ্গা জলচুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে অবশ্য ভাগীরথী ও পদ্মায় গঙ্গার জল ভাগাভাগি নিয়ে একটা ফর্মুলায় দুই দেশ একমত হতে পেরেছিল।

তিরিশ বছর মেয়াদি সেই চুক্তির কার্যকালও প্রায় শেষের পথে, চুক্তির নবায়ন নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে। তবে ফারাক্কা নিয়ে বিতর্ক, বিরোধ বা দোষারোপের পালা কিন্তু কখনওই থামেনি।

তবে ফারাক্কার জন্যই পদ্মার দু’কূলে মানুষের জীবন-জীবিকা আজ বিপন্ন বলে যেমন বাংলাদেশের অভিযোগ – তেমনি ভারতেও কিন্তু ফারাক্কার সমালোচনা কম নয়।

যেমন মাত্র কয়েক বছর আগেই ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে দেওয়ারও দাবি তুলেছিল বিহার সরকার, যে রাজ্যটির অভিযোগ প্রতি বছর ফারাক্কার কারণেই তাদের বন্যায় ভুবতে হয়। ফারাক্কার উজানে ও ভাঁটিতে গঙ্গার ভাঙনও ওই এলাকার মানুষের জন্য খুব বড় সমস্যা।

তা ছাড়া অনেক বিশেষজ্ঞই মানেন কলকাতা বন্দরকেও সেভাবে বাঁচাতে পারেনি ফারাক্কা – যে কারণে উপকূলের কাছে তৈরি করতে হয়েছিল আর একটি স্যাটেলাইট বন্দর হলদিয়া।

তাহলে আজ ৫০ বছর পরে এসে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারত ঠিক কী ভাবছে? পাশাপাশি, ফারাক্কা প্রকল্পটাতেই বা তখন ঠিক কী করা হয়েছিল এবং সেগুলো কী ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করেছে?

ফারাক্কা ব্যারাজ প্রোজেক্ট বা এফবিপি-র সার্ধশর্তবর্ষপূর্তিতে সরেজমিনে ফারাক্কা ও আশেপাশের এলাকায় এবং কলকাতা বন্দরে গিয়ে ঠিক এই বিষয়গুলোতেই নজর দিয়েছে বিবিসি বাংলা – এই প্রতিবেদনে থাকছে তারই সারাংশ।

ফারাক্কা প্রকল্পটা আসলে ঠিক কী?

এক কথায় বলতে গেলে, ফারাক্কা হলো গঙ্গায় বাঁধ দিয়ে ও কৃত্রিম খাল কেটে পদ্মার দিক থেকে জলের প্রবাহ ভাগীরথীর দিকে সরিয়ে আনা – যাতে কলকাতা বন্দরকে বাঁচিয়ে রাখা যায়!

প্রকল্পের বর্তমান প্রধান, টেকনোক্র্যাট আর ডি দেশপান্ডের বলতে কোনো দ্বিধা নেই, ‘যে লক্ষ্য সামনে রেখে ফারাক্কা তৈরি করা হয়েছিল, আমরা জোর গলায় বলতে পারি সেটা পুরোপুরি সফল হয়েছে। কলকাতা বন্দর যে আজও টিঁকে আছে, তা ফারাক্কার জন্যই!’

আসলে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে নির্মিত এই প্রকল্পটির মূল লক্ষ্যই ছিল গঙ্গার প্রবাহ থেকে অতিরিক্ত জল ভাগীরথীতে সরিয়ে আনা ও তার মাধ্যমে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানো – যার জন্য কাটা হয়েছিল প্রায় ৪০ কিলোমিটার লম্বা একটি ‘লিঙ্ক ক্যানাল’ বা কৃত্রিম খাল।

ফারাক্কা ব্যারাজ প্রকল্পর সুন্দর সাজানো গোছানো টাউনশিপে নিজের বাতানুকূল অফিসঘরে বসে আর ডি দেশপান্ডে বিবিসিকে বলছিলেন, পদ্মা নয়, গঙ্গার মূল প্রবাহ আগে ভাগীরথী দিয়েই যেত – ফারাক্কা শুধু সেই ‘পুরনো ইতিহাস’কেই কিছুটা ফিরিয়ে এনেছে।

তিনি জানাচ্ছেন, ‘গঙ্গোত্রী থেকে উৎপন্ন হয়েছে যে পবিত্র গঙ্গা নদী, সাতশো বছর আগেও তার পুরো প্রবাহটা কিন্তু এখনকার ভাগীরথী-হুগলী দিয়েই যেত আর মোহনায় তা সাগরদ্বীপের কাছে গিয়ে মিশত – ওটাই গঙ্গার আসল মোহনা ছিল বলে সেই তীর্থের নাম হয়েছিল গঙ্গাসাগর।’

‘তখন পদ্মা ছিল গঙ্গার একটা ছোট শাখানদী। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে সেই প্রবাহ পদ্মার দিকে সরতে থাকে।’

‘ফলে ব্রিটিশ আমলে যখন দেখা গেল তাদের জাহাজ কলকাতা বন্দরে ন্যূনতম ড্রাফটও পাচ্ছে না, তখন ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার আর্থার কটন গঙ্গা থেকে সম্ভাব্য দুটো জায়গায় – রাজমহল বা ফারাক্কায় – খাল কেটে ভাগীরথীতে জল টানার প্রস্তাব দেন।’

ফারাক্কা থেকে খাল কাটলে দৈর্ঘ্য অনেক কম হবে বলে অবশেষে ফারাক্কাকেই এই কাজের জন্য বেছে নেওয়া হয়।

স্বাধীন ভারতে ১৯৬১ সালে অবশেষে সেই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, আর ১৯৭৫ সালে এসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ করেন ফারাক্কা ব্যারাজ।

প্রকল্পের কাজ অবশ্য তারও বছরকয়েক আগেই প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ফারাক্কার কমিশনিং পিছিয়ে দিয়েছিল বলে অনেকেই মানেন।

ফারাক্কার কাজ যখন শুরু হয়, তখন গঙ্গার ভাঁটিতে ছিল ‘শত্রু দেশ’ পূর্ব পাকিস্তান – কিন্তু রাতারাতি সেখানে একটি ‘বন্ধু দেশ’ চলে আসার ফলে ফারাক্কায় একতরফাভাবে গঙ্গা থেকে জল প্রত্যাহার ভারতের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছিল।

যদিও অবশেষে ১৯৭৫-এর গোড়ায় এসে ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসতে সক্ষম হন – ঠিক হয় এপ্রিল-মে মাসে প্রতি দশদিন অন্তর গঙ্গা থেকে পরীক্ষামূলকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ জল সরানো হবে। সেই ‘পরীক্ষা’ অবশ্য পরেও আরও বহু বছর ধরে চলতে থাকে।

সে বছরের মে মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে ফারাক্কার উদ্বোধন করেন দেশের সেচমন্ত্রী জগজীবন রাম, পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে যা কয়েক কোটি কিউসেক বাড়তি জল কলকাতায় এনে ফেলেছে!

ভূতাত্ত্বিক ও নদী গবেষক ড. পার্থসারথি চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘কলকাতা বন্দরে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত কিন্তু আমাদের নাব্যতা (নেভিগেবিলিটি) ছিল, ২৬ ফুট ড্রাফট ছিল। এবং তাতে ২৯১ দিন এই বন্দরে জাহাজ ঢুকত, মানে ওই ২৬ ফুট ড্রাফটের জাহাজ ঢুকত। ১৯৬০ সালের পর থেকে কিন্তু মারাত্মক অবস্থা হয়।’

‘এখন এই ফারাক্কা অঞ্চল কেন? ফারাক্কা অঞ্চলকে ব্যারাজ করার জন্য বাছা হলো, তার কারণ সেখানে একশো বছরের মধ্যে নদী নড়াচড়া করেনি, তার ব্যাঙ্কের মধ্যেই ছিল। এবং ওই ব্যারাজটা ওইখানে করলে, জলটা, ব্যারাজটার ঠিকমতো স্টেবিলিটি থাকবে।’

তিনি আরও জানাচ্ছেন, ফারাক্কায় এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, যাতে কলকাতায় সম্পূর্ণ ‘সিল্ট-ফ্রি’ বা পলিমুক্ত জল সরবরাহ করা যায়।

ড. পার্থসারথি চক্রবর্তী বলেন, তার জন্য ওখানে ‘ছাঁকনি’ দেওয়া আছে, যে কারণে ফারাক্কার জল কলকাতায় পানীয় জল হিসেবেও সাপ্লাই দেওয়া হয়।

ফলে ১০০০ মাইলেরও বেশি পথ পেরিয়ে উত্তর ভারতের ‘লাইফলাইন’ গঙ্গা ফারাক্কাতে এসে ব্যারাজের বাধায় বাঁধা পড়েছে – আর সেখানে মোট ১০৯টি লকগেটেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নদীর জলের প্রবাহ।

আর ফারাক্কাতে নদীর ডান দিক থেকে কাটা হয়েছে ৩৮.৩ কিলোমিটার লম্বা ভাগীরথী ফিডার ক্যানাল, যা জঙ্গীপুরের কাছে ভাগীরথীতে গিয়ে মিশেছে এবং পরে সেই নদী হুগলী নামে পরিচিতি পেয়েছে।

এককালের ছোট্ট গ্রাম ফারাক্কাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে একটি আধুনিক উপনগরী, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণপ্রান্তের মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগও স্থাপন করেছে ব্যারাজের ওপর দিয়ে তৈরি ট্রেনলাইন ও রাস্তা।

ক্যানালের জলে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে, এমন কী ইলিশও! ভারতে হলদিয়া থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ‘১ নম্বর জাতীয় জলপথে’রও অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই ক্যানাল।

আশির দশকে ফারাক্কাতে এনটিপিসি-র যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়, তারাও ব্যবহার করে এই ক্যানালের জল। ভাঁটির দিকে মুর্শিদাবাদের সাগরদীঘিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, তারাও এই জলের ওপর নির্ভরশীল।

সব মিলিয়ে ফারাক্কা শুধুমাত্র একটি বাঁধ ও খালই নয়, এই প্রকল্পকে ঘিরে গত পঞ্চাশ বছরে একটা বিরাট ক্যানভাসই আঁকা হয়ে গেছে বলা চলে – যাকে বিশেষজ্ঞরা ‘ফারাক্কা ইকোসিস্টেম’ নামে বর্ণনা করে থাকেন।

ফারাক্কা নিয়ে ভারতেও এতো বিতর্ক কেন?

ফারাক্কার প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে ভারতেও অনেক বিশেষজ্ঞ সন্দিহান ছিলেন। তবে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানোর যুক্তিটা এতটাই প্রবল ছিল যে সেই সব আপত্তি বিশেষ ধোপে টেঁকেনি।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ বিভাগের একজন শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশলী, কপিল ভট্টাচার্য তো ফারাক্কার বিরোধিতা করে সরকারি চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন।

ফারাক্কা প্রকল্প কেন বিপজ্জনক, তার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি অনেক লেখালেখিও করেছেন। পরবর্তী জীবনে কপিল ভট্টাচার্য অ্যাক্টিভিস্টে পরিণত হন, যুক্ত ছিলেন মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের সঙ্গেও।

১৯৮৯ সালে মি ভট্টাচার্যের মৃত্যুর ২৭ বছর পর, ২০১৬ সালে বিহারের রাজ্য সরকার ফারাক্কা বাঁধ ‘তুলে দেওয়ার জন্য’ কেন্দ্রের কাছে আনুষ্ঠানিক দাবি জানায়।

তখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করে যুক্তি দিয়েছিলেন, ফারাক্কার জন্যই তার রাজ্য প্রতি বছর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে – অতএব বাঁধটাই তুলে দেওয়া হোক!

নীতীশ কুমার তখন প্রকাশ্যেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘গঙ্গায় খুব বেশি পলি পড়ছে বলেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’

‘আর যখন থেকে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি হয়েছে তখন থেকেই এই অবস্থা। নইলে আগে নদীর প্রবাহের সঙ্গে অনেকটা পলি বঙ্গোপসাগরে চলে যেত, সমুদ্রে গিয়ে মিশত।’

দশ-বারো বছর ধরে ফারাক্কার ‘প্যাটার্ন’ স্টাডি করেই এ মন্তব্য করছেন, তখন এ কথাও জানিয়েছিলেন তিনি।

নীতীশ কুমার আজও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, তবে যে কোনো কারণেই হোক ফারাক্কা বিরোধিতার সুর তিনি অনেক স্তিমিত করে ফেলেছেন। এই মুহূর্তে তিনি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক সঙ্গীও।

তবে ফারাক্কার উজানে ঝাড়খন্ড-বিহারের সীমান্ত এলাকায় গিয়েও দেখেছি, সেখানে আমজনতারও এই বাঁধকে নিয়ে বিস্তর অভিযোগ - বর্ষাতে যেমন, তেমনি শুকনা মৌসুমেও!

বিহারের আহমদাবাদ গ্রামের বাসিন্দা ওয়াহিদ শেখের কথায়, ‘বর্ষার সময় ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়া উচিত, নইলে বিহারবাসীর খুব দুর্দশা! অথচ বর্ষার সময়ই গেট বন্ধ রাখে, নদী ওভারফ্লো করলে তখনই গিয়ে গেট খোলে – যখন বিহার ডুবে গেছে! বর্ষার মৌসুম এলেই যদি গেট খুলে দেয়, তাহলে বিহার একটু স্বস্তি পাবে!’

ঝাড়খন্ডের সাহেবগঞ্জ জেলায়, গঙ্গাতীরের লাধোপাড়া গ্রামের মিশির শেখ আবার বলছিলেন, রাজমহলের ওপারে গঙ্গা যদি দেখেন – গরমে নদী তো একদম শুকিয়ে যায়!

‘ছোট একটা নালার মতো গঙ্গা বইতে থাকে, বাকি পুরোটা শুকিয়ে যায়। এখন সব জল (বাংলাদেশে) ছেড়ে দিলে কোনো ফসলই হবে না, কিষাণ তো না খেয়ে মরবে!’

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায় ফারাক্কা অঞ্চলে বাঁধের প্রভাব নিয়ে ফিল্ড স্টাডি ও গবেষণা করেছেন – এ ব্যাপারে তারও মিশ্র অভিজ্ঞতা।

‘ফারাক্কায় নদীর বুকেও চর পড়েছে, মাঝনদীতে বক দাঁড়িয়ে আছে এটাও যেমন দেখেছি – তেমনি গঙ্গার বিধ্বংসী ভাঙনে পারের মানুষের জীবন ছারখার হয়ে যেতেও দেখেছি’, বলছিলেন তিনি।

সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, এই নদীর যে প্যাটার্নের চেঞ্জটা, ইটসেল্ফ নদীটার মধ্যে, তার দুই পারে সবটারই ওপরে একটা ইমপ্যাক্ট ফেলেছে ফারাক্কা ব্যারাজ। ডেফিনিটলি। তার পজিটিভগুলো আমরা পেয়েছি, নেগেটিভগুলোও আমরা দেখতে পাচ্ছি।

ফারাক্কাতে তার শেষ ফিল্ড স্টাডিতে স্থানীয় গ্রামবাসীরা ফারাক্কা বাঁধকে তুলনা করেছিলেন একটা সাপের মাথা চেপে ধরার সঙ্গে!

‘এমনিভাবে দেখাল যে, একটা সাপ রয়েছে তার মুখটা আপনি চেপে ধরলেন – মানে মাথাটা, তাহলে সে তো দেখবেন ছটফট করছে বেরোনোর জন্য।’

‘অ্যাজ ইফ ব্যারাজটা যেন একটা সাপের মুখটা চেপে ধরার মতো জিনিস – এবং নদী তখন, নদীর কোর্সটা তো পাল্টাচ্ছে – সে আর একভাবে যেতে পারছে না, সে যেহেতু রেস্ট্রিক্টেড, বাউন্ডেড ... তাই সে আরও বেশি করে ... প্যাটার্নটা, কার্ভসগুলো আরও বেশি হচ্ছে, ছটফট করার মতো ... ওরা সুন্দর একটা এক্সপ্ল্যানেশন দিয়েছিল’, জানাচ্ছেন তিনি।

ফারাক্কার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আবার জানাচ্ছেন, নদীর ভাঙন ঠেকাতে না-পারলে ফারাক্কা অচিরেই তাদের জন্য চরম সর্বনাশ ডেকে আনবে!

ফারাক্কা আসনের এমএলএ (বিধায়ক) মনিরুল ইসলাম বিবিসিকে বলছিলেন, ফারাক্কার জন্য আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাটা অবশ্যই ভালো হয়েছে। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের মেলবন্ধন এটা তৈরি করেছে ঠিক, কিন্তু আমাদের আপিল কি গঙ্গার ড্রেজিং-টা করে দিলে আমরা কিন্তু বিপদমুক্ত হব আর কী!

‘এই ড্রেজিং না করলে আগামী পঞ্চাশ বছর বলছেন কেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমরা নদীর গর্ভে চলে যাব। তো আমাদের কাছে ব্যারাজ একরকম অভিশাপের কারণ হয়েও দাঁড়িয়ে গেছে আর কী!’

তিনি আরও বলছিলেন, মুর্শিদাবাদের মোরগ্রাম থেকে নিয়ে আপনার মালদা পর্যন্ত আমাদের এই ভৌগোলিক অবস্থানটা দেখবেন – আমরা একটা সরু রাস্তার ওপর বাস করছি। ওদিকে ঝাড়খন্ড, এদিকে নদী, বাংলাদেশ – এইটুকুনটা!

‘তাই আমাদের হাজার হাজার একর যে নদীর গর্ভে গিয়েছে, মাঝনদীটাকে যদি ড্রেজিং করে পাথর দিয়ে বেঁধে দেয় আর কী, তাহলে অনেক লোক ওখানে চাষবাস করে, বাড়িঘর করে থাকতে পারবে’, কেন্দ্রের কাছে দাবি জানান তিনি।

তবে ফারাক্কা নিয়ে এরকম অনেক বিতর্ক থাকলেও বাঁধ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে কাজ কিন্তু বিশেষ এগোয়নি!

ফারাক্কা বাঁধ ‘ডিকমিশন’ করতে নীতিশ কুমার প্রস্তাব দেওয়ার পর দেশের জলসম্পদ মন্ত্রণালয় কিন্তু একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করেছিল – যাতে কেন্দ্রের তরফে পাঁচজন আর বিহার সরকারের তরফে পাঁচজন সদস্য ছিলেন।

সেই কমিটিতে বিহারের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন দেশের সুপরিচিত নদী বিশেষজ্ঞ ও গবেষক হিমাংশু ঠক্কর।

হিমাংশু ঠক্কর বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব ছিল ফারাক্কা বিহারের ওপর ঠিক কী প্রভাব ফেলেছে, তা নিরূপণ করা’

‘কিন্তু ফারাক্কা হওয়ার আগে ও পরে নদীতে ড্রেইনেজ কনজেসশন কী, বন্যার তীব্রতা ও কত ঘন ঘন বন্যা হয়েছে, নদীর ধারণক্ষমতা কত, সে সব ব্যাপারে সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন আমাদের কোনো তথ্য-উপাত্তই দেয়নি, ফলে আমরাও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।’

তবে ফারাক্কার ‘বিরূপ প্রভাব’ যে গোটা এলাকায় পড়েছে তাতে হিমাংশু ঠক্করের কোনো সন্দেহ নেই, নীতিশ কুমারের প্রস্তাবেও যথেষ্ঠ যুক্তি ছিল বলে তিনি মনে করেন।

আগামী পঞ্চাশ বছরে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ কী?

ফারাক্কা থেকে টানা ফিডার ক্যানালে শুষ্ক মৌসুমে কতটা জল টানা যাবে, আর মূল নদী দিয়ে পদ্মায় কতটা জল ছাড়া হবে – ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তির মূল কথা কিন্তু সেটাই।

এখনকার চুক্তি বলছে, প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে – এই শুকনা মৌসুমের সময়টায় প্রথম দশদিন ক্যানাল আর পরের দশদিন করে পদ্মা অন্তত ৩৫০০০ কিউসেক পরিমাণ জল পাবেই (‘অ্যাশিওর্ড অ্যামাউন্ট’ বা প্রতিশ্রুত পরিমাণ)।

এই জলের প্রবাহ ঠিকঠাক যাচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য ব্যারাজ থেকে কয়েকশো মিটার দূরে ভাঁটির দিকে মনিটরিং স্টেশন-ও আছে, যেখানে ভারত ও বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা একসঙ্গে সার্বক্ষণিক অবস্থান করেন।

ঠিক একই ধরনের যৌথ মনিটরিং স্টেশন আছে বাংলাদেশের দিকে পদ্মার ওপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছেও।

এখন আগামী বছর (২০২৬) কোনো শর্তে সেই গঙ্গা চুক্তির নবায়ন হয় – বা আদৌ হয় কি না – যথারীতি তার ওপরও অনেকটা নির্ভর করছে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ।

এদিকে উজানের বিহারে কিংবা ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানিকচক-ধুলিয়ানে ফারাক্কাকে নিয়ে যতই বিতর্ক থাক, খোদ ফারাক্কা এলাকার গ্রামবাসীরা কিন্তু প্রকল্পের কারণে খুশি - তারা চান বাঁধের দীর্ঘায়ু।

ফারাক্কা উপনগরী লাগোয়া পলাশিগ্রামের বাসিন্দা তপন মিশ্র যেমন বলছিলেন, ‘অনেক কিছু থেকে সুবিধা হয়েছে। যেমন কৃষকরা জল পাচ্ছে, জেলেরা মাছ ধরে দুটো খেতে পাচ্ছে।’

‘এই বাঁধ হওয়াতে এখানে শহর তৈরি হয়েছে মোটামুটি ছোটমোট একটা, কেউ বিজনেস করে খাচ্ছে, কেউ চাকরি করে খাচ্ছে ... দূর দূর ঝাড়খন্ড-ফাড়খন্ড কোথায় বন্যা হচ্ছে ওটা তো ধরলে চলবে না! ভালো হয়েছে, খারাপ হয়নি!’

ফারাক্কা ব্রিজ হওয়ায় স্থানীয় মৎস্যজীবী খগেন প্রামাণিকের আবার খুব সুবিধা হয়েছে দূরদূরান্তে মাছের চালান পাঠাতে।

তিনি পাশ থেকে যোগ করেন, এই গঙ্গায় যে ব্রিজটা হওয়া, ব্রিজটা হওয়াতে কি উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দারুণ যোগাযোগ হয়ে গেছে – এইটা মেইন মেরুদন্ড হয়ে গেছে উত্তরবঙ্গের জন্য!

‘আগে এখানে সকালে নৌকাতে চাপলে দুপুর, বৈকালে গিয়ে পৌঁছাত ওপারে – সেই জিনিসটা এখন আর নেই!’

ফারাক্কার ‘হিউম্যান জিওগ্রাফি’ নিয়ে কাজ করেছেন যে গবেষকরা, তারা অবশ্য নিশ্চিত নন সাধারণ লোকের ভাবনা প্রকল্পে কতটা গুরুত্ব পেয়েছে।

সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলছিলেন, ‘আমার রেজিলিয়েন্স বিল্ডিংয়ের মধ্যে যদি আমি মানুষের মতামত, তাদের চোখে দেখা বা তাদের এক্সপেরিয়েন্স – কীভাবে তারা দেখছে নদীটাকে, সেটা যদি আমরা না ধরতে পারি, তাহলে কিন্তু একটা গ্যাপ রয়ে গেল।’

‘আর যেটা আপনি বলছেন যে পঞ্চাশ বছর পরে কী হবে, এই গ্যাপটা কিন্তু আগাগোড়া রয়েই গেছে। আমরা কিন্তু কখনও দেখছি না এই রেজিলিয়েন্স বিল্ডিংয়ের মধ্যে মানুষকে ইনভলভ করা হচ্ছে বা কমিউনিটিগুলোকে ইনভলভ করা হচ্ছে।’

তিনি আরও মনে করেন, ফারাক্কাকে ঘিরে যে প্রযুক্তিগত সমাধানগুলো ভাবা হয়েছে - কত বছর তার মেয়াদ, বা তার পরে কী হবে – এগুলো নিয়ে একটা অস্পষ্টতা আছেই, আর সেখানে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের সঙ্গে প্রোজেক্টের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

‘কারণ এটা একটা শক্তিশালী নদী, সেটাও তো আমাদের মেনে নিতে হবে যে তার একটা ন্যাচারাল প্রসেস বা স্বাভাবিক গতি ও ছন্দ আছে! সেটা গ্রামের মানুষ যেভাবে বুঝছে আমরা বুঝছি না’, বলছিলেন সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায়।

আবার এই প্রেক্ষাপটেই কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করেন, বাঁধটা কিন্তু বর্তমান আকারে আর না রাখলেও চলে!

হিমাংশু ঠক্কর বিবিসিকে বলছিলেন, আমেরিকা, ইউরোপ ও সারা দুনিয়া জুড়ে অজস্র বাঁধের ডিকমিশনিং হচ্ছে – শুধু আমেরিকাতেই গত ৩০ বছরে ২০০০রও বেশি ড্যাম ডিকমিশন করা হয়েছে, ইউরোপেও হয়েছে শত শত।

‘তবে এটাও ঠিক, গঙ্গার মতো বিশাল একটা নদীতে কোনো ড্যাম ডিকমিশন করার পূর্ব অভিজ্ঞতা কিন্তু তেমন নেই। তবে তার পরেও কাজটা খুবই সম্ভব – আর নানাভাবেই এই ডিকমিশনিং করা যায়।’

এখানে তিনি প্রস্তাব দিচ্ছেন ‘অপারেশনাল ডিকমিশনিং’-এর, অর্থাৎ ব্যারাজের ওপরে ট্রান্সপোর্ট লিঙ্কটা রেখে গেটগুলো সব খুলে রাখার বা তুলে দেওয়ার, যাতে রেল ও সড়ক সংযোগ রেখেও নদীকে স্বাভাবিকভাবে বইতে দেওয়া যায়।

‘পাশাপাশি ক্যানালটা এখন যে সুবিধাগুলো দিচ্ছে, সেটা কীভাবে বজায় রাখা যায় তাও দেখতে হবে। এতে কী হবে, ড্যামের মূল কাঠামোটা অক্ষত রেখেও ফারাক্কার অপারেশনাল ডিকমিশনিং করা যাবে’, বলছিলেন হিমাংশু ঠক্কর।

আবার এর একদম উল্টো মতবাদটা হল – কলকাতার স্বার্থেই ফারাক্কাকে যেভাবে হোক বর্তমান আকারেই রক্ষা করতে হবে!

এই মতে বিশ্বাসী ড. পার্থসারথি চক্রবর্তীর কথায়, কলকাতা নদীবন্দরকে বাঁচাতেই হবে। কারণ কলকাতা নদীবন্দর শুধু কলকাতা কলকাতা বললে হবে না, সমগ্র পূর্ব ভারত এবং নর্থ-ইস্টার্ন রিজিওন – তার একটাই পোর্ট ভারতবর্ষের বলতে গেলে, আমাদের কলকাতা বন্দর। সেখানে কোনও কম্প্রোমাইজ নেই।

‘এর জন্য ফারাক্কা ব্যারাজটাকে যেভাবে হোক রেনোভেট করতে হবে, ইঞ্জিনিয়ারিং স্ট্রাকচার কীভাবে রেনোভেট করবে সেটা পুরোপুরি প্রকৌশলীদের ওপর।’

‘আমার নদীটা তো আছে, নদীর খাত আছে ... আর আপনারা যেটা ভাবেন নদীর পার ভাঙছে, সব নদীরই পার ভাঙে! আমি নদীর ধারে থাকবো কেন? নদীর ধারে একটা বাফার থাকবে তো, সেই বাফার জোনটা দিয়ে রাখতে হবে’, যুক্তি দিচ্ছেন তিনি।

এটা ঠিকই, পৃথিবীতে কোনো নদীবাঁধের আয়ুই অনন্তকাল নয় - কখনও তিরিশ, কখনও চল্লিশ বা কখনও আশি বছর পর একটি ব্যারাজ ডিকমিশনিং করা বা তুলে দেওয়ার বহু নজির নানা দেশে আছে।

ফারাক্কার ক্ষেত্রে ঠিক কী করা হবে আর কখন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের – কিন্তু সেই লক্ষ্যে নির্দিষ্ট ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে বলে এখনও কোনো প্রমাণ নেই।

ফারাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ কিন্তু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, এই প্রকল্পের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ের কোনো কারণই নেই।

ফারাক্কা ব্যারাজ প্রকল্পের মহাপরিচালক আর ডি দেশপান্ডে বিবিসিকে বলছিলেন, ‘দেখুন, এটা তো শুধু একটা ডাইভারশান বা জল টানার প্রকল্প, এখানে কিন্তু তেমন স্টোরেজ বা জলাধার কিছু নেই।’

‘স্টোরেজ প্রকল্পগুলোর আয়ু হয়তো একশো বছর হয়, কারণ পলি পড়ে তার ধারণক্ষমতা পূর্ণ হয়ে যায়। ফারাক্কায় সে সমস্যা নেই, ফলে এটা অনায়াসে একশো বছরেরও বেশি টিঁকতে পারে।’

তবে তিনি স্বীকার করেন ফিডার ক্যানালের বেড (খাত) আর দু’পারের ক্ষয় ও ভাঙন একটা বড় সমস্যা, যেটা হয়তো 'ক্রস রেগুলেটরে'র মতো কিছু বসিয়ে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই মোকাবিলা করতে হবে।

‘কিন্তু ফারাক্কা বাঁচবেই, বাঁচাতেই হবে – কারণ কলকাতা শহর, কলকাতা বন্দর আর গত পঞ্চাশ বছরে নদীকে ঘিরে যে ইকোসিস্টেম তৈরি হয়ে গেছে তাকে রক্ষা করতে হলে ফারাক্কাই একমাত্র ভরসা’, খুব আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গীতে বলেন প্রকল্পের প্রধান।

ফলে ফারাক্কা নিয়ে আগামী দিনে কী করা উচিত, সে সম্বন্ধে ভারতেও নানা ধরনের মতামত আছে।

ফারাক্কার ভবিষ্যত ঠিক কোন পথে, তা এখনও কারও জানা নেই, কিন্তু এটা বলা যায়, ফারাক্কাকে নিয়ে বিতর্ক বোধহয় পরের ৫০ বছর ধরেও চলবে! সূত্র: বিবিসি বাংলা


আরও খবর



কখন কীভাবে দই খাবেন

প্রকাশিত:সোমবার ২১ এপ্রিল ২০২৫ | হালনাগাদ:বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫ |

Image

তাপমাত্রা বেড়েই চলছে। এই গরমে পানিশূন্যতা একটি বড় সমস্যা। পানিশূন্যতা থেকে ক্লান্তি ও অবসন্ন ভাব হয়। আমরা বিভিন্ন পানীয় খেয়ে সেই পানিশূন্যতা দূর করার চেষ্টা করি। এর মধ্যে রয়েছে তরমুজ, শসা, ডাবের পানি, কমলা, পানিসমৃদ্ধ সবজি ইত্যাদি। এগুলো শরীরকে ঠান্ডা রাখে। তবে এগুলো ছাড়াও গরমের সময় দই খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে।

দই খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্যও খুবই ভাল, তবে গরমে এটি খাওয়ার সঠিক উপায় জানাটাও কিন্তু জরুরি। তবে দই খাওয়ার সঠিক নিয়ম নির্ভর করে আপনার স্বাস্থ্য, অভ্যাস এবং খাওয়ার উদ্দেশ্যের ওপর। তবে সাধারণভাবে কিছু নিয়ম অনুসরণ করলে দই থেকে সর্বোচ্চ পুষ্টিগুণ পাওয়া সম্ভব।

কীভাবে দই খাবেন?

– দই খাওয়ার আগে এতে সামান্য পানি মেশাতে হবে, কারণ দইয়ের প্রকৃতি গরম, এমন অবস্থায় পানি যোগ করলে ভারসাম্য তৈরি হয় এবং দই ক্ষতিকর না হয়ে উপকারী হয়।

– চিনি বা জিরার গুঁড়া ইত্যাদি মিশিয়ে অনেকে দই খেতে পছন্দ করলেও বেশিরভাগ মানুষ শুধু লবণ দিয়ে দই খাওয়া পছন্দ করেন। কিন্তু, লবণ দিয়ে দই খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

– কেউ যদি দই খেতে পছন্দ করেন, তাহলে দইয়ের সঙ্গে চিনি, আমলকির গুঁড়ো, মধু ইত্যাদি মিশিয়ে খেতে পারেন। এটি শরীরকে বিভিন্ন পুষ্টি সরবরাহ করে।

– দই কখনোই গরম খাওয়া উচিত নয়। এটি শরীরের জন্য বেশ বিপজ্জনক হতে পারে। দই গরম খাবারের সঙ্গে খেলেও এর প্রোবায়োটিক নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

– সরাসরি দই খাওয়া উচিত নয়। এতে অনেক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। এতে ত্বকের সমস্যা, পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা এবং শরীরে তাপ বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই যখনই দই খাবেন, তাতে হালকা পানি মেশাতে হবে। মনে রাখবেন দইয়ে একেবারেই লবণ দেওয়া যাবে না।

কখন দই খাবেন?

ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসক ডা. নেহা গয়াল বলেন, শুধুমাত্র দিনের বেলা দই খাওয়া উচিত। কারণ রাতে দই খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

দই খাওয়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে। দই খেলে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদি থেকে পুষ্টি পাওয়া যায়। এটি মস্তিষ্ককে শক্তি দেয়। এটি শরীরের পেশিকে শক্তি দেয় এবং হাড়কে শক্তিশালী করে।


আরও খবর