চলতি বছরের নভেম্বরে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যে এই মূল্যস্ফীতি হয়েছে বেশি। এর মারাত্মক অভিঘাত পড়েছে গরিবের ওপর। এতে সংসার চালাতে হিমমিশ খাচ্ছেন কম আয়ের মানুষ। এই উচ্চ দামের অভিঘাতে তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। ক্রয় ক্ষমতা পেয়েছে হ্রাস। বাজার বিশ্লেষক দেশি-বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত যাচাই এবং অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ মাসে খাদ্য পণ্যে মূল্যস্ফীতি ১ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে যা প্রায় ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে, গত মাসে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অক্টোবরে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক পদক্ষেপ ও রাজস্ব নীতির সমন্বয়ের কারণে আগামী বছরের মে-জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামতে পারে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
বিবিএসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নভেম্বরে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এ ছাড়া খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আগের মাস অক্টোবরে যা ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গত বছরের অর্থাৎ ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ ও ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
দেউলিয়াত্ত থেকে ফিরে আসা দ্বীপদেশ শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতি প্রায় তিন মাস ধরে ঋণাত্মক পর্যায়ে। কিন্তু বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্য সংকোচন না হওয়ায় মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। গত বছরের একই সময়ে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৮৯ শতাংশ। এছাড়া, নভেম্বরে মজুরির হার কিছুটা বেড়েছে ৮.১০ শতাংশ হয়েছে যা অক্টোবরে ছিল ৮.০৭ শতাংশ।
নভেম্বরে দেশের গ্রামাঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, অক্টোবরে যা ছিল ১১ দশমিক ২৬ ভাগ। গত বছরের একই সময়ে অর্থাৎ নভেম্বরে দেশের গ্রামাঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। নভেম্বরে গ্রামাঞ্চলের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৪১ ও ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। চলতি বছরের অক্টোবরে যা ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৭৫ ও ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং গত বছরের নভেম্বরে যা ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮৬ ও ৮ শতাংশ। নভেম্বরে শহরাঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ; অক্টোবরে যা ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ২০২৩ সালের নভেম্বরে যা ছিল ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। নভেম্বরে শহরাঞ্চলের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে যথাক্রমে ১৪ দশমিক ৬৩ ও ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০২৪ সালের অক্টোবরে যা ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৫৩ ও ৯ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং ২০২৩ সালের নভেম্বরে যা ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৫৮ ও ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ।
দেশে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের কাছাকাছি। বিবিএসের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত দেশের গড় চলন্ত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ।
বাজার তদারকি করা হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাফল্য আসছে না। প্রতিনিয়ত অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। উৎপাদন ও আমদানিকারক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে একটি বড় সরবরাহ চেইন রয়েছে। সেখানেও সংকট কাজ করছে। সবমিলিয়ে দ্রুত এসব পরিস্থিতির উন্নতি না হলে মূল্যস্ফীতি টেনে ধরা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক শফিকুজ্জামান এ বিষয়ে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাজারে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। এটাই মূল্যস্ফীতি। এতে খালি হয়েছে স্বল্প আয়ের মানুষের পকেট। তাদের প্রকৃত আয় কমেছে। এই মূল্যস্ফীতির মারাত্মক অভিঘাতে সংসারের খাবার জোগাতেই সর্বশান্ত হয়েছে বড় আয়তনের পরিবারগুলো। এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। আমার সুদিনের আশা করছি।’
সর্বশেষ গত অক্টোবরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ আর অক্টোবরে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার কয়েক দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। তাতে বেড়েছে ঋণ ও আমানতের সুদও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, অনেক দিন ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে আইএমএফ মিশন উদ্বেগ জানিয়েছে। আইএমএফের পরামর্শে সুদহার বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আবার বাড়তে শুরু করে। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন, অনেক আগেই মুদ্রানীতি আধুনিকায়নের পরামর্শ দেওয়া হলেও যথাসময়ে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিনিধি দলটি দ্রুত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি ও মুদ্রাবিনিময় হারের স্থিতিশীলতায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে আইএমএফ। এ ছাড়াও ব্যাংকে বেনামে শেয়ার ধারণ বন্ধ ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে প্রতিনিধি দল।
আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। এরপর তিন কিস্তিতে সংস্থাটি থেকে প্রায় ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সাল নাগাদ পুরো অর্থ পাওয়ার কথা রয়েছে। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে প্রতিটি কিস্তি পেতে বেশ কিছু শর্ত পরিপালন করতে হচ্ছে। চতুর্থ কিস্তির জন্য গত জুনভিত্তিক দেওয়া বিভিন্ন শর্তের মধ্যে কর-রাজস্ব সংগ্রহ ছাড়া সব শর্ত পূরণ হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক পদক্ষেপ ও রাজস্ব নীতির সমন্বয়ের কারণে আগামী বছরের মে-জুনে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামতে পারে। মূল্যস্ফীতি কমলে সংকোচনমূলক ব্যবস্থা থেকে সরে আসব, তখন সুদহার কমবে। গত মে থেকে বাংলাদেশে মুদ্রানীতির সংকোচন শুরু হয়। আর বর্তমানে যে অর্থনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে, সে আলোকে বলতে পারি, আগামী মে-জুনে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামতে পারে। তারপর কয়েক মাসের মধ্যে তা ৬ শতাংশের নিচে নামতে পারে। সেটি হলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি থেকে সরে আসব।
আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমার লক্ষণ দেখা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, দেশে খাদ্যবহির্ভূত (নন-ফুড) মূল্যস্ফীতি এরই মধ্যে টানা তৃতীয় মাসের মতো কমেছে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো বেশি। এর কারণ এই সময়ের মধ্যে আমাদের দেশে দুটি বন্যা হয়েছে। একই সঙ্গে দীর্ঘ সময় বৃষ্টি ছিল। ফলে শীতকালীন সবজি ও অন্যান্য স্থানীয় খাদ্যপণ্য বাজারে আসতে দেরি হয়েছে। গভর্নর জানান, দেশে শ্রমিক বিক্ষোভসহ বিভিন্ন অস্থিরতার মধ্যেও রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি রয়েছে। গত চার মাসে ১০ শতাংশ রপ্তানি বেড়েছে। আর জুলাই থেকে নভেম্বরে প্রবাসী আয় ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।