শহিদুল ইসলাম জি এম মিঠন, স্টাফ রিপোর্টার :
শস্য-ভান্ডার নামে সারা দেশে পরিচিত উত্তরাঞ্চল এর নওগাঁ জেলার ১১ টি উপজেলায় এবার ইরি-বোরো ধান উৎপাদন (চাষে) খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে বলেই জানিয়েছেন কৃষকরা। ধান চাষি কৃষকরা বলছেন, বিগত ধান চাষের মৌসম থেকে এবার চলতি ইরি-বোরো ধান চাষে দ্বিগুণ খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে দিন মজুর ও ধানের চারা রোপন কাজের শ্রমিকের মূল্য যেমন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ তেমনি বাজারে ডিজেল এর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জমি চাষের খরচও বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ, এছাড়া সার এর মূল্য কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও বেড়েছে পানি সেচ মূল্য, বীজ, কীটনাশক সহ কৃষি শ্রমিকের মজুরি। যার ফলে বিগত বছরের থেকে এবার প্রতি বিঘা ইরি-বোরো ধান চাষে ৪-৫ হাজার টাকা বেশি খরচ হচ্ছে বলেই জানিয়েছেন কৃষকরা। একই সাথে কৃষকরা জানিয়েছেন, ধান - কাটা মাড়াই এর শুরু থেকেই বাজারে প্রতি মণ ধান সর্বনিন্ম ১৫-১৬ শ’ টাকা দরে যদি বিক্রি করতে পারেন, সেক্ষেত্রে তারা কিছুটা লাভমান হতে পারেন। এরনিচে কম মূল্যে বিক্রি করলে কৃষকরা লোকসানের মুখে পড়বেন।
তবে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বর্গাচাষিরা। ইউরিয়া সার, শ্রমিক, চাষের খরচ সহ পানি সেচ বাবদ খরচ বেড়ে যাওয়ায় জেলায় এবার গত বছরের চেয়ে ৮৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে করতে হচ্ছে কৃষকদের।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে নওগাঁ জেলার সদর, মহাদেবপুর, পত্নীতলা, ধামইরহাট, সাপাহার, নিয়ামতপুর, মান্দা, বদলগাছী, রাণীনগর ও আত্রাই উপজেলায় মোট ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭শ' ৫৫ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ পরিমাণ জমিতে ধান চাষে পানি সেচ ও সার বাবদ খরচ হবে ২৯৭ কোটি ৮৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। গত বছর এক লাখ ৮৯ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদে সার ও সেচে খরচ হয়েছিল ২১৩ কোটি ১৭ লাখ ৬২ হাজার টাকা। চলতি বছর এ বাড়তি খরচ প্রান্তিক চাষি (কৃষকদের) জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষকরা সার, ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম সহনীয় পর্যায়ে এনে ধানের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণের দাবিও জানিয়েছেন কৃষকরা।
নওগাঁ জেলার পল্লী গ্রামের মাঠ গুলোতে এবার চিকন ধান জিরাশাইল, কাটারিভোগ, সম্পা কাটারি, ব্রি-২৮, ২৯, ৮১, ৮৬, ৮৮, ৮৯, ৯০, ৯২ ও বঙ্গবন্ধু-১০০ জাতের ধানের আবাদ হয়েছে। নওগাঁর বিভিন্ন উপজেলার মাঠ ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ যেন সবুজ চাদরে ঢাকা। ইরি-বোরো ধানের ক্ষেতে সবুজের সমারোহ নজর কাড়ব যে কারো মনে। ইরি-বোরো ধান ক্ষেত পরিচর্যায় কৃষকরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন।
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার নওহাটামোড় চৌমাশিয়া গ্রামের কৃষক সাজ্জাদ হোসেন মন্ডল, খোর্দ্দনারায়নপুর গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বাবু সহ বেশ কয়েক জন কৃষক জানান, বিগত বছরের চেয়ে এবার ইরি-বোরো ধান চাষে খরচ অনেক বেড়েছে। তারা বলেন, শ্রমিকের খরচ, পানি সেচ খরচ ও ডিজেল এর মূল্য রাড়ানোর ফলে জমি চাষ খরচ সহ কিটনাশকের মূল্যও ব্যাপক বৃদ্ধি হওয়ায় চলতি ইরিবোরো ধান চাষে বিঘা প্রতি ৪-৫ হাজার টাকা খরচ বৃদ্ধি হয়েছে, এজন্য বাজারে ধানের মূল্য ও বাড়ানোর দাবি করেন কৃষকরা। অপরদিকে আত্রাই উপজেলার দমদমা গ্রামের পোস্ট মাস্টার আব্দুল লতিফ চাকরির পাশাপাশি কৃষি কাজও করেন। এবার তিনি সারে ৪ বিঘা জমিতে ইরো বোরো ধান লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে কীটনাশকের দাম, জমি চাষ, ধানের চারা লাগানো, নিড়ানিসহ বিভিন্ন খরচ গত বছরের চেয়ে এবার বিঘাপ্রতি ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা বেড়েছে। প্রতি মণ ধান ১৫শ' টাকা থেকে ১৬' টাকায় বিক্রি করা না গেলে ধানে লোকসান গুণতে হবে।
বদলগাছী উপজেলার চাংলা গ্রামের কৃসক ওয়াহেদ আলী এবার সারে ৬ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ইরি বোরো ধান রোপণ করেছেন। তিনি বলেন, গতবছর ধানের চারা রোপণ ৭০০-৮০০ টাকা বিঘা হিসেবে শ্রমিকের মজুরি ছিল। এবার তা বেড়ে ১৫০০ টাকা দ্বিগুণ হয়েছে। এছাড়া একজন শ্রমিক এক বেলা খাওয়া দিয়ে ৫০০ টাকা দিতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে এবার প্রতি বিঘা জমিতে ধান রোপণ থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত ১৬-১৭ হাজার টাকা খরচ হবে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ধান পাবো ২০ মণ। এর মধ্যে জমির মালিককে প্রতি বিঘাতে ৭ মণ করে ধান দিতে হবে। ৭ মন ধান দেওয়ার পর বিঘাতে ১৩ বা ১৪ মন ধান পাবো, তাহলে ধান চাষ করে কী লাভ হবে। এবার ধানের মন বিগত বছরের থেকে ৩০০-৪০০ টাকা বেশি না করা হলে আমরা ক্ষতির মুখে পড়বো।
রানীনগর উপজেলার মিরাট গ্রামের ধান চাষি কৃষক শুকবর আলী বলেন, এবছর ধার-দেনা করে ৭ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি। গত বছরের তুলনায় এবার প্রতি বিঘা বোরো আবাদের শুরুতেই খরচ বেড়েছে ২হাজার টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত। শ্রমিকের মজুরি গত বছর ছিল ৩শ' টাকা। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫শ' থেকে সারে ৫শ' টাকায়। ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে সেচ ও জমিতে ট্রাক্টর দিয়ে হালচাষ করায় খরচ বেড়েছে। এই ধার-দেনার টাকায় ধান কাটার পরেই তা বিক্রি করতে হয়। তখন (ধান-কাটা মাড়াই এর) সময় আবার ধানের দামও পাওয়া যায় না। ধান ঘরে তোলার সময় শ্রমিক পাওয়া যায় না। শ্রমিকদেরকে বেশি টাকা দিয়ে ধান কাটাতে হয়। তাই এবার ধানের দাম না বাড়লে ধান চাষি কৃষকরা মাঠে মারা যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্পসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা একে এম মঞ্জুরে মাওলা জানান, ইতিমধ্যেই জেলায় মতভাগ আবাদি ধান চাষের জমিতে ধান রোপন সম্পূর্ণ করেছেন কৃষকরা। এখন ধান নিরানি, কিটনাশক, সেচ সহ ধান ক্ষেতের পরিচর্যা নিয়ে ব্যাস্ত কৃষকরা। তবে এখন পর্যন্ত জমিতে ইরি বোরো পরিবেশ ভালো রয়েছে। আশা করা হচ্ছে এবার লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে। তিনি আরো বলেন, এবছর বিদ্যুৎ খরচ ও সেচ খরচ বেড়েছে, বেড়েছে শ্রমিকের মূল্যও। আর যেকোনো বিষয়ে উৎপাদন খরচ বাড়লে সেটি শেষ পর্যন্ত কৃষক পর্যায়ে বেড়ে যায়। সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করার সময় বর্তমান বাজার দরের সমন্বয় করবেন। তবে বাজারে ধানের দামও ভালো পাবেন কৃষকরা এবং কৃষকরা ধান বিক্রি করে লাভবান হবেন বলে আশা এই কৃষি কর্মকর্তার।