ইয়াশফি রহমান : স্বপ্নের আল বায়াত স্টেডিয়ামে হবে স্বপ্নযাত্রার সূচনা। আজ রাত ৮টা। হয়তো থেমে যাবে সব ব্যস্ততা। চোখ জোড়া লেপ্টে যাবে ওই টিভি সেটের সামনে। কাতার মহাযজ্ঞের শুরুটা হবে যেখানে। কৌতূহলের তুঙ্গে তাই কী থাকবে বিশ্বকাপের উদ্বোধনীতে।
কাতারের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে থাকবে বিশেষে প্রদর্শনী। উঠে আসবে মরুর বুকে কীভাবে ফুটল ফুল। বিশাল সব ইমারতের পেছনের গল্প। বিশ্বকাপের ইতিহাসও পাবে প্রাধান্য। এরপর সুরের মূর্ছনায় হারিয়ে যাওয়ার পালা। ২২তম আসরের অফিশিয়াল থিম সং ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ইউরস টু টেক’ গাইবেন লিও বেবি। তার সঙ্গে বিশেষ পারফর্ম করবেন বলিউড হার্ডথ্রুব নোরা ফাতেহি। নোরার সঙ্গে থাকবেন মানাল ও রেহমা।
জোর গুঞ্জন আছে গাইবেন শাকিরা আর কিজ ড্যানিয়েলও। কিন্তু বিষয়টি এখন পর্যন্ত রহস্যই রেখে দিয়েছেন আয়োজকরা। তবে কোরিয়ার বিখ্যাত ব্যান্ড বিটিএসের গান, তৈরি করবে ভিন্ন আবহ। যেখানে চমক বিটিএসের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য জাংকুক। যিনি অংশ হতে যাচ্ছেন এই সাউন্ডট্র্যাকের। এ ছাড়াও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখা যেতে পারে পপগায়িকা দুয়া লিপা, ব্ল্যাক আইড পিস, জে বালভিন ও নাইজেরিয়ার সংগীতশিল্পী প্যাট্রিক নায়েমেকা ওকোরিকে। স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনাও পাবে বিশেষ স্থান। উদ্বোধন অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে প্রদর্শন করা হবে বিশ্বকাপের অফিশিয়াল মাসকট লা’ইব। আরবি যার অর্থ অতি দক্ষ খেলোয়াড়। এরপর শুরু হবে আতশবাজির ঝলকানি। আর এরই মধ্যে শেষ হবে জমকালো আয়োজন। স্টেডিয়ামে সরাসরি যা উপভোগ করবেন ৬০ হাজার দর্শক। এরপরই ইকুয়েডর-কাতার ম্যাচের রোমাঞ্চ।
২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ ইতিহাসে ২২তম বিশ্ব ফুটবলের আসর। আজ থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাতারে অনুষ্ঠিত হবে এই বিশ্ব ফুটবলের মহারণ। এই প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে ও এশিয়ায় দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজিত হতে যাচ্ছে। এর আগে ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছিল। এবারই শেষবারের মতো ৩২টি দেশের অংশগ্রহণে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে। ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডায় আয়োজিত টুর্নামেন্টে ৪৮টি দেশ অংশ নেবে।
২০০৯ সালে জানুয়ারিতে ২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক হতে আগ্রহীদের বিডিং প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৮ টুর্নামেন্ট আয়োজনের গ্যারান্টি পাওয়ার পর ২০২২ বিশ্বকাপের বিডিং থেকে সব ইউরোপিয়ান দেশ তাদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। শেষ পর্যন্ত ২০২২ বিশ্বকাপের জন্য পাঁচটি বিড টিকে ছিল : অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কাতার, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। ২২ সদস্যের ফিফা কার্যনির্বাহী কমিটি ২০১০ সালের ২ ডিসেম্বর ভোটের মাধ্যমে উভয় টুর্নামেন্টের আয়োজক দেশ বেছে নেয়।
কাতারের প্রচন্ড গরমের কথা বিবেচনা করে প্রথমবারের মতো জুন-জুলাই থেকে সরিয়ে টুর্নামেন্ট নভেম্বর-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একই সঙ্গে টুর্নামেন্টে পরিধি কমিয়ে এনে ২৯ দিনে শেষ করা হচ্ছে। আগামী ১৮ ডিসেম্বর কাতারের জাতীয় দিবসে টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। চার বছর আগে রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ফ্রান্স।
বিশ্বকাপের স্বত্ব পাওয়ার পর থেকেই পুরো কাতারজুড়ে আটটি নতুন স্টেডিয়াম তারা নির্মাণ করেছে। নির্মাণকৃত স্টেডিয়ামগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়াম। দোহার ১৫ কিলোমিটার উত্তরে ২ লাখ জনসংখ্যার পরিকল্পিত একটি শহর লুসাইল। সেখানেই গড়ে তোলা হয়েছে ৮০ হাজার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন লুসাইল স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামে আগামী ১৮ ডিসেম্বর টুর্নামেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে। আজ কাতার বনাম ইকুয়েডরের মধ্যকার উদ্বোধনী ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে আল-খোরের আল-বায়াত স্টেডিয়ামে। এ ছাড়া অন্যান্য ভেন্যু হলো : এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম, আহমাদ বিন আলি স্টেডিয়াম, খালিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম, আল থুমামা স্টেডিয়াম, স্টেডিয়াম ৯৭৪ এবং আল-জানুব স্টেডিয়াম।
কাতার বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া ৩২ দেশের মধ্যে ২৪টি দেশই চার বছর আগে রাশিয়ায় খেলেছে। ১৯৩৪ সালে ইতালির পর আয়োজক দেশ হিসেবে একমাত্র কাতার প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে। নেদারল্যান্ডস, ইকুয়েডর, ঘানা ও ক্যামেরুন রাশিয়ায় খেলতে ব্যর্থ হওয়ার পর আবারও বিশ্বমঞ্চে ফিরেছে। ১৯৮৬ সালে একমাত্র বিশ্বকাপ খেলা কানাডা ৩৬ বছর পর ফিরে এসেছে। অন্যদিকে ইউরোপিয়ান দল হিসেবে ১৯৫৮ সালের ৬৪ বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে ওয়েলস। ফিফা বিশ্ব র্যাংকিংয়ের শীর্ষ ১০ দলের মধ্যে একমাত্র বাদ পড়েছে ষষ্ঠ স্থানে থাকা ইতালি। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে খেলতে ব্যর্থ হলো আজ্জুররিা। সর্বনিম্ন ৬১তম র্যাংকে থেকে মাঠে নামবে ঘানা।
৩২ দেশ আটটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রথম পর্বে লড়াই করবে। ২০ নভেম্বর-২ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে গ্রুপ পর্বের খেলা। প্রতিটি গ্রুপ থেকে শীর্ষ দুটি দল নকআউট পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। ৩-৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত শেষ ১৬ এবং ৯-১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত হবে কোয়ার্টার ফাইনালের খেলা। ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর হবে দুটি সেমিফাইনাল। ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ। ১৮ ডিসেম্বর হবে বহুল প্রতীক্ষিত ফাইনাল। প্রখ্যাত ক্রীড়াসামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাসের সঙ্গে ফিফার সম্পর্কটা বেশ পুরোনো। ১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বকাপের প্রতি আসরের জন্য বল প্রস্তুত করে আসছে এই প্রতিষ্ঠান।
এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। গত মার্চে কাতার বিশ্বকাপের জন্য তৈরি বলটি উন্মোচন করে ফিফা। যার নাম ‘আল রিহলা’। আরবি ভাষায় শব্দটির অর্থ ভ্রমণ। কাতারের পতাকা, ঐতিহ্যবাহী নৌকা, স্থাপত্য ও সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তৈরি করা হয়েছে বলটি। যেখানে ২০টি প্যানেলের ডিজাইন ব্যবহার করেছে অ্যাডিডাস। প্যানেলগুলো ত্রিভুজাকৃতির। যা মধ্যপ্রাচ্যের ‘ধো’ নৌকাকে মনে করিয়ে দেয়। প্যানেলের দুই দিক বিভিন্ন রঙে, যা কাতারের পতাকা ও আরবের ঐতিহ্যবাহী সাদা পোশাককে ফুটিয়ে তুলেছে।
দল গুলো কাড়ি কাড়ি ডলার খরচ করা কাতার নেমেছে হিসেব কষেই। আট স্টেডিয়ামে ফুটবল তারকাদের পায়ের জাদুতে বুঁদ হয়ে থাকবেন সমর্থকরা। ফিফা জানিয়েছে, মোট তিন মিলিয়ন টিকিট বিক্রি করেছে। শুধু টিকিট বিক্রি থেকেই ফিফা রেকর্ড রেভেনিউ পেতে পারে। রাশিয়া বিশ্বকাপে টিকিট বিক্রি থেকে ফিফার আয় ছিল ৫.৪ বিলিয়ন ডলার। এবার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলেই রিপোর্টে এসেছে। এর পেছনে কারণ, ম্যাচ টিকিটের দাম বৃদ্ধি। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের বিশ্বকাপে চোখ রাখবে বিশ্বের প্রায় ৫০০ কোটি মানুষ।