পাহাড়ের ওপরে আঁকাবাঁকা সর্পিল গতিতে চলা এ সড়কটি এখন
পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি
যুক্ত হয়েছে কাপ্তাইয়ের সঙ্গে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অসাধারণ এ উদ্যোগ এখন
সবার নজর কেড়েছে। স্থানীয়দের কাছে সড়কটির নাম ‘আসাম বস্তি-কাপ্তাই সড়ক’। তবে অনেকের মত, সড়কটির
নাম রাঙামাটি-কাপ্তাই লিংক রোড হলেই, নামেই পর্যটকরা বুঝে নিত যে, রাঙামাটি থেকে
কাপ্তাই চলাচলের পথ।
রাঙামাটির পাহাড়ের ওপর নির্মিত সড়কটি নিয়ে এ প্রতিবেদকের
সঙ্গে কথা হয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এর নির্বাহী প্রকৌশলী আহমদ
শফির সঙ্গে। তিনি বলেন, সড়কটি নির্মাণ নিঃসন্দেহে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি
অসাধারণ সাফল্য। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের
চ্যালেঞ্জ ছিল। সবশেষে সফলতা এসেছে। এখন সড়কটি দেখলে যে কারো মন জুড়িয়ে যাবে।
তিনি বলেন, সড়কটি নির্মাণের শুরুটা অনেক কঠিন ছিল। ২০১৭ সালে
১৩ জুন এখানে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। সড়কটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে এটিকে
সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুরোদমে কাজ শুরু করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।
প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কটিকে দুই লেনে উন্নীত করা হয়। নির্মাণ করা হয় তিনটি
নতুন সেতু। ২০২৩ সালে সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে সড়কটি পুরোপুরি চালু
রয়েছে। সড়কটি নির্মাণের ফলে রাঙামাটির সঙ্গে কাপ্তাইয়ের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার
কমে গেছে।
রাঙামাটি শহরে ঢুকে আসাম বস্তি নামটা শুনে মনে হলো, এখানে
আসামের নাম কোথা হতে এলো। তবে বুঝলাম, ‘আসাম বস্তি’ নামটা এখানে বেশ জনপ্রিয়,
এক নামে পরিচিত। তবে ইতিহাস কেউ জানে না। একেকজন একেক কথা বলছেন। কারো মতে এককালে এখানে
বস্তি গেড়ে আসাম থেকে লোক এসে থাকতেন। তাই এর নাম আসাম বস্তি। কারো মতে, স্বাধীনতার
আগে এখানে আসাম থেকে কিছু লোক এসে বসতি স্থাপন করেন বলে নাম আসাম বস্তি। তবে নাম যা
হোক না কেন, রাঙামাটি-কাপ্তাই সড়ক রাঙামাটি অংশে শুরু হয়েছে ‘আসাম বস্তি’ এলাকা থেকে। আর শেষ হয়েছে
কাপ্তাইতে। যেহেতু শুরুটা এখান থেকে হয়েছে তাই এ প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আসাম বস্তি-কাপ্তাই সড়ক
আসাম বস্তি-কাপ্তাই সড়কে এখন খুব বাইকারদের দাপট। নারী-পুরুষ
সমানতালে মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটছেন। তবে এ রোডে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে গেলে পাহাড়ি পথে
চলার অনভিজ্ঞ চালকের জন্য বিপদের আশঙ্কা থাকে। উঁচু-নিচু পাহাড়ি এলাকায় চলাচলে
আলাদা কসরতের দরকার।
দেখলে মনে হয়, পাহাড়ের ওপর দিয়ে সরু কোনো রাস্তা। তবে
রাস্তাটির যতটুকু করা হয়েছে তাতে দুটি গাড়ি অনায়াসে চলাচল করা কোনো সমস্যাই নয়।
রাস্তার মাঝে মাঝে রয়েছে দাঁড়ানোর প্রশস্ত জায়গা। সড়কের এক পাশে পাহাড়ের সারি,
অন্য পাশে কাপ্তাই হ্রদের জলরাশি। হ্রদ আর পাহাড়-দুদিকেই অসাধারণ সৌন্দর্য। বিশেষ
করে এক পাশে উঁচু পাহাড়ের নিচে কয়েক স্তরের পাহাড়ের সারি। আর মাথার ওপরে মনে হবে
কাছাকাছি রয়েছে মেঘের কারুকাজ। রাস্তা আর লেক ঘিরে এরই মধ্যে নানা পর্যটন কেন্দ্র
নির্মাণ চলছে। প্রায় ডজন খানেক পর্যটন কেন্দ্র ও রিসোর্ট এরই মধ্যে হয়ে গেছে। চলার
পথে লেকের ধারে বেরাইন্না লেক, বাগী লেক, রাইন্যা টুগুন, বড় গাং ইত্যাদি নানা
বাহারি নামের পর্যটন স্পট দেখা যাবে। এখানে রয়েছে খাবার আয়োজন থেকে সব সুবিধা।
আসাম বস্তি-কাপ্তাই সড়কে ওঠার মুখে পাহাড়ের ভেতরে নজর কাড়ে ‘রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয়’ ভবনের। প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রী
ভয়হীনভাবে পাহাড়ের চারিদিকে ঘোরাফেরা করেন। কেউ কেউ সড়কের দৃষ্টিনন্দন স্থানে আড্ডারত।
এ সড়কের পাশ ঘেঁষেই রয়েছে বৌদ্ধমন্দির। মন্দিরে রয়েছে অসাধারণ নির্মাণশৈলী। জানলাম,
এ পাহাড়েই রয়েছে বুদ্ধ গুরু মহাসাধক সাধনানন্দ মহাস্থবির এর জন্মস্থান। যিনি এখানে
বনভান্তে নামে পরিচিত। এখানে দেখা মিলবে দর্শনার্থীর লম্বা লাইন। আসাম বস্তি থেকে কয়েক
মাইল যাওয়ার পর নজরে পড়ে লম্বা একটি সেতু। পুরো সেতুর ওপর দর্শনার্থীর ভিড়।
ঢাকা থেকে ব্যবসায়ী মুহিবুল হক সপরিবারে কাপ্তাই থেকে এ পথ
দিয়ে এসেছেন রাঙামাটি। তিনি বলেন, ‘রাঙামাটির এ সড়কে না আসলে
অনেক কিছু দেখতাম না। সৃষ্টিকর্তা যে এত অসাধারণ সৌন্দর্য এখানে দিয়েছেন যে দেখলে চোখ
জুড়িয়ে যায়। ইচ্ছে করে দিনভর দাঁড়িয়ে থেকে শুধু দেখতেই থাকি।
এখানে এসে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা মিলল রাঙামাটির মিলটন
চাকমার। তিনি একটি টং দোকান দিয়ে চা’সহ নানা ফল নিয়ে বসেছেন। বেশ
বেচাবিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন তিনি। তিনি বলেন, এ সড়কটি হওয়ার পর ব্যবসার গতি বেড়েছে।
এখন আর একা পারি না। সঙ্গে সহযোগী লাগে।
রাঙামাটির ফল ব্যবসায়ী কবির হোসেন বলেন, ‘এ সড়ক হওয়ার ফলে ব্যবসায়ীরা
লাভবান হয়েছে। আগে পাহাড়ের ভেতরে থাকা আম, কাঁঠাল, আনারস পচে পড়ে থাকত। পাহাড় থেকে
এগুলো বের করে এনে বিক্রি করা কঠিন হেয় যেত। এখন রাস্তার পাশে যে যেভাবে পারে ফল নিয়ে
বসে যায়। খুচরা বিক্রি হচ্ছে এসব ফল। বাজারে আনাও সহজ হয়ে গেছে। যারা অল্প উৎপাদন করছে
তারা পথিমধ্যে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করে দিতে পারছেন। আর ব্যবসায়ীরা গাড়িতে করে দেশের
বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতে পারছেন। ফলে ব্যবসায় গতি যেমন বেড়েছে, তেমনি অনেকের অভাবও
দূর হয়েছে।