সুফি মাজহারুল ইসলাম মাসুম,সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক, গবেষক :
মানুষের পরিচয় কি ? মানুষের
পরিচয় জানার আগে মনুষ্য জাতির জানা উচিত মানব সৃষ্টির আগে কী সৃষ্টি হয়েছিল?
এও জানা উচিত যে, মানবদেহে প্রাণটা
স্থাপিত হওয়ার বা সৃষ্টির আগে কোথায় ছিল? তখন কি আমাদের
পরিচয় মানুষই ছিল ? নাকি
অন্য কোনো শিরোনামে অবহিত করা হতো? আর এ ক্ষেত্রে জানা
আবশ্যক রুহ বা আত্মার বিষয়। কেননা মানব সৃষ্টির আড়াই হাজার বছর পূর্বে রুহ সৃষ্টি
হয়েছে বলে উদ্ধৃত আছে।
তাহলে আপনা থেকেই প্রশ্ন জাগে ‘রুহ’ কি? রুহের সঙ্গে দেহের সম্পর্ক কি ? রুহ নশ্বর না অবিনশ্বর? রুহের সঙ্গে নফসের সম্পর্ক কি? রুহ আগে সৃষ্টি
হয়েছে নাকি দেহ আগে সৃষ্টি হয়েছে? মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে
রুহের অবস্থান কোথায় থাকবে? এসব বিষয়ে জানার কৌতূহল ও
আগ্রহ মানুষ বলতেই আছে। তাই যুগ যুগ ধরে মানুষ রুহের হাকিকত ও রহস্য সম্পর্কে
চিন্তাভাবনা, ধ্যান-ধারণা ও গবেষণা করে আসছে। বাংলা ভাষায়
‘রুহ’কে
আত্মা বলে।
আরবিতে কখনো ‘কলব’ কখনো
‘নফস’ ব্যবহার হয়েছে। আমরা যদি আত্মাকে আরেকটু ব্যাপৃত করি তাহলে ‘রুহ’র
অর্থ দাঁড়ায় দেহবিশিষ্ট, চৈতন্যময়,
সত্তা, স্বরুপে স্বয়ং, অন্তর্নিহিত শক্তি, প্রাণের মধ্যবিন্দু,
কেন্দ্রবিন্দু, প্রাণকে চঞ্চল করে তুলে
এমন উজ্জীবক, গভীর অনুভূতিকে জাগ্রত করে এমন শিরোনাম।
উল্লিখিত আলোকপাতে প্রশ্নোদয় হয় আত্মা কি? আত্মাবিষয়ক আলোচনা মহাগ্রন্থ আল কোরআনে
একাধিকবার যেমন উত্থাপন হয়েছে, তেমন বাইবেলেও উল্লেখ
রয়েছে। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওতায়ালা বলেন “এবং তাতে আমার ‘রুহ’ থেকে ফুঁক দেব [সুরায়ে হিজর : ২৯]। বাইবেলে
উল্লেখ রয়েছে ‘আর তিনি তোমাদের কাছে চিরকাল থাকবার জন্য আরো
একজন সাহায্যকারী পাঠিয়ে দেবেন। আর সে সাহায্যকারীই সত্যের রুহ” [যোহন-১৪ : ১৬, ১৭]
দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিকদের মতে রুহ বা আত্মা তিন ধরনের হয়। (১)
রুহে হায়াতী : এ রুহ বা আত্মার অবস্থান হৃৎপিন্ডে এর সাথে মানুষের
জীবন এবং তার স্বস্তি ও সুস্থতা সম্পর্কিত। (২) রুহে তবয়ী : এ রুহ বা আত্মার
অবস্থান রক্ত, এ আত্মা মানুষের
শক্তি, সামর্থ্য এবং কর্মক্ষমতা সংশ্লিষ্ট। (৩) রুহে
নাফসানি : এ রুহ বা আত্মার অবস্থান মাথা। এই রুহ হলো অনুভূতি এবং চেতনার মূল।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ‘মন’কে আত্মা বলা হয়।
বুৎপত্তিগত অর্থে যা পূর্ব অভিজ্ঞতায় স্মরণ রাখতে পারে তাই হলো ‘আত্মা’। কেউ
কেউ বলেছেন, মানবদেহে যে
প্রবাহমান রক্ত আছে সেই রক্ত হলো ‘রুহ’ বা আত্মা। এবার জেনে নিতে পারি যুগশ্রেষ্ট মনীষীরা ‘রুহ’ বা আত্মাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
আত্মা এমন বিষয় যার মাধ্যমে
মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে। যা মানুষের ভেতর হতে বের হয়ে গেলে মানুষ মারা
যাবে।” বিশ্বখ্যাত গবেষক আল-ফারাবীর মতে “আত্মা
হলো এমন বস্তু যার ওপর মানুষের জীবন নির্ভরশীল।” যুগশ্রেষ্ঠ
দার্শনিক ইমাম গাযযালী বলেন, “আত্মা হলো মানুষের
দেহ সংশ্লিষ্ট এবং দেহোত্তীর্ণ আধ্যাত্মিক সত্তা ।
মনীষীদের সারকথা হলো “আত্মা এমন এক বিষয়
যা চিরন্তন, অমর, অবিনশ্বর, অদৃশ্য এবং সর্বত্র বিরাজমান এবং যা
মানুষের প্রাণশক্তিকে সঞ্চারিত করে।” ইসলামের
দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নফস বা আত্মাকে তিনটি শিরোনামে আখ্যায়িত তথা ভাগ করা হয়েছে।
যথা- লাওয়ামা, আম্মারা এবং মুতমাইন্না। অবশ্য পবিত্র আল
কোরআনেও এ তিন প্রকারের কথা উল্লেখ হয়েছে।
ইসলামিক স্কলারগণ নফস বা আত্মার উল্লিখিত তিন প্রকারের সম্পূরক
তিনটি স্তরও উদ্ধৃত করেছেন। যথাক্রমে- (১) রুহে আযীম, (২) রুহে কুদ্দুস এবং (৩) রুহে নফস। এখানে
আরেকটি বিষয় প্রাণিধানযোগ্য রুহ, কলব যেটাই বলেন আত্মাকে
আত্মশুদ্ধ করার একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে! যা হক্কানী পীর বুজুর্গ বা উলামায়ে কেরামগণ
যুগ যুগ যাবৎ করে আসছেন। আর সেটাকে আরবি ভাষায় বলা হয় ‘তাযকিরাতুন
নফস’। যার
বাংলা ‘আত্মশুদ্ধি’ এখানে তাযকিরাতুন কথাটি যায়িয়ূন হতে নির্গত হয়েছে যার এককথায় অর্থ হলো
শুদ্ধ, পবিত্র, নিষ্পাপ বা ইসলাহ,
অর্থাৎ আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা, পাক করা,
উদ্বুদ্ধ করা ও উন্নত করা।