মানবদেহে কিডনি এমনই একটা অঙ্গ যে
আজ ভালো আছে মানে চিরকাল ভালো থাকবে, সেটা যেমন নয়, আবার আজ ভালো নেই মানে কোনো
দিনও ভালো হবে না সেটাও নয়। কিডনির মূল কাজ হলো, শরীর থেকে টক্সিন বা দূষিত
পদার্থকে আলাদা করে দেয়া। এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির তাই সারাজীবনই ভালো থাকা খুব
দরকার। আর তার জন্যই চাই জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে কিডনির প্রতি বিশেষ যত্ন।
আজ কী
কী করলে কিডনি ভালো থাকবে?
এপ্রসঙ্গে
বলতে গেলে প্রথমেই বলা যায়, প্রাথমিকভাবে সকলের মধ্যেই একটা ভুল ধারণা রয়েছে,
কিডনি খারাপ হলে আগে থেকে তা জানান দেয়। তা কিন্তু নয়। কিডনির অসুখ হলো সাইলেন্ট
কিলার বা নীরব ঘাতক। এই অঙ্গে কোনও অসুখ বাসা বাঁধলে সেটা প্রথমে একেবারেই টের
পাওয়া যায় না। যখন খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায় তখন বোঝা যায়। প্রতিটি কিডনি ১১
লক্ষ নেফ্রন নিয়ে গঠিত। কিন্তু ১০-২০ হাজার নেফ্রন নিয়ে আমরা ভালোভাবে কাটাতে
পারি। ওই কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি বিকল হলে আমরা টের পাই না। কোনো লক্ষণই
থাকে না। তাই যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনো মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হচ্ছে, ততক্ষণ
পর্যন্ত কিডনিতে কোনো রোগ বাসা বাঁধছে কি না বোঝা মুশকিল।
তাই আগাম কিডনির টেস্ট, যা রোগের
পূর্বাভাস জানায়
– রক্তের টেস্ট যেমন, ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন,
সোডিয়াম ও পটাশিয়াম।
– আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে কিডনির গঠন ঠিক
রয়েছে কি না দেখা।
– রুটিন ইউরিন টেস্ট করে দেখা উচিত।
– একটি অ্যাডভান্সড টেস্ট রয়েছে, যার নাম
হলো সিস্টাসিন সি। এই টেস্ট করে অনেক আগে থেকেই বোঝা যায় রোগীর ভবিষ্যতে ক্রিয়েটিনিন
বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে কি না।
– ক্রিয়েটিনিন থেকে জিএফআর লেভেল দেখেও কিডনির অসুখের ভবিষ্যৎবাণী
করা যায়।
কী কী লক্ষণ অ্যালার্মিং?
১. পা ফুলছে কি না।
২. প্রস্রাব করার সময় তা থেকে সাবানের মতো ফেনা হচ্ছে কি
না।
৩. কোনো কারণ নেই, খুব ক্লান্তিভাব।
৪. খাওয়ার ইচ্ছে চলে যাওয়া।
৫. ঘুমের অত্যধিক সমস্যা।
৬. মেয়েদের ক্ষেত্রে কিডনির সমস্যা
থাকলে বারবার ইউরিন ট্রাক্ট ইনফেকশন হতে পারে।
আজ মানলে কাল ভালো
কিডনি ভালো আছে কি না এই চিন্তা মনে জাগলে প্রথমেই
চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরবর্তী কী করবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এছাড়া কতগুলো
জিনিস মানতে হবে। যেমন- পর্যাপ্ত পানিপান করুন, লবণ বাদ দিন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে
রাখুন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, ওভার দ্য কাউন্টার মেডিসিন এড়িয়ে চলুন,
মুড়ি-মুড়কির মতো আয়ুর্বেদিক ওষুধ খাওয়া বা ন্যাচারোপ্যাথিতে অতিরিক্ত বিশ্বাস
কিডনির ক্ষতি করতে পারে, অতিরিক্ত ব্যথার ট্যাবলেট কিডনির সমস্যার কারণ, কথায় কথায়
অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া মারাত্মক কিডনির জন্য।
ভবিষ্যতেও মাথার রাখুন
কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো ভবিষ্যতের কথা ভেবে আগে থেকে
মেনে চলতে হবে। কিছু অসুখের প্রেক্ষাপটে কিডনির অসুখের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
– ডায়াবেটিস – যাদের রক্তে শর্করার মাত্রা
বেশি তাদের খুব সতর্ক থাকা দরকার। আজ কিডনি ভালো থাকলেও যদি ঠিকভাবে সচেতন না হওয়া
যায় তাহলে ডায়াবেটিস কিন্তু ধীরে ধীরে কিডনি বিকল করে।
– রক্তচাপ – এক্ষেত্রে বর্তমানে কোনোরকম
সমস্যা না হলেও এই অসুখ কিন্তু ভবিষ্যতে কিডনির নানা সমস্যা ডেকে আনতে পারে।
– কোলাজেন মাসক্যুলার ডিজিজ বা ক্রনিক আর্থ্রাইটিস- এই ধরনের সমস্যা
থাকলে অতিরিক্ত পেন কিলার খাওয়ার প্রবণতা থাকে, সেটাও কিন্তু কিডনি ফাংশন প্রতিহত করতে
পারে। লুপাস, মাল্টিপল টিস্যু ডিসঅর্ডার ইত্যাদি অসুখগুলো ধীরে ধীরে কিডনির উপরে প্রভাব
ফেলে।
আর একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, তা হলো কারো আগে কোনো
কিডনির সমস্যা ছিল, তা এখন ভালো হয়েছে। তবু কিছু জিনিস না মানলে বিপদ। যেমন-
কিডনিতে স্টোন। এক্ষেত্রে যাদের রয়েছে অসুখটা বা অপারেশন হয়েছে, তার পরবর্তী
সময়েও ডায়েট খুব জরুরি। স্টোনের কারণ জানতে জেনেটিক মেটাবলিক ডিসঅর্ডার থাকলে
সেগুলোর চিকিৎসা করা দরকার। ভবিষ্যতে অ্যান্টিবায়োটিক ও পেনকিলার খুব বুঝে খাওয়া
উচিত।
দুর্বল কিডনি সবল রাখতে বয়সকালে অর্থাৎ ষাটোর্ধ্বদের
বয়সজনিত কারণে কিডনির নানা সমস্যা হয়। এই বয়সজনিত কারণ প্রতিহত করতে কয়েকটি
পদক্ষেপ রয়েছে-
১) ডায়াবেটিস, রক্তচাপ ঠিক রাখার সাথে হার্টের বিশেষ যত্ন এই
বয়সীদের নিয়ে হবে। যাঁর যত ভালো হার্ট, তার কিডনির সমস্যাও কম। কার্ডিও রেনাল
সিন্ড্রোম এই বয়সে বেশি হয়। তাই রোজ হাঁটা, কিডনি ভালো রাখার জন্য অন্যতম
এক্সারসাইজ। এছাড়া এন্ডোরফিন হরমোন হাঁটলে ক্ষরণ হয়। এই হরমোন কিডনির
কার্যক্ষমতা ৩০ শতাংশ বাড়াতে পারে। তাই হাঁটুন। তবে অতিরিক্ত নয়। খুব বেশি
এক্সারসাইজ করলে পেশি থেকে প্রোটিন বের হয়, সেই প্রোটিন কিডনির ক্ষতি করতে পারে।
২০-৩০ মিনিট সপ্তাহে ৫ দিন হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করুন।
২) বয়সকালে ডায়ালিসিস নিতে হলে মাথায় রাখুন কিছু বিষয়।
যাদের দীর্ঘদিন ধরে ডায়ালিসিস চলছে, তাদের বয়স বাড়লে সাবধান হতে হবে। প্রথমত, খুব
সতর্ক থাকতে হবে খাদ্যাভ্যাস নিয়ে। দ্বিতীয়ত, সঠিক ডায়ালিসিস সেন্টার থেকে
ডায়ালিসিস নিতে হবে। এসব বুঝে চললে, ডায়ালিসিস নিয়েও ১০-১৫ বছর ভালো থাকা যায়।