তিন মাস বয়সী শান্তা। শিশুটির জ্বরসহ আরো কিছু সমস্যা
দেখা দিলে তাকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায় পরিবার। প্যাথলজি পরীক্ষায়
দেখা যায়, শিশুটি ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া বহন করছে। চিকিৎসক জানালেন, বেশির ভাগ
অ্যান্টিবায়োটিক আপাতত তার শরীরে আর কাজ করবে না।উদ্বিগ্ন
হয়ে পড়েন তার মা-বাবা।
জীবাণুর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠা বিশ্বব্যাপীই
চিকিৎসাবিদ ও স্বাস্থ্য প্রশাসকদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। দেশে শান্তা নামের তিন মাস বয়সী
শিশুটির মতো হাজারো শিশু আছে, যাদের শরীরে থাকা জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী
হয়ে উঠেছে। যথেচ্ছ ওষুধ প্রয়োগ ছাড়াও প্রকৃতি-পরিবেশ ও খাদ্য থেকে মানুষের শরীরে
অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশ করা এর অন্যতম কারণ।
অনেক ক্ষেত্রে পোলট্র্রি, মাছ ও গরু-খাসির খামারে পশুর
চিকিৎসায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে
চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের মধ্যে ৮.৬১ শতাংশ বহু ওষুধ প্রতিরোধী (মাল্টিড্রাগ
রেজিস্ট্যান্স বা এমডিআর) ব্যাকটেরিয়া বহন করছে। এর মধ্যে ২৯.২ শতাংশের বয়স ২০
বছরের কম। এদের অনেকেই শিশু।
৪০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে এর হার ৫৭.৬ শতাংশ। সম্প্রতি এক গবেষণায়
জীবাণুর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠার উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড
রেফারেল সেন্টার ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের মে পর্যন্ত সাত মাস এ
গবেষণাটি চালিয়েছে। এতে অর্থায়ন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ১২টি বিশেষায়িত (টারশিয়ারি) সরকারি
হাসপাতালের ১৩ হাজারের বেশি রোগীর নমুনা পরীক্ষা করে এক হাজার ১৪৯টিতে বহু ওষুধ
প্রতিরোধী জীবাণু পাওয়া যায়।
গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ২০
বছরের কম বয়সী রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি (২৯.২ শতাংশ) ওষুধ প্রতিরোধী
ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব রয়েছে। ২০-৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে এর হার ২৮.৪ শতাংশ । ৪০-৬০
বছর বয়সীদের মধ্যে তা ২৫ শতাংশ। ১৮ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে।
গবেষণায় দেখা গেছে, আইসিইউতে ভর্তি হওয়া রোগীদের জন্য
এমডিআর ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ,
ডায়াবেটিস, পালমোনারি যক্ষ্মা, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের মতো অসুখে আক্রান্তদের
মধ্যে এমডিআর ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের প্রবণতা বেশি।
গবেষক ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন
অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার মাইক্রোবায়োলজির চিকিৎসক ডা. সানজিদা আরিনা বলেন,
হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন কিংবা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)
ভর্তি ছিলেন এমন ব্যক্তিদের এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, বহু ওষুধ
প্রতিরোধে জীবাণুর সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি (২১ শতাংশ) পাওয়া গেছে শেখ হাসিনা জাতীয়
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের রোগীদের মধ্যে। বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে
নেওয়া রোগীদের ক্ষতের নমুনার ৯৩ শতাংশে এমডিআর পাওয়া গেছে। আর পুঁজের মধ্যে
সর্বোচ্চ রেজিস্ট্যান্স পাওয়া গেছে শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সরকারি
হাসপাতালটির ৫৮ শতাংশ পুঁজের নমুনায়ই এমডিআর পাওয়া গেছে।
ডা. সানজিদা বলেন, ‘আমাদের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ মাছে, মাংসে, পানিতে, ফসলে, গাছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই
অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ করা হচ্ছে। এই অ্যান্টিবায়োটিক শেষ পর্যন্ত পানি ও
মাটিতে গিয়ে পরিবেশ দূষিত করছে। মাটি ও পানিতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু
সৃষ্টি হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য
বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘হাসপাতালে রোগাক্রান্ত
ব্যক্তির হাঁচি-কাশিতে যেমন রোগ ছড়ায়, তেমনি মশা-মাছির মাধ্যমেও অনেক রোগ ছড়ায়।
রোগীদের দেখতে বাইরে থেকে লোকজন আসা-যাওয়া করে। এ অবস্থায় দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ
প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সংক্রমণগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হলে রোগীকে দীর্ঘ
সময় হাসপাতালে থাকতে হয়। এতে চিকিৎসা ব্যয়ও কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
আইইডিসিআরের চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার অধ্যাপক ডা. জাকির
হোসেন হাবিব বলেন, দুই জায়গা থেকে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। হাসপাতালে যেমন জীবাণু
থাকে, কমিউনিটিতেও থাকে। মানুষ কখনো সংক্রমিত হয় বাসা থেকে, আবার কখনো হাসপাতালে
একটা রোগ নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে অন্য রোগে আক্রান্ত হয়। কারণ সেখানে অনেক জীবাণু
থাকে।
অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন বলেন, হাসপাতাল থেকে সংক্রমিত
হলে জীবাণু বেশি প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। কারণ হাসপাতালে রোগীদের ওপর প্রচুর পরিমাণে
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে আইসিইউতে থাকা রোগীর ক্ষেত্রে
মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু পাওয়া যায়। ভর্তি ও বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেওয়া
রোগীর মধ্যে তুলনা করলে দেখা যায় ভর্তি রোগীদের মধ্যে বেশি জীবাণু রেজিস্ট্যান্ট
হচ্ছে।
ডা. জাকির বলেন, হাসপাতালগুলোকে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক
পলিসি ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রিন্সিপাল মানতে হবে। অন্যথায় অদূর ভবিষতে সংক্রামক ও
অসংক্রামক অন্যান্য রোগের চেয়ে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের কারণে বেশি মানুষের
মৃত্যু হবে।