
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য
বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ০২ অক্টোবর তার বিদেশে
চিকিৎসার আবেদন নাকচ করে আইন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিদেশ যেতে হলে খালেদা
জিয়াকে জেলে গিয়ে আবার আদালতে আবেদন করতে হবে। কিন্তু বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য
আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের দাবি,
সরকার চাইলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দিয়ে
বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে পারে।
এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে আইনি প্রক্রিয়ার কথা বলা
হলেও খালেদা জিয়ার আবেদন বাতিল হওয়ার পেছনে অন্য কারণের কথা বলছে বিএনপি। দলটির
যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দাবি করেছেন, শেখ
হাসিনা সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্ত না মানায় খালেদা
জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার বিষয়ে
কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছিল। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কথাবার্তা বলে
তার পরিবার আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। তাদের ধারণা ছিল, শারীরিক অবস্থা বিবেচনায়
সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীকে এবার বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতে পারে। সরকারের তরফ
থেকেও ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছিল, খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত
চিকিৎসার জন্য করা পরিবারের আবেদন ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত
সেই আবেদন নাকচ করে আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিদেশে
যেতে হলে খালেদা জিয়াকে জেলে গিয়ে আবার আদালতে আবেদন করতে হবে।
রবিবার (০১ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর বিচার প্রশিক্ষণ
ইনস্টিটিউটে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এর আগে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার
ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মতামত দিয়েছেন, তা-ই আইনের অবস্থান এবং
সেটিই সঠিক।
পরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত আইনি
ব্যাখ্যা তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘প্রথম যে আবেদনটি ছিল, যা ২০২০ সালের মার্চে
নিষ্পত্তি হয়। সেই আবেদনে বলা ছিল, খালেদা জিয়া অত্যন্ত
অসুস্থ, তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে তার সুচিকিৎসার
ব্যবস্থা যেন করা হয়। তখন দুটি শর্তে তার দণ্ডাদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে তাকে
মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এটি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা-১-এর ক্ষমতাবলে দেওয়া
হয়েছিল। শর্তগুলো হলো প্রথমত, তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা
নেবেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। সেই শর্তগুলো
মেনে খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্ত হন এবং বাসায় ফিরে যান। সেভাবেই সেই দরখাস্ত
নিষ্পত্তি করা হয়। তবে প্রতি ছয় মাস বৃদ্ধি করা যাবে কি না, বিষয়টি
উন্মুক্ত ছিল। এরপর সেই সময়সীমা ছয় মাস করে মোট আটবার বাড়ানো হয়েছে।
চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার বিদেশে যেতে আইনে কেন সুযোগ নেই, সেই ব্যাখ্যা তুলে ধরে
আইনমন্ত্রী বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় কোনো দরখাস্ত
যদি একবার নিষ্পত্তি করা হয়, সেই নিষ্পত্তি করা দরখাস্ত
পুনর্বিবেচনা করার অবকাশ আইনে থাকে না। আমরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা ১,
২, ৩, ৪, ৫ এবং সর্বশেষ উপধারা ৬ ব্যাখ্যা করে মতামত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে
দিয়েছি। সেই মতামত হচ্ছে, ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে যে দরখাস্ত
নিষ্পত্তি করা হয়েছে, সেটি অতীত ও শেষ হয়ে গেছে। এটি আর খোলার
কোনো উপায় নেই।
এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার পরিবার তাকে বিদেশে পাঠাতে চাইলে
তাদের করণীয় সম্পর্কে জানতে জান একজন সাংবাদিক। জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, তাকে ফৌজদারি ৪০১ ধারায় দুটি
শর্তযুক্তভাবে যে আদেশবলে সাজা স্থগিত রেখে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি বাতিল করে তারপর আবার ফের বিবেচনা করার সুযোগ থাকলে তা করা হবে।
এর আগে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক
সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে
নিয়ে চিকিৎসা করাতে হলে তাকে আদালতে গিয়ে আবেদন করতে হবে। আদালত যদি অনুমতি দেন,
তাহলে তিনি বিদেশে যেতে পারবেন।
প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের বিষয়ে আইনমন্ত্রীর কাছে
সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপমহাদেশে ৪০১ ধারার ক্ষমতা যখন সরকার
প্রয়োগ করে, তখন সেটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না বলে
সিদ্ধান্ত আছে। প্রধানমন্ত্রী যেটা বলেছেন, সেটি হচ্ছে এখন
যে আদেশ আছে, যদি সেটি বাতিল করে তাকে আবার কারাগারে নেওয়া
হয়, তাহলে আদালতে যেতে পারেন। এ অবস্থায় তিনি আদালতে যেতে
পারেন বলে এ রকম সুযোগ নেই।
এরপর একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, তাহলে সেই আদেশ বাতিল করা
হবে কি না? জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বাতিল
করাটা অমানবিক হবে, বাতিল করব না।
খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন বাতিল হওয়ার পর গতকাল
রাতে কিশোরগঞ্জে বিএনপির রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ
মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দাবি করেন, খালেদা জিয়াকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল—তিনি যদি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, তাহলে বিএনপিকে আগামী জাতীয়
নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি থেকে উত্তর দেওয়ার আগেই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে
খালেদা জিয়া তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, তার জীবনে
গণতন্ত্রের জন্য কোনো শর্ত নেই। ভোটের অধিকারের জন্য, এই
দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো শর্ত নেই। কোনো শর্ত খালেদা জিয়ার নামের সঙ্গে যায়
না এবং আমরাও তা মানি না।
এদিকে চিকিৎসার জন্য ‘অসুস্থ’ খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে না দেওয়ার সরকারি
এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ বলে মনে করছে বিএনপি। খালেদা জিয়ার
আইনজীবীদের অভিযোগ, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিদেশে চিকিৎসার
অনুমতি চেয়ে করা আবেদন আইনগতভাবে বিবেচনা না করে রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তের
মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়েছে, দেশে আইনের শাসন নেই। এর
মাধ্যমে খালেদা জিয়ার প্রতি এক ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১
ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, সরকার চাইলেই নির্বাহী আদেশে
তাকে মুক্তি দিতে পারত এবং বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে পারত।
জানা গেছে, খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে পরিবারের করা
আবেদন নাকচ হওয়ায় একদফা দাবিতে চলমান আন্দোলনে এই ইস্যুকে জোরালোভাবে সম্পৃক্ত
করবে বিএনপি। একদফা দাবি আদায়ে জোটগত কর্মসূচির পাশাপাশি খালেদা জিয়ার মুক্তি ও
তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে দলীয়ভাবে কর্মসূচি দেওয়া হতে
পারে। আজ সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা
জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার ব্যাপারে সরকার নতুন করে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে
তাতে দেখা যায়, আন্দোলনের মাধ্যমে সুরাহার পথ বের করতে হবে।
তিনি বলেন, এর আগে কারাবন্দি থাকা অবস্থায় আ স ম আবদুর
রব এবং প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন কেন
পাবেন না? খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে সরকার যা করছে তাতে মনে
হয়, তাদের কাছে আইন ও বিধিবিধান কিছুই নয়। সরকার
পরিকল্পিতভাবে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নেত্রীর যদি কিছু হয়,
তাহলে এর দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।
এর আগে গত ২৫ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম
ইস্কান্দার বোনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ আবেদন মতামতের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে
পাঠায়।
লিভার জটিলতা ছাড়াও ৭৮ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা
জিয়ার ফুসফুস,
কিডনি, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ
বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। গত ৯ আগস্ট গুলশানের বাসা ফিরোজায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে
মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাকে বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৫৩
দিন ধরে তিনি ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বর্তমানে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ)
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি
মেডিকেল বোর্ড তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ
হোসেন বলেছেন,
বোর্ডের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, উনার লিভার
প্রতিস্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। সেজন্য তাকে দ্রুত বিদেশে উন্নত মাল্টিডিসিপ্লিনারি
সেন্টারে পাঠানো দরকার।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির
মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। দুই বছরের
বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন তিনি। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৫
মার্চ নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে সরকার তাকে শর্তসাপেক্ষে কারামুক্তি দেয়।
এরপর পরিবারের আবেদনে ছয় মাস পরপর তার মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে সরকার। সর্বশেষ গত
১২ সেপ্টেম্বর এই মেয়াদ আরও ছয় মাসের জন্য বাড়ানো হয়।