Logo
শিরোনাম

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধে অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠোর হওয়ার আহ্বান

প্রকাশিত:মঙ্গলবার ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | হালনাগাদ:বুধবার ২১ মে ২০২৫ |

Image

মাইজভান্ডার দরবার শরীফের পীর ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) চেয়ারম্যান হযরত শাহসুফি ড. সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল হাসানী মাইজভাণ্ডারী বলেছেন, ইসলাম মানুষকে ইনসানে কামেল বা পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেয়। তিনি বলেন, সচ্চরিত্র তখনই অর্জিত হয়, যখন ক্রোধশক্তি ও খায়েশ শক্তিকে সমতার পর্যায়ে রাখা হয়। কেননা, কঠোরতা কখনও ক্রোধ থেকে এবং কখনও তীব্র লালসা থেকে উৎপন্ন হয়, কিন্তু নম্রতা সচ্চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। সে ব্যক্তি সহনশীল নয়, যে জুলুমের সময় চুপ থাকে, এরপর সক্ষম হলে প্রতিশোধ নেয়; বরং সহনশীল তাকেই বলা হয়, যে জুলুমের সময় সহ্য করে এবং সক্ষম হলে ক্ষমা করে। তিনি আরো বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তিনি বিজিত শত্রুদের প্রতি কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার করেননি। হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভান্ডারী বলেন, প্রকৃত মুসলমান ওই ব্যক্তি যার মুখ ও হাতের অনিষ্ট থেকে লোকজন নিরাপদ থাকে এবং যার নির্যাতন থেকে মানুষ নিরাপদ তাকে মুমিন বলে। বিএসপি চেয়ারম্যান বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় বসবাসরত আদিম পৌত্তলিক, ইহুদি এবং নবদীক্ষিত মুসলিম তিন সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে, দল-মত নির্বিশেষে মদিনা সনদের মাধ্যমে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। যেখানে সামাজিক নিরাপত্তা, পারস্পরিক সম্পর্ক, মদিনার নিরাপত্তার প্রশ্ন এবং মদিনার অর্থনীতি সচল রাখার বিষয়ে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। সে সময় কারও কোনো অধিকার বিন্দুমাত্র ভূলুণ্ঠিত হয়নি। সব নাগরিক সমান অধিকার পেয়েছে। রাসুল (সা.)-এর বলিষ্ঠ পদক্ষেপের ফলে তৎকালীন সমাজের গোত্রগুলোর অন্তর্কলহ, রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের অবসানসহ নৈরাজ্যমুক্ত, মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বস্তুত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনুপস্থিতিতে দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সংঘাতের সূত্রপাত ঘটায়, গৃহযুদ্ধেও রূপ নেয়। তিনও দেশের এই ক্লান্তিকালে মব জাস্টিস, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এ সমস্ত ধ্বংসাত্মক বিশৃঙ্খল পন্থা পরিহার করার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। একই সাথে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টিকারী সম্প্রীতি বিনষ্টকারী উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি কঠোর হওয়ারও আহ্বান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভান্ডারী। 


২রা ডিসেম্বর (সোমবার) রাতে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর নামা বাজার সানিকুল ইসলাম সানির বালুর মাঠে আঞ্জুমানে রহমানিয়া মইনীয়া মাইজভাণ্ডারীয়া ও মইনীয়া যুব ফোরাম বেলাব উপজেলা শাখার ব্যবস্থাপনায় পবিত্র ওয়াজ ও মিলাদ মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন বিএসপি চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভান্ডারী। বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মোঃ ধন মিয়া প্রধান ও জনাব মোঃ মকবুল হোসেন মেম্বারের সভাপতিত্বে মাহফিলে উদ্বোধক ছিলেন নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব মোঃ কাউসার কাজল (এম.এ)। কোরআন সুন্নাহর আলোকে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করেন, রাজধানী ঢাকার মিরপুর-১ মসজিদ-এ গাউছুল আজমের খতিব মাওলানা মুফতি মাকসুদুর রহমান, মইনীয়া যুব ফোরাম কেন্দ্রীয় পরিষদের বিভাগীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক, হাফেজ মাওলানা কেরামত আলী, খাদেম মাওলানা হাফেজ খাজা বাহাউদ্দীন মাইজভান্ডারীসহ আরো অনেকেই। এসময় বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, আঞ্জুমানে রহমানিয়া মইনীয়া মাইজভাণ্ডারীয়া ও মইনীয়া যুব ফোরামসহ বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।


পরে সালাতু সালাম শেষে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি, কল্যাণ ও নিপিড়ীত মানবতার মুক্তি কামনায় আখেরী মুনাজাত পরিচালনা করেন, মাইজভান্ডার দরবার শরীফের বর্তমান ইমাম ও বিএসপি চেয়ারম্যান হযরত শাহসূফী ড. সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল হাসানী মাইজভাণ্ডারী।


আরও খবর



আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করায় উদ্বিগ্ন ভারত

প্রকাশিত:বুধবার ১৪ মে ২০২৫ | হালনাগাদ:বুধবার ২১ মে ২০২৫ |

Image

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার ঘটনায় ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘কোনও উপযুক্ত পদ্ধতি অনুসরণ না করেই আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ একটি উদ্বেগজনক ঘটনা।

(বাংলাদেশে) গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা যেভাবে খর্ব করা হচ্ছে এবং রাজনৈতিক পরিসর (পলিটিক্যাল স্পেস) সঙ্কুচিত হয়ে আসছে তাতে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত স্বভাবতই উদ্বিগ্ন বোধ করছে’, জানান তিনি।

একই সঙ্গে বাংলাদেশে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজন করার দাবিও পুনর্ব্যক্ত করেছে ভারত।

রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘বাংলাদেশে দ্রুত একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে আমরা জোরালো সমর্থন জানাই।

প্রসঙ্গত গত আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই ভারত সে দেশে যত দ্রুত সম্ভব একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছে। সূত্র: বিবিসি


আরও খবর



২৫.৪৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ

প্রকাশিত:মঙ্গলবার ২০ মে ২০25 | হালনাগাদ:বুধবার ২১ মে ২০২৫ |

Image

২৫.৪৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সোমবার রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এ তথ্য জানিয়েছেন।

তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যালেন্স অফ পেমেন্টস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম৬) অনুসারে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০.০৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন রিজার্ভ বিপিএম-৬ হিসেবে দুই হাজার সাত কোটি পাঁচ লাখ ৯০ ডলার। তবে ব্যয় যোগ্য রিজার্ভ এক হাজার ৬০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, দেশের মোট রিজার্ভ দুই হাজার ৫৪৪ কোটি ৪৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার।

গত ৭ মে দেশে রিজার্ভ বিপিএম-৬ হিসেবে হয়েছিল দুই হাজার ২৯ কোটি ১২ লাখ ১০ হাজার ডলার। আর দেশের মোট রিজার্ভ হয়েছিল দুই হাজার ৫৬৭ কোটি ৭২ লাখ ৯০ হাজার ডলার। এর আগে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় ১৮৮ কোটি ২০ লাখ ৬০ হাজার ডলার পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ।


আরও খবর



কুরআন মজীদ ও হাদীসের আলোকে হজ্ব ও উমরার গুরুত্ব ও ফযীলত

প্রকাশিত:বুধবার ২৩ এপ্রিল ২০২৫ | হালনাগাদ:মঙ্গলবার ২০ মে ২০25 |

Image

ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহের পঞ্চমটি হল হজ্বে বায়তুল্লাহ। ঈমান, নামায, যাকাত ও রোযার পরই হজ্বের অবস্থান। হজ্ব মূলত কায়িক ও আর্থিক উভয়ের সমন্বিত একটি ইবাদত। তাই উভয় দিক থেকে সামর্থ্যবান মুসলিমের উপর হজ্ব পালন করা ফরয। অর্থাৎ হজ্ব আদায়ে সক্ষম এমন শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচাপাতি ও আসবাবপত্রের অতিরিক্ত হজ্বে যাওয়া-আসার ব্যয় এবং হজ্ব আদায়কালীন সাংসারিক ব্যয় নির্বাহে সক্ষম এমন সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর হজ্ব আদায় করা ফরয। হজ্ব প্রত্যেক মুসলমানের উপর সারা জীবনে একবারই ফরয হয়। একবার ফরয হজ্ব আদায়ের পর পরবর্তী হজ্বগুলো নফল হিসেবে গণ্য হবে। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন-


يا أيها الناس! إن الله كتب عليكم الحج، فحجوا، فقال رجل : أكل عام يا رسول الله؟ فكست حتى قالها ثلاثا، ثم قال : لو قلت نعم لوجبت ولما استطعتم.


  হে মানবসকল! আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর হজ্ব ফরয করেছেন। সুতরাং তোমরা হজ্ব করো। এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! প্রতি বছর কি হজ্ব করতে হবে? তিনি চুপ রইলেন এবং লোকটি এভাবে তিনবার জিজ্ঞেস করল। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তাহলে তা (প্রতি বছর হজ্ব করা) ফরয হয়ে যেতো, কিন্তু তোমাদের পক্ষে তা করা সম্ভব হতো না।

-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩৩৭ (৪১২); মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১০৬০৭; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৭০৪; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৫০৮; সুনানে নাসায়ী ৫/১১০; শরহে মুশকিলুল আছার, হাদীস : ১৪৭২; সুনানে দারাকুতনী ২/২৮১


ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত অনুরূপ হাদীসে আরো বলা হয়েছে, হজ্ব (ফরয) হল একবার, এরপরে যে অতিরিক্ত আদায় করবে তা নফল হিসেবে গণ্য।

-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৩০৪; সুনানে দারিমী, হাদীস : ১৭৮৮; সুনানে নাসায়ী ৫/১১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৭২১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৮৮৬; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ৩২০৯


হজ্ব যেহেতু একবারই ফরয তাই যার উপর হজ্ব ফরয হয়েছে সে যদি মৃত্যুর আগে যে কোনো বছর হজ্ব আদায় করে, তবে তার ফরয আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু হজ্ব বিধানের মৌলিক তাৎপর্য, তার যথার্থ দাবি ও আসল হুকুম হচ্ছে হজ্ব ফরয হওয়ার সাথে সাথে আদায় করা। বিনা ওজরে বিলম্ব না করা। কারণ বিনা ওজরে বিলম্ব করাও গুনাহ। আল্লাহ তাআলা ও তার রাসূল ফরয হজ্ব আদায়ের প্রতি এমনভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন যে, কেউ যদি এই হজ্বকে অস্বীকার করে বা এ বিষয়ে কোনো ধরনের অবহেলা প্রদর্শন করে তবে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে মুক্ত ও হতভাগ্যরূপে বিবেচিত হবে।


আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-


ولله على الناس حج البيت من استطاع اليه سبيلا، ومن كفر فان الله غنى عن العلمين.


 (তরজমা) মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্ব করা ফরয। আর কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।

-সূরা আলে ইমরান (৩) : ৯৭


তাছাড়া যে কোনো ধরনের বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখের সম্মুখীন হওয়া বা মৃত্যুর ডাক এসে যাওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। তাই হজ্ব ফরয হওয়ার পর বিলম্ব করলে পরে সামর্থ্য হারিয়ে ফেললে বা মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তাআলার নিকট অপরাধী হিসেবেই তাকে হাজির হতে হবে। এজন্যই হাদীস শরীফে হজ্ব ফরয হওয়ামাত্র আদায় করার তাগিদ ও হুকুম দেওয়া হয়েছে।


ইবনে আববাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-


من أراد الحج فليتعجل، فإنه قد يمرض المريض وتضل الضالة وتعرض الحاجة.


 যে ব্যক্তি হজ্ব করার ইচ্ছে করে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা আদায় করে নেয়। কারণ যে কোনো সময় সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বা বাহনের ব্যবস্থাও না থাকতে পারে অথবা অন্য কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।

-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৮৩৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৮৮৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৭৩২; সুনানে দারিমী, হাদীস : ১৭৮৪; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৬৮৭; তবারানী, হাদীস : ৭৩৮


অন্য বর্ণনায় ইরশাদ হয়েছে, ইবনে আববাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

تعجلوا إلى الحج، يعني الفريضة، فإن أحدكم لا يدري ما يعرض له.

ফরয হজ্ব আদায়ে তোমরা বিলম্ব করো না। কারণ তোমাদের কারো জানা নেই তোমাদের পরবর্তী জীবনে কী ঘটবে।

-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৮৬৭; সুনানে কুবরা বায়হাকী ৪/৩৪০


উপরন্তু একটি হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা যে স্বচ্ছল সামর্থ্যবান ব্যক্তি সত্ত্বর হজ্ব আদায় করে না তাকে হতভাগা ও বঞ্চিত আখ্যায়িত করেছেন।


আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-


يقول الله عز وجل : إن عبدا صححت له جسمه، ووسعت عليه في المعيشة تمضي عليه خمسة أعوام لا يفد إلى لمحروم.


আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি আমার বান্দার শরীরকে সুস্থ রাখলাম, তার রিযিক ও আয়-উপার্জনে প্রশস্ততা দান করলাম। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যদি সে আমার গৃহের হজ্বের উদ্দেশ্যে আগমন না করে তবে সে হতভাগ্য, বঞ্চিত।

-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৬৯৫; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস : ১০৩১; তবারানী, হাদীস : ৪৯০; সুনানে কুবরা বায়হাকী ৫/২৬২; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস : ৫২৫৯


শুধু তাই নয়, একসময় বায়তুল্লাহ উঠিয়ে নেয়া হলে মানুষ হজ্ব করতে পারবে না এই আশঙ্কার কারণেও আল্লাহর রাসূল উম্মতকে তাড়াতাড়ি হজ্ব করার হুকুম করেছেন। ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-


استمتعوا بهذا البيت فقد هدم مرتين ويرفع في الثالثة.


তোমরা হজ্ব ও উমরার মাধ্যমে এই (বায়তুল্লাহ) গৃহের উপকার গ্রহণ কর। কেননা তা ইতিপূর্বে দু’বার ধ্বংস হয়েছে। তৃতীয়বারের পর উঠিয়ে নেওয়া হবে।

-সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৫০৬; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৬৭১৮; মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ১০৭২; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ১৬৫২


হজ্ব করার শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থ-বিত্ত থাকার পরও যে ব্যক্তি হজ্ব করে না তার সম্পর্কে হাদীস শরীফে কঠোর হুমকি প্রদান করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন-


من أطاق الحج فلم يحج فسواء عليه مات يهوديا أو نصرانيا.


যে ব্যক্তি হজ্ব করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ্ব করে না সে ইহুদী হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খৃস্টান হয়ে তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই।

-তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৫৭৮


তিনি আরো বলেন, আমার ইচ্ছে হয় কিছু লোককে বিভিন্ন শহরাঞ্চল ও লোকালয়ে পাঠিয়ে দিই, তারা সেখানে দেখবে, কারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্ব করছে না। তারা তাদের উপর কর আরোপ করবে। তারা মুসলমান নয়, তারা মুসলমান নয়।-প্রাগুক্ত


যারা হজ্ব-উমরা না করে সন্ন্যাসী হওয়ার চেষ্টা করে ইসলাম তা কখনো অনুমোদন করে না। ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

لا صرورة في الإسلام.

ইসলামে বৈরাগ্য নেই। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হজ্বের ক্ষেত্রে কোনো বৈরাগ্য নেই।

-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৩১১৩, ৩১১৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৭২৯; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৬৮৬; তবারানী, হাদীস : ১১৫৯৫; শরহু মুশকিলুল আছার, হাদীস : ১২৮২


ইকরামা রাহ.কে জিজ্ঞাসা করা হল, সারুরা কী? তিনি বলেন, যে ব্যক্তি হজ্ব-উমরাহ কিছুই করে না অথবা যে ব্যক্তি কুরবানী করে না।

-শরহু মুশকিলুল আছার ২/২১৫-১৬


সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রাহ. বলেন, জাহেলী যুগে যখন কোনো ব্যক্তি হজ্ব করত না তখন তারা বলত, সে সারুরা (বৈরাগী)। তখন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইসলামে বৈরাগ্য নেই।-প্রাগুক্ত


যারা হজ্বের সফরের সৌভাগ্য লাভ করেন তারা যেন আল্লাহর মেহমান। তাই প্রত্যেকের উচিত সর্বদা আল্লাহর আনুগত্য ও তার ইশক-মুহববতের অনুভূতি নিয়ে সেখানে অবস্থান করা। বায়তুল্লাহ ও আল্লাহর অন্যান্য শেআর ও নিদর্শনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। দ্বন্দ-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ এবং অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে সর্বাত্মকভাবে দূরে থাকা। 


কুরআন-হাদীসে এ সম্পর্কে বিশেষ হুকুম নাযিল হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-


الحج اشهر معلومات فمن فرض فيهن الحج فلا رفث ولا فسوق ولا جدال في الحج، وما تفعلوا من خير يعلمه الله.


 (তরজমা) হজ্বের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস আছে। যে ব্যক্তি সেসব মাসে (ইহরাম বেঁধে) নিজের উপর হজ্ব অবধারিত করে নেয় সে হজ্বের সময় কোনো অশ্লীল কথা বলবে না, কোনো গুনাহ করবে না এবং ঝগড়া করবে না। তোমরা যা কিছু সৎকর্ম করবে আল্লাহ তা জানেন।-সূরা বাকারা (২) : ১৯৭


উক্ত আয়াতে তিনটি বিষয় থেকে বিশেষভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এক. ইহরাম অবস্থায় অশ্লীল কথা বলা। এমনকি স্ত্রীর সাথে যৌন উত্তেজনামূলক কথা বলাও নিষিদ্ধ। দুই. কোনো ধরনের গুনাহয় লিপ্ত হওয়া। ইহরাম অবস্থার বিশেষ গুনাহ যেমন শরীরের কোনো স্থানের চুল, পশম বা নখ কাটা, আতর বা সুগন্ধি লাগানো, পশু শিকার করা, শরীরে উকুন মারা থেকে যেরূপ বিরত থাকবে তেমনি সাধারণ অবস্থার গুনাহ যেমন অন্যকে কষ্ট দেওয়া, কু-দৃষ্টি ও গীবত শেকায়েত থেকেও বিরত থাকবে। তিন. ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া।


এ ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা ও ঝগড়া-বিবাদমুক্ত হজ্বকেই হাদীস শরীফে হজ্বে মাবরূর বা মকবুল হজ্ব বলা হয়েছে এবং এর বিশেষ বিশেষ ফযীলত ও মর্যাদা উল্লেখিত হয়েছে। এখানে কিছু ফযীলত বর্ণনা করা হল।


১. হজ্ব পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মুছে দেয়


আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-


من حج فلم يرفث ولم يفسق غفر له ما تقدم من ذنبه.


যে ব্যক্তি হজ্ব করে আর তাতে কোনোরূপ অশ্লীল ও অন্যায় আচরণ করে না তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।-সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৮১১


অন্য বর্ণনায় রয়েছে


من حج لله فلم يرفث ولم يفسق رجع كيوم ولدته أمه.


আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্ব করল এবং অশ্লীল কথাবার্তা ও গুনাহ থেকে বিরত থাকল সে ঐ দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে হজ্ব থেকে ফিরে আসবে যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয়েছিল।

-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৫২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩৫০; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৭৩৮১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৮৮১; সুনানে নাসায়ী ৫/১১৪; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৬৯৪; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৫১৪


অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে-


من حج البيت فقضى مناسكه وسلم المسلمون من لسانه ويده غفر له ما تقدم من ذنبه.


আতা ইবনে ইয়াসার রাহ. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর হজ্ব করে, হজ্বের বিধানগুলো যথাযথভাবে আদায় করে, মুসলমানরা তার মুখ ও হাত থেকে নিরাপদ থাকে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।

-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৮৮১৭; তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৩৫৮


আমর ইবনুল আস রা. বর্ণনা করেন, (দীর্ঘ এক হাদীসে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-


أما علمت يا عمرو! أن الإسلام يهدم ما كان قبله، وأن الهجرة تهدم ما كان قبلها، وأن الحج يهدم ما كان قبله.


হে আমর! তুমি কি জান না যে, ইসলাম (গ্রহণ) পূর্বেকার যাবতীয় পাপকে মুছে ফেলে। হিজরত তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহকে মিটিয়ে দেয় এবং হজ্ব অতীতের পাপসমূহ মুছে দেয়।

-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১২১; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৫১৫; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৭৭৭৭; শরহু মুশকিলিল আছার, হাদীস : ৫০৭


২. হজ্বে মাবরূরের প্রতিদান হল জান্নাত


আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-


العمرة إلى العمرة كفارة لما بينهما، والحج المبرور ليس له جزاء إلا الجنة.


এক উমরা আরেক উমরা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহর ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। আর হজ্বে মাবরূরের প্রতিদান তো জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়।

-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৭৭৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩৪৯; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৭৩৫৪; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৫১৩; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৬৯৫; সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৯৩৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৮৮৮; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ১২৭৮২


আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

تابعوا بين الحج والعمرة، فإنهما ينفيان الفقر والذنوب كما ينفي الكير خيث الحديد، والذهب والفضة، وليس للحجة المبرورة ثواب إلا الجنة.

তোমরা হজ্ব ও উমরা পরপর একত্রে পালন কর। কেননা এ দুটি (হজ্ব ও উমরাহ) দারিদ্র ও গুনাহসমূহ এমনভাবে দূর করে দেয় যেমন কামারের হাপর লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা দূর করে দেয়। আর হজ্বে মাবরূরের বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়।

-সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৮১০; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৩৬৬৯; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ১২৭৮০; সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদীস : ৩৬১০; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৫১২; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৬৯৩; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস : ৪৯৭৬; তবারানী, হাদীস : ১০৪৬০


হযরত জাবির রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

الحج المبرور ليس له جزاء إلا الجنة، قيل : وما بره؟ قال : إطعام الطعام وطيب الكلام.

হজ্বে মাবরূরের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। জিজ্ঞাসা করা হল, হজ্বের সদাচার কী? তিনি বললেন, খানা খাওয়ানো এবং উত্তম কথা বলা (অর্থাৎ অনর্থক ও অশ্লীল কথাবার্তা পরিত্যাগ করা)।


অন্য বর্ণনায় রয়েছে, খানা খাওয়ানো ও বেশি বেশি সালাম করা (সালামের বিস্তার ঘটানো)।

-সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ৩০৭২; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস : ৪১১৯; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৪৪৮২; তবারানী আওসাত ১/১১৩; মুসনাদে আবু দাউদ, ত্বয়ালিসী, হাদীস : ১৭১৮; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৮১২; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৮৮১৭


৩. সর্বোত্তম আমল হজ্বে মাবরূর


হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-


سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم أي العمل أفضل؟ قال : إيمان بالله ورسوله، قيل : ثم ماذا؟ قال : الجهاد في سبيل الله، قيل : ثم ما ذا؟ قال : حج مبرور.


নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হল, সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা। জিজ্ঞাসা করা হল, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। জিজ্ঞাসা করা হল, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, হজ্বে মাবরূর বা কবুল হজ্ব।

-সহীহ বুখারী, হাদীস : ২৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৮৩; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৭৫৯০; সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ১৬৫৮; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ১৫৩; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ২০২৯৬; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস : ৪২১১


মায়িয রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-

سئل : أي الأعمال أفضل؟ قال : إيمان بالله وحده، ثم الجهاد، ثم حجة برة تفضل سائر الأعمال كما بين مطلع الشمس إلى مغربها.

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হল, কোন আমল সর্বোত্তাম? তিনি বললেন, এক আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান আনা। তারপর জিহাদ করা। অতপর কবুল হজ্ব অন্যান্য আমল হতে এত উৎকৃষ্ট ও মর্যাদাপূর্ণ যেরূপ সূর্যের উদয়াচল হতে অস্তাচলের ব্যবধান।

-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৯০১০; তবারানী ২০/৮০৯; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস : ৫২৬৩


এ সম্পর্কিত অন্য একটি দীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আমর ইবনে আবাসা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-


... ثم عملان هما أفضل الأعمال إلا من عمل بمثلهما : حجة مبرور أو عمرة.

অতপর এমন দুটি আমল, যা অন্য সকল আমল হতে শ্রেষ্ঠ। তবে যে ব্যক্তি তার অনুরূপ আমল করে তা ব্যতীত : মকবুল হজ্ব অথবা মকবুল উমরা।

-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৭০৭; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস : ২০১০৭; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস : ৫২৬১


৪. নারী, বৃদ্ধ, দুর্বল ব্যক্তি ও শিশুদের জিহাদ হল হজ্ব ও উমরাহ


উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-


يا رسول الله! نرى الجهاد أفضل العمل، أفلا نجاهد؟ قال : لا، لكن أفضل الجهاد حج مبرور.


ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তো জিহাদকে সর্বোত্তম আমল মনে করি। আমরা কি জিহাদ করব না? তিনি বললেন, না। বরং তোমাদের নারীদের জন্য সর্বোত্তম জিহাদ হল হজ্বে মাবরূর।

-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৫২০; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৪৪২২; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৩৬০৭; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৭০২; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস : ৪৭১৭; শরহু মুশকিলিল আছার, হাদীস : ৫৬০৯


অন্য বর্ণনায় রয়েছে-


আয়েশা রা. বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি আপনাদের সাথে জিহাদ করব না? তিনি বললেন, তোমাদের জন্য সবচেয়ে সুন্দর ও উত্তম জিহাদ হল হজ্বে মাবরূর। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাললাম থেকে এ কথা শুনার পর হতে আমি হজ্ব ছাড়িনি।

-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৮৬১; মুসনাদে আহমদ,  হাদীস : ২৪৪৯৭; সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৪/৩২৬


আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-


إن كان قاله جهاد الكبير والضعيف والمرأة الحج والعمرة.


বৃদ্ধ, দুর্বল ও নারীর জিহাদ হল হজ্ব ও উমরা।

-মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ৯৪৫৯; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৯৭০৯; সুনানে নাসায়ী ৫/১১৩; তবারানী আওসাত, হাদীস : ৮৭৪৬; সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৪/৩৫০


হুসাইন বিন আলী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-


جاء رجل إلى النبي صلى الله عليه وسلم فقال : إني جبان وإني ضعيف، فقال : هلم إلى الجهاد لا شوكة فيه : الحج.


এক ব্যক্তি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বললেন, আমি ভীরু ও দুর্বল (জিহাদে যাওয়ার শক্তি-সামর্থ্য নেই)। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি অস্ত্র ও শত্রুর সাথে লড়াইবিহীন জিহাদ-হজ্ব পালন করতে এস।

-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৮৮০৯; তবারানী, হাদীস : ২৯১০; সুনানে সাঈদ ইবনে মনসূর, হাদীস : ২৩৪২; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস : ৫২৫৮


হজ্ব ও উমরাকারীর দুআ কবুল করা হয়


জাবির রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-


الحجاج والعمار وفد الله دعاهم فأجابوه وسألوه فأعطاهم.


 হজ্ব ও উমরাকারীগণ আল্লাহর প্রতিনিধি দল। তারা দুআ করলে তাদের দুআ কবুল করা হয় এবং তারা কিছু চাইলে তাদেরকে তা দেওয়া হয়।

-মুসনদে বাযযার, হাদীস : ১১৫৩; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস : ৫২৮৮; তবারানী, হাদীস : ১৭২১


ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-


الحجازي في سبيل الله، والحاج والمعتمر وفد الله دعاهم فأجابوه وسألوه فأعطاهم.


আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী (গাযী), হজ্ব ও উমরা আদায়কারীগণ আল্লাহর প্রতিনিধি দল। তারা দুআ করলে দুআ কবুল করা হয় এবং তারা কিছু চাইলে তাদেরকে তা দেওয়া হয়।

-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৮৯৩; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৪৬১৩


আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-


وفد الله ثلاثة :الغازي والحاج والمعتمر


তিন প্রকারের লোক আল্লাহ তাআলার প্রতিনিধি : গাযী, হজ্ব ও উমরাকারী।

-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৬৯২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৫১১; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৬৫৩; সুনানে নাসায়ী ৫/১১৩; সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৫/২৬২


৬. হাজীদের গুনাহ মাফ হয় এবং তারা যাদের গুনাহ ক্ষমা চায় তাদেরকে মাফ করা হয়


আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-


يغفر الله للحاج ولمن استغفر له الحاج.


আল্লাহ তাআলা হাজীদের গুনাহ ক্ষমা করেন এবং হাজী যাদের জন্য ক্ষমা প্রর্থনা করেন, তাদেরকেও ক্ষমা করেন। 

-মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ১১৫৫; তবারানী সগীর, হাদীস : ১০৮৯; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৫১৬; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৬৫৪


অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হজ্ব ও উমরাকারীগণ যখন দুআ করে, তাদের দুআ কবুল করা হয়। তারা যখন কারো জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদেরকে ক্ষমা করা হয়। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৮৯২;

 সুনানে নাসায়ী, ৫/১১৩


৭. হজ্ব ও উমরার জন্য খরচ করার ফযীলত


আয়েশা রা. হতে বর্ণিত-


أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لها في عمرتها : إن لك من الأجر على قدر نصبك ونفقتك.


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমরা করার সময় তাকে তার উমরা সম্পর্কে বলেছেন, তুমি তোমার পরিশ্রম ও খরচ অনুপাতে নেকি পাবে।

-মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ১৭৭৬; সুনানে দারাকুতনী, ২/২৮৬


আয়েশা রা. হতে অন্য বর্ণনায় আছে রয়েছে তুমি তোমার উমরার সওয়াব তোমার খরচ অনুপাতে পাবে।

-মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ১৭৭৭; সুনানে দারাকুতনী, ২/২৮৬


বুরাইদা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-


النفقة في الحج كالنفقة في سبيل الله بسبع مائة ضعف.


হজ্বের জন্য খরচ করা, আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার মতই, যার সওয়াব সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।

-মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ২৩০০০; শুয়াবুল ঈমান বাইহাকী, হাদীস : ৪১২৫; তবারানী আউসাত, হাদীস : ৫২৭০


অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আনাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-


الحج سبيل الله، النفقة فيه الدرهم بسبع مائة.


হজ্ব হল আল্লাহর রাস্তা। তাতে (আল্লাহর রাস্তায়) এক দিরহাম খরচের সওয়াব সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।-তবারানী, আউসাত, হাদীস : ৫৬৯০


জাবির রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন-


ما أمعر حاج قط، قيل لجابر : ما الإمعار؟ قال : ما افتقر.


কোন হজ্বকারী ব্যক্তি নিঃস্ব হয় না। জাবের রা.কে ইমআর শব্দের উদ্দেশ্য কী জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, অভাব-অনটন। 

-মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ১০৮০; তবারানী আউসাত, হাদীস : ৫২০৯


ইবনে ওমর রা. বলেন, আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-


ما ترفع إبل الحاج رجلا ولا تضع يدا إلا كتب الله بها حسنة أو محا سيئة أو رفع بها درجة.


হজ্বে গমনকারী ব্যক্তির উট চলার পথে যখনই পা উঠায় এবং পা রাখে এর বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা ঐ হজ্ব কারীদের জন্য সওয়াব লিখে দেন। অথবা তার একটি করে গুনাহ মুছে দেন অথবা তার একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন।


৮. হজ্ব ও উমরা পালনকালে মৃত্যুবরণকারীর ফযীলত


ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত-


بينما رجل واقف مع رسول الله صلى الله عليه وسلم بعرفة إذ وقع عن راحلته فأقعصته، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : اغتسلوه بماء وسدر، وكفنوه بثوبيه ولا تخمروا رأسه ولا تخطوه، فإنه يبعث يوم القيامة ملبيا.


এক ব্যক্তি আরাফাতের ময়দানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে উফূফরত ছিলেন। হঠাৎ তিনি বাহন থেকে নীচে পড়ে গেলেন। এতে তার ঘাড় মটকে গেল এবং তিনি মারা গেলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে বড়ইপাতা সিদ্ধকরা পানি দিয়ে গোসল দাও, তার দুই কাপড় দিয়ে তাকে কাফন পরাও। তাকে সুগন্ধি লাগিও না এবং তার মাথাও আবৃত করো না। কেননা তাকে কিয়ামতের দিন তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উঠানো হবে।

-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১২৬৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১২০৬; সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৯৫১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ৩০৮৪


আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-


من خرج حاجا فمات كتب له أجر الحاج إلى يوم القيامة، ومن خرج معتمرا فمات كتب له أجر المعتمر إلى يوم القيامة، ومن خرج غازيا فمات كتب له أجر الغازي إلى يوم القيامة.


যে ব্যক্তি হজ্বের উদ্দেশ্যে বের হল, অতঃপর মৃত্যুবরণ করল, কিয়ামত পর্যন্ত তার হজ্বের সওয়াব লেখা হবে। আর যে ব্যক্তি উমরার উদ্দেশ্যে বের হল, আর সে অবস্থায় তার মৃত্যু হল কিয়ামত পর্যন্ত তার জন্য উমরার সওয়াব, লেখা হবে। যে ব্যক্তি জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হল, এবং তাতে তার মৃত্যু হল, কিয়ামত পর্যন্ত তার জন্য মুজাহিদের সওয়াব লেখা হবে।

-মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস : ৬৩৫৭; তবারানী আউসাত, হাদীস : ৫৪৮০; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস : ৫২৭৪


৯. তালবিয়া পাঠ ও উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠের ফযীলত


আবু বকর সিদ্দীক রা. হতে বর্ণিত-


أن النبي صلى الله عليه وسلم سئل : أي الحج أفضل؟ قال : الحج والثج.

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, কোন হজ্ব সর্বোত্তম? তিনি বললেন, যে হজ্বে উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করা হয় এবং কুরবানী করা হয়।

 -সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৮২৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৯২৪; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৬৩১; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৬৯৭; সুনানে দারিমী, হাদীস : ৮১৫১; মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ৭১; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস : ১১৭


সাহল ইবনে সা’দ রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-


ما من مسلم يلبي إلا لبى من عن يمينه أو عن شماله من حجر أو شجر أو مدر حتى تنقطع الأرض من هاهنا إلى هاهنا.


যে কোনো মুসলমান তালবিয়া পাঠ করল, তার তালবিয়া পাঠের অনুসরণে তার ডান ও বামের বৃক্ষরাজি সবকিছুই তার সাথে তালবিয়া পাঠ করে, যতক্ষণ না যমীন তার এদিক তথা ডান ও বাম পার্শ্ব হতে ধ্বংস হয়ে যায়। 

-সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৮২৮; সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৯২১; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৬৩৪; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৬৯৮; সুনানে কুবরা, বাইহাকী, ৫/৪৩


খাল্লাদ ইবনে যায়েদ, তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-


أتاني جبريل فأمرني أن أمر أصحابي أن يرفعوا أصواتهم بالإهلال والتلبية.

আমার নিকট জিব্রীল আ. আগমন করে এ মর্মে আদেশ করেছেন, আমি যেন আমার সাহাবীদের হুকুম করি যে, তারা তালবিয়া পাঠ করার সময় যেন উচ্চস্বরে পাঠ করে। 

-মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ১৬৫৫৭; সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৮২৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৯২২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৬২৫; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৮০২; তবারানী, হাদীস : ৫১৭৩; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৬৯৪


আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-


أمرني جبريل برفع الصوت في الإهلال، فإنه من شعار الحج.


হযরত জিবরাইল আ.আমাকে উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠের আদেশ করেছেন। কেননা তা হজ্বের নিদর্শন। 

-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৮৩১৪; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৬৩০


যায়েদ ইবনে খালেদ রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-


جاءني جبريل فقال : يا محمد مر أصحابك فليرفعوا أصواتهم بالتلبية، فإنها من شعار الحج.

জিবরাইল আ. এসে আমাকে বললেন, হে মুহাম্মাদ! আপনার সাহাবীদের হুকুম করেন, তারা যেন তালবিয়া পাঠ করার সময় উচ্চস্বরে পাঠ করে। কেননা তা হজ্বের নিদর্শন। 

-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২১৬৭৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৯২৩; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৬২৮; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৮০৩; তবারানী কাবীর, হাদীস : ৫১৭০; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৬৯৫


আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-


ما أهل ومهل قط إلا بشر، ولا كبر مكبر قط إلا بشر، قيل يا رسول الله صلى الله عليه وسلم بالجنة؟ قال : نعم.


যে কোনো ব্যক্তি তালবিয়া পাঠ করলেই তাকে সুসংবাদ দেওয়া হয় এবং যে কোনো ব্যক্তি তাকবীর বললেই তাকে সুসংবাদ দেওয়া হয়। জিজ্ঞাসা করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! জান্নাতের (সুসংবাদ দেওয়া হয়)? তিনি বললেন, হ্যাঁ।

-তবারানী আউসাত, হাদীস :৭৯৪৩; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস : ৫৩৭১


আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে কোনো ব্যক্তি তালবিয়া পাঠ করে, সে দিনই (সূর্যাস্তের সাথে সাথে) তার গুনাহ মাফ হয়ে যায়।-

শুয়াবুল ঈমান বায়হাকী, হাদীস : ৪০২৯


১০. বাইতুল্লাহ তাওয়াফের ফযীলত


ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-


من طاف أسبوعا يحصيه وصلى ركعتين كان له كعدل رقبة قال وسمعته يقول : ما رفع رجل قدما ولا وضعها إلا كتب له عشر حسنات وحط عنه عشر سئيات ورفع له عشر درجات.

যে ব্যক্তি যথাযথভাবে সাতবার বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করে এবং দুই রাকাত সালাত আদায় করে তার একটি গোলাম আযাদ করার সমান সওয়াব হয়। তাওয়াফের প্রতি কদমে আল্লাহ তার একটি করে গুনাহ মাফ করেন, একটি করে নেকী লেখেন এবং দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।

 -মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৪৪৬২; সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৯৫৯; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৭৫৩; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৮৪২; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস : ৫৬৮৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস : ১২৮০৬


মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-


من طاف اسبوعا لا يلغو فيه كان كعدل رقبة يعتقها.


যে ব্যক্তি সাতবার বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে, তাতে কোনো ধরনের অনর্থক কাজ করবে না, তবে তার একটি গোলাম আযাদ করার সমপরিমাণ সওয়াব হবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস : ১২৮০৭; তবারানী, হাদীস : ৮৪৫; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস : ৫৫০৪


ইবনে আববাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-


ينزل الله كل يوم على حجاج بيته الحرام عشرين ومائة رحمة : ستين للطائفين وأربعين للمصلين وعشرين للناظرين.


আল্লাহ তাআলা বায়তুল্লাহর হজ্বকারীদের উপর প্রতিদিন একশত বিশটি রহমত নাযিল করেন, তার ষাটটি তাওয়াফকারীদের জন্য, চল্লিশটি মুসল্লীদের জন্য এবং বিশটি দর্শকদের জন্য।

-শুয়াবুল ঈমান বায়হাকী, হাদীস : ৪০৫১; তারগীব ১৭৮৬


১১. হাজরে আসওয়াদ ও রূকনে ইয়ামানী স্পর্শ করার ফযীলত


ইবনে ওমর রা. বর্ণনা করেন-

سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : إن مسحهما كفارة للخطايا.

আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, হাজরে আসওয়াদ ও রূকনে ইয়ামানীর স্পর্শ পাপসমূহকে মুছে দেয়।

-সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৯৫৯; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৫৭০১; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৭২৯; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৮৪২


ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-


والله ليبعثه الله يوم القيامة له عينان يبصر بهما، ولسان ينطق به ويشهد على من استلمه بحق.

অবশ্যই আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন হাজরে আসওয়াদকে উঠাবেন। তার দুটি চোখ থাকবে, যা দিয়ে সে দেখতে পাবে। একটি জিহবা বা মুখ থাকবে, যা দিয়ে সে কথা বলবে এবং যারা তাকে যথার্থভাবে স্পর্শ করেছে তাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। 

-সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৯৬১; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২২১৫; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৭০৪; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৭২৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৯৪৪; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ১৭২৩


ইবনে আববাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হাজরে আসওয়াদ হল জান্নাতের পাথর, তা দুধের চাইতেও বেশি সাদা ছিল, কিন্তু আদমসন্তানের গুনাহ একে কালো করে দিয়েছে। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৮৭৭; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৭৩০; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ২৯২৫


অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হাজরে আসওয়াদ বরকের চাইতে সাদা ছিল, কিন্তু শিরকপন্থীদের পাপ তাকে কালো বানিয়ে ফেলেছে। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৭৯৫; শুয়াবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস : ৪০৩৪


আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-


إن الركن والمقام ياقوتان من ياقوت الجنة طمس الله نورهما ولولم يطمس نورهما لأضاء تاما بين المشرق والمغرب.

হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবারাহীমী জান্নাতের দুটি ইয়াকুত পাথর। এ দুটির জ্যোতি আল্লাহ তাআলা নিস্প্রভ করে দিয়েছেন। তিনি যদি এ দুটির জ্যোতি নিস্প্রভ না করতেন, তাহলে তা পূর্ব-পশ্চিমের মাঝে যা কিছু আছে সব আলোকিত করে দিতো।

 -মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৭০০০; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৭১০; সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৮৭৮; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৭৩২; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ১৭০২


ইয়াওমে আরাফার ফযীলত


অব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إن الله عز وجل يباهي ملائكته عتيبة عرفة بأهل، فيقول : انظروا إلى عبادي أتوني شعثا غبرا.


আরাফার অধিবাসীদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করেন এবং তাদেরকে বলেন, তোমরা আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখ, তারা এলোমেলো চুলে, ধূলোমলিন অবস্থায় আমার কাছে এসেছে।

 -মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৭০৮৯; তাবরানী, হাদীস : ৫৭৫; মাযমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস : ৫৫৪৬


অনুরূপ হাদীস হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত হয়েছে,- মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ৮০৪৭;  মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ১৭৫১; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৮৩৯; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৮৫২


আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-


ما من يوم أكثر من أن يعتق الله فيه عبدا من النار من يوم عرفة وأنه ليدنو ثم يباهي بهم الملائلكة فيقول : ما راء هؤلاء.


আরাফার দিন অপেক্ষা এমন কোনো দিন নেই যেদিন আল্লাহ তাআলা অত্যাধিক পরিণামাণে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন এবং তিনি নিকটবর্তী হন। আর ফেরেশতাদের নিকট তাদেরকে নিয়ে গর্ব করে বলেন, এরা কি চায়?

-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩৪৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ৩০১৪; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৯২৬; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৬/২৫১।


আরও খবর



আমি সুইসাইড করার মতো মেয়ে নই

প্রকাশিত:মঙ্গলবার ২০ মে ২০25 | হালনাগাদ:বুধবার ২১ মে ২০২৫ |

Image

সোমবার রাতে হঠাৎই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে চিত্রনায়িকা পরীমনির মৃত্যুর গুজব। এরপর রাতেই নিজের ফেসবুক পেজে লাইভে এসে জানান দেন বেঁচে আছেন তিনি। কেবল তাই নয়, মানুষের এমন উদ্ভট কর্মকাণ্ড নিয়ে দারুণ বিরক্ত এই নায়িকা।

ফেসবুক লাইভে পরীমনি বলেন, সারা দিন শুটিং করে যখন ফোন হাতে নিলাম, আমি শকড। ফোনকলের চেয়ে বেশি মেসেজ। ধরেন, আপনার কোনো আত্মীয়র মৃত্যুর খবর শুনলেন, আপনি সেই আত্মীয়কেই ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বেঁচে আছেন? যেকোনোভাবে গুজবটা ছড়িয়েছে, আমার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আমার জন্য কতটা শকিং!

এই অভিনেত্রী বলেন, মৃত্যু তো আসলে আমার হাতে নেই। আপনি তো জানেন না, কখন চলে যাবেন। আল্লাহর কাছে স্বাভাবিক মৃত্যু চাই সব সময়।

‘পরীমণির যদি অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়, তবে ধরে নিতে হবে তাকে কেউ খুন করেছে’,- ভক্তদের এ তথ্য জানিয়ে পরীমনি বলেন, এই যে আমার ঝুলন্ত মরদেহটা উদ্ধার করল, তারপরও লাইভে এসে কথা বলছি আপনাদের সঙ্গে। কোনো একটা ফোকাস সরানোর জন্য মানুষ পরীমনিকেই বেছে নেয়। আলুর দাম কমাতে পারছে না বলে পরীমনির বিয়ের খবর করে দাও। এখন বিয়ে দিতে পারছে না বলে একদম মেরে ফেলল।

‘পরীমণি আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে না’, তা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়ে এই অভিনেত্রী বলেন, আমি সুইসাইড করার মতো মেয়ে না। আমার জীবনে এখন সুইসাইড করার মতো কোনো ইস্যুই নাই। আমার দুইটা বাচ্চা নিয়ে, কাজ নিয়ে অনেক খুশি। এই খুশির মধ্যে আপনাদের জীবনযাপন ঢুকিয়ে দেবেন না। কিছু হইলে খালি পরীমনিকে নিয়ে টানাটানি কেন? আর কিছু খুঁজে পান না?


আরও খবর



বাঁধ নিয়ে থামেনি বিতর্ক বিরোধ দোষারোপ

প্রকাশিত:শনিবার ০৩ মে ২০২৫ | হালনাগাদ:মঙ্গলবার ২০ মে ২০25 |

Image

ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে বেশিদিন ধরে অস্বস্তির কারণ হয়ে থেকেছে যে বিষয়টি, সেটি নিঃসন্দেহে ফারাক্কা বাঁধ। ভারতে এটির পোশাকি নাম ‘ফারাক্কা ব্যারাজ প্রজেক্ট’, এবং বহু আলোচনা ও বিতর্ক পেরিয়ে চলতি বছরের এই মে মাসে প্রকল্পটি পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করছে।

বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান অভিযোগ ছিল এই ফারাক্কার ফলেই প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে গেছে। অন্য দিকে ভারত বরাবর যুক্তি দিয়ে এসেছে কলকাতা বন্দরকে রক্ষা করার জন্য ফারাক্কা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না!

ফারাক্কা চালু হওয়ার দু’দশকেরও বেশি সময় পর ১৯৯৬-এ ভারত ও বাংলাদেশ যে ঐতিহাসিক গঙ্গা জলচুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে অবশ্য ভাগীরথী ও পদ্মায় গঙ্গার জল ভাগাভাগি নিয়ে একটা ফর্মুলায় দুই দেশ একমত হতে পেরেছিল।

তিরিশ বছর মেয়াদি সেই চুক্তির কার্যকালও প্রায় শেষের পথে, চুক্তির নবায়ন নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে। তবে ফারাক্কা নিয়ে বিতর্ক, বিরোধ বা দোষারোপের পালা কিন্তু কখনওই থামেনি।

তবে ফারাক্কার জন্যই পদ্মার দু’কূলে মানুষের জীবন-জীবিকা আজ বিপন্ন বলে যেমন বাংলাদেশের অভিযোগ – তেমনি ভারতেও কিন্তু ফারাক্কার সমালোচনা কম নয়।

যেমন মাত্র কয়েক বছর আগেই ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে দেওয়ারও দাবি তুলেছিল বিহার সরকার, যে রাজ্যটির অভিযোগ প্রতি বছর ফারাক্কার কারণেই তাদের বন্যায় ভুবতে হয়। ফারাক্কার উজানে ও ভাঁটিতে গঙ্গার ভাঙনও ওই এলাকার মানুষের জন্য খুব বড় সমস্যা।

তা ছাড়া অনেক বিশেষজ্ঞই মানেন কলকাতা বন্দরকেও সেভাবে বাঁচাতে পারেনি ফারাক্কা – যে কারণে উপকূলের কাছে তৈরি করতে হয়েছিল আর একটি স্যাটেলাইট বন্দর হলদিয়া।

তাহলে আজ ৫০ বছর পরে এসে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারত ঠিক কী ভাবছে? পাশাপাশি, ফারাক্কা প্রকল্পটাতেই বা তখন ঠিক কী করা হয়েছিল এবং সেগুলো কী ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করেছে?

ফারাক্কা ব্যারাজ প্রোজেক্ট বা এফবিপি-র সার্ধশর্তবর্ষপূর্তিতে সরেজমিনে ফারাক্কা ও আশেপাশের এলাকায় এবং কলকাতা বন্দরে গিয়ে ঠিক এই বিষয়গুলোতেই নজর দিয়েছে বিবিসি বাংলা – এই প্রতিবেদনে থাকছে তারই সারাংশ।

ফারাক্কা প্রকল্পটা আসলে ঠিক কী?

এক কথায় বলতে গেলে, ফারাক্কা হলো গঙ্গায় বাঁধ দিয়ে ও কৃত্রিম খাল কেটে পদ্মার দিক থেকে জলের প্রবাহ ভাগীরথীর দিকে সরিয়ে আনা – যাতে কলকাতা বন্দরকে বাঁচিয়ে রাখা যায়!

প্রকল্পের বর্তমান প্রধান, টেকনোক্র্যাট আর ডি দেশপান্ডের বলতে কোনো দ্বিধা নেই, ‘যে লক্ষ্য সামনে রেখে ফারাক্কা তৈরি করা হয়েছিল, আমরা জোর গলায় বলতে পারি সেটা পুরোপুরি সফল হয়েছে। কলকাতা বন্দর যে আজও টিঁকে আছে, তা ফারাক্কার জন্যই!’

আসলে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে নির্মিত এই প্রকল্পটির মূল লক্ষ্যই ছিল গঙ্গার প্রবাহ থেকে অতিরিক্ত জল ভাগীরথীতে সরিয়ে আনা ও তার মাধ্যমে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানো – যার জন্য কাটা হয়েছিল প্রায় ৪০ কিলোমিটার লম্বা একটি ‘লিঙ্ক ক্যানাল’ বা কৃত্রিম খাল।

ফারাক্কা ব্যারাজ প্রকল্পর সুন্দর সাজানো গোছানো টাউনশিপে নিজের বাতানুকূল অফিসঘরে বসে আর ডি দেশপান্ডে বিবিসিকে বলছিলেন, পদ্মা নয়, গঙ্গার মূল প্রবাহ আগে ভাগীরথী দিয়েই যেত – ফারাক্কা শুধু সেই ‘পুরনো ইতিহাস’কেই কিছুটা ফিরিয়ে এনেছে।

তিনি জানাচ্ছেন, ‘গঙ্গোত্রী থেকে উৎপন্ন হয়েছে যে পবিত্র গঙ্গা নদী, সাতশো বছর আগেও তার পুরো প্রবাহটা কিন্তু এখনকার ভাগীরথী-হুগলী দিয়েই যেত আর মোহনায় তা সাগরদ্বীপের কাছে গিয়ে মিশত – ওটাই গঙ্গার আসল মোহনা ছিল বলে সেই তীর্থের নাম হয়েছিল গঙ্গাসাগর।’

‘তখন পদ্মা ছিল গঙ্গার একটা ছোট শাখানদী। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে সেই প্রবাহ পদ্মার দিকে সরতে থাকে।’

‘ফলে ব্রিটিশ আমলে যখন দেখা গেল তাদের জাহাজ কলকাতা বন্দরে ন্যূনতম ড্রাফটও পাচ্ছে না, তখন ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার আর্থার কটন গঙ্গা থেকে সম্ভাব্য দুটো জায়গায় – রাজমহল বা ফারাক্কায় – খাল কেটে ভাগীরথীতে জল টানার প্রস্তাব দেন।’

ফারাক্কা থেকে খাল কাটলে দৈর্ঘ্য অনেক কম হবে বলে অবশেষে ফারাক্কাকেই এই কাজের জন্য বেছে নেওয়া হয়।

স্বাধীন ভারতে ১৯৬১ সালে অবশেষে সেই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, আর ১৯৭৫ সালে এসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ করেন ফারাক্কা ব্যারাজ।

প্রকল্পের কাজ অবশ্য তারও বছরকয়েক আগেই প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ফারাক্কার কমিশনিং পিছিয়ে দিয়েছিল বলে অনেকেই মানেন।

ফারাক্কার কাজ যখন শুরু হয়, তখন গঙ্গার ভাঁটিতে ছিল ‘শত্রু দেশ’ পূর্ব পাকিস্তান – কিন্তু রাতারাতি সেখানে একটি ‘বন্ধু দেশ’ চলে আসার ফলে ফারাক্কায় একতরফাভাবে গঙ্গা থেকে জল প্রত্যাহার ভারতের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছিল।

যদিও অবশেষে ১৯৭৫-এর গোড়ায় এসে ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসতে সক্ষম হন – ঠিক হয় এপ্রিল-মে মাসে প্রতি দশদিন অন্তর গঙ্গা থেকে পরীক্ষামূলকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ জল সরানো হবে। সেই ‘পরীক্ষা’ অবশ্য পরেও আরও বহু বছর ধরে চলতে থাকে।

সে বছরের মে মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে ফারাক্কার উদ্বোধন করেন দেশের সেচমন্ত্রী জগজীবন রাম, পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে যা কয়েক কোটি কিউসেক বাড়তি জল কলকাতায় এনে ফেলেছে!

ভূতাত্ত্বিক ও নদী গবেষক ড. পার্থসারথি চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘কলকাতা বন্দরে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত কিন্তু আমাদের নাব্যতা (নেভিগেবিলিটি) ছিল, ২৬ ফুট ড্রাফট ছিল। এবং তাতে ২৯১ দিন এই বন্দরে জাহাজ ঢুকত, মানে ওই ২৬ ফুট ড্রাফটের জাহাজ ঢুকত। ১৯৬০ সালের পর থেকে কিন্তু মারাত্মক অবস্থা হয়।’

‘এখন এই ফারাক্কা অঞ্চল কেন? ফারাক্কা অঞ্চলকে ব্যারাজ করার জন্য বাছা হলো, তার কারণ সেখানে একশো বছরের মধ্যে নদী নড়াচড়া করেনি, তার ব্যাঙ্কের মধ্যেই ছিল। এবং ওই ব্যারাজটা ওইখানে করলে, জলটা, ব্যারাজটার ঠিকমতো স্টেবিলিটি থাকবে।’

তিনি আরও জানাচ্ছেন, ফারাক্কায় এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, যাতে কলকাতায় সম্পূর্ণ ‘সিল্ট-ফ্রি’ বা পলিমুক্ত জল সরবরাহ করা যায়।

ড. পার্থসারথি চক্রবর্তী বলেন, তার জন্য ওখানে ‘ছাঁকনি’ দেওয়া আছে, যে কারণে ফারাক্কার জল কলকাতায় পানীয় জল হিসেবেও সাপ্লাই দেওয়া হয়।

ফলে ১০০০ মাইলেরও বেশি পথ পেরিয়ে উত্তর ভারতের ‘লাইফলাইন’ গঙ্গা ফারাক্কাতে এসে ব্যারাজের বাধায় বাঁধা পড়েছে – আর সেখানে মোট ১০৯টি লকগেটেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নদীর জলের প্রবাহ।

আর ফারাক্কাতে নদীর ডান দিক থেকে কাটা হয়েছে ৩৮.৩ কিলোমিটার লম্বা ভাগীরথী ফিডার ক্যানাল, যা জঙ্গীপুরের কাছে ভাগীরথীতে গিয়ে মিশেছে এবং পরে সেই নদী হুগলী নামে পরিচিতি পেয়েছে।

এককালের ছোট্ট গ্রাম ফারাক্কাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে একটি আধুনিক উপনগরী, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণপ্রান্তের মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগও স্থাপন করেছে ব্যারাজের ওপর দিয়ে তৈরি ট্রেনলাইন ও রাস্তা।

ক্যানালের জলে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে, এমন কী ইলিশও! ভারতে হলদিয়া থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ‘১ নম্বর জাতীয় জলপথে’রও অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই ক্যানাল।

আশির দশকে ফারাক্কাতে এনটিপিসি-র যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়, তারাও ব্যবহার করে এই ক্যানালের জল। ভাঁটির দিকে মুর্শিদাবাদের সাগরদীঘিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, তারাও এই জলের ওপর নির্ভরশীল।

সব মিলিয়ে ফারাক্কা শুধুমাত্র একটি বাঁধ ও খালই নয়, এই প্রকল্পকে ঘিরে গত পঞ্চাশ বছরে একটা বিরাট ক্যানভাসই আঁকা হয়ে গেছে বলা চলে – যাকে বিশেষজ্ঞরা ‘ফারাক্কা ইকোসিস্টেম’ নামে বর্ণনা করে থাকেন।

ফারাক্কা নিয়ে ভারতেও এতো বিতর্ক কেন?

ফারাক্কার প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে ভারতেও অনেক বিশেষজ্ঞ সন্দিহান ছিলেন। তবে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানোর যুক্তিটা এতটাই প্রবল ছিল যে সেই সব আপত্তি বিশেষ ধোপে টেঁকেনি।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ বিভাগের একজন শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশলী, কপিল ভট্টাচার্য তো ফারাক্কার বিরোধিতা করে সরকারি চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন।

ফারাক্কা প্রকল্প কেন বিপজ্জনক, তার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি অনেক লেখালেখিও করেছেন। পরবর্তী জীবনে কপিল ভট্টাচার্য অ্যাক্টিভিস্টে পরিণত হন, যুক্ত ছিলেন মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের সঙ্গেও।

১৯৮৯ সালে মি ভট্টাচার্যের মৃত্যুর ২৭ বছর পর, ২০১৬ সালে বিহারের রাজ্য সরকার ফারাক্কা বাঁধ ‘তুলে দেওয়ার জন্য’ কেন্দ্রের কাছে আনুষ্ঠানিক দাবি জানায়।

তখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করে যুক্তি দিয়েছিলেন, ফারাক্কার জন্যই তার রাজ্য প্রতি বছর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে – অতএব বাঁধটাই তুলে দেওয়া হোক!

নীতীশ কুমার তখন প্রকাশ্যেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘গঙ্গায় খুব বেশি পলি পড়ছে বলেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’

‘আর যখন থেকে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি হয়েছে তখন থেকেই এই অবস্থা। নইলে আগে নদীর প্রবাহের সঙ্গে অনেকটা পলি বঙ্গোপসাগরে চলে যেত, সমুদ্রে গিয়ে মিশত।’

দশ-বারো বছর ধরে ফারাক্কার ‘প্যাটার্ন’ স্টাডি করেই এ মন্তব্য করছেন, তখন এ কথাও জানিয়েছিলেন তিনি।

নীতীশ কুমার আজও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, তবে যে কোনো কারণেই হোক ফারাক্কা বিরোধিতার সুর তিনি অনেক স্তিমিত করে ফেলেছেন। এই মুহূর্তে তিনি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক সঙ্গীও।

তবে ফারাক্কার উজানে ঝাড়খন্ড-বিহারের সীমান্ত এলাকায় গিয়েও দেখেছি, সেখানে আমজনতারও এই বাঁধকে নিয়ে বিস্তর অভিযোগ - বর্ষাতে যেমন, তেমনি শুকনা মৌসুমেও!

বিহারের আহমদাবাদ গ্রামের বাসিন্দা ওয়াহিদ শেখের কথায়, ‘বর্ষার সময় ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়া উচিত, নইলে বিহারবাসীর খুব দুর্দশা! অথচ বর্ষার সময়ই গেট বন্ধ রাখে, নদী ওভারফ্লো করলে তখনই গিয়ে গেট খোলে – যখন বিহার ডুবে গেছে! বর্ষার মৌসুম এলেই যদি গেট খুলে দেয়, তাহলে বিহার একটু স্বস্তি পাবে!’

ঝাড়খন্ডের সাহেবগঞ্জ জেলায়, গঙ্গাতীরের লাধোপাড়া গ্রামের মিশির শেখ আবার বলছিলেন, রাজমহলের ওপারে গঙ্গা যদি দেখেন – গরমে নদী তো একদম শুকিয়ে যায়!

‘ছোট একটা নালার মতো গঙ্গা বইতে থাকে, বাকি পুরোটা শুকিয়ে যায়। এখন সব জল (বাংলাদেশে) ছেড়ে দিলে কোনো ফসলই হবে না, কিষাণ তো না খেয়ে মরবে!’

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায় ফারাক্কা অঞ্চলে বাঁধের প্রভাব নিয়ে ফিল্ড স্টাডি ও গবেষণা করেছেন – এ ব্যাপারে তারও মিশ্র অভিজ্ঞতা।

‘ফারাক্কায় নদীর বুকেও চর পড়েছে, মাঝনদীতে বক দাঁড়িয়ে আছে এটাও যেমন দেখেছি – তেমনি গঙ্গার বিধ্বংসী ভাঙনে পারের মানুষের জীবন ছারখার হয়ে যেতেও দেখেছি’, বলছিলেন তিনি।

সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, এই নদীর যে প্যাটার্নের চেঞ্জটা, ইটসেল্ফ নদীটার মধ্যে, তার দুই পারে সবটারই ওপরে একটা ইমপ্যাক্ট ফেলেছে ফারাক্কা ব্যারাজ। ডেফিনিটলি। তার পজিটিভগুলো আমরা পেয়েছি, নেগেটিভগুলোও আমরা দেখতে পাচ্ছি।

ফারাক্কাতে তার শেষ ফিল্ড স্টাডিতে স্থানীয় গ্রামবাসীরা ফারাক্কা বাঁধকে তুলনা করেছিলেন একটা সাপের মাথা চেপে ধরার সঙ্গে!

‘এমনিভাবে দেখাল যে, একটা সাপ রয়েছে তার মুখটা আপনি চেপে ধরলেন – মানে মাথাটা, তাহলে সে তো দেখবেন ছটফট করছে বেরোনোর জন্য।’

‘অ্যাজ ইফ ব্যারাজটা যেন একটা সাপের মুখটা চেপে ধরার মতো জিনিস – এবং নদী তখন, নদীর কোর্সটা তো পাল্টাচ্ছে – সে আর একভাবে যেতে পারছে না, সে যেহেতু রেস্ট্রিক্টেড, বাউন্ডেড ... তাই সে আরও বেশি করে ... প্যাটার্নটা, কার্ভসগুলো আরও বেশি হচ্ছে, ছটফট করার মতো ... ওরা সুন্দর একটা এক্সপ্ল্যানেশন দিয়েছিল’, জানাচ্ছেন তিনি।

ফারাক্কার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আবার জানাচ্ছেন, নদীর ভাঙন ঠেকাতে না-পারলে ফারাক্কা অচিরেই তাদের জন্য চরম সর্বনাশ ডেকে আনবে!

ফারাক্কা আসনের এমএলএ (বিধায়ক) মনিরুল ইসলাম বিবিসিকে বলছিলেন, ফারাক্কার জন্য আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাটা অবশ্যই ভালো হয়েছে। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের মেলবন্ধন এটা তৈরি করেছে ঠিক, কিন্তু আমাদের আপিল কি গঙ্গার ড্রেজিং-টা করে দিলে আমরা কিন্তু বিপদমুক্ত হব আর কী!

‘এই ড্রেজিং না করলে আগামী পঞ্চাশ বছর বলছেন কেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমরা নদীর গর্ভে চলে যাব। তো আমাদের কাছে ব্যারাজ একরকম অভিশাপের কারণ হয়েও দাঁড়িয়ে গেছে আর কী!’

তিনি আরও বলছিলেন, মুর্শিদাবাদের মোরগ্রাম থেকে নিয়ে আপনার মালদা পর্যন্ত আমাদের এই ভৌগোলিক অবস্থানটা দেখবেন – আমরা একটা সরু রাস্তার ওপর বাস করছি। ওদিকে ঝাড়খন্ড, এদিকে নদী, বাংলাদেশ – এইটুকুনটা!

‘তাই আমাদের হাজার হাজার একর যে নদীর গর্ভে গিয়েছে, মাঝনদীটাকে যদি ড্রেজিং করে পাথর দিয়ে বেঁধে দেয় আর কী, তাহলে অনেক লোক ওখানে চাষবাস করে, বাড়িঘর করে থাকতে পারবে’, কেন্দ্রের কাছে দাবি জানান তিনি।

তবে ফারাক্কা নিয়ে এরকম অনেক বিতর্ক থাকলেও বাঁধ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে কাজ কিন্তু বিশেষ এগোয়নি!

ফারাক্কা বাঁধ ‘ডিকমিশন’ করতে নীতিশ কুমার প্রস্তাব দেওয়ার পর দেশের জলসম্পদ মন্ত্রণালয় কিন্তু একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করেছিল – যাতে কেন্দ্রের তরফে পাঁচজন আর বিহার সরকারের তরফে পাঁচজন সদস্য ছিলেন।

সেই কমিটিতে বিহারের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন দেশের সুপরিচিত নদী বিশেষজ্ঞ ও গবেষক হিমাংশু ঠক্কর।

হিমাংশু ঠক্কর বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব ছিল ফারাক্কা বিহারের ওপর ঠিক কী প্রভাব ফেলেছে, তা নিরূপণ করা’

‘কিন্তু ফারাক্কা হওয়ার আগে ও পরে নদীতে ড্রেইনেজ কনজেসশন কী, বন্যার তীব্রতা ও কত ঘন ঘন বন্যা হয়েছে, নদীর ধারণক্ষমতা কত, সে সব ব্যাপারে সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন আমাদের কোনো তথ্য-উপাত্তই দেয়নি, ফলে আমরাও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।’

তবে ফারাক্কার ‘বিরূপ প্রভাব’ যে গোটা এলাকায় পড়েছে তাতে হিমাংশু ঠক্করের কোনো সন্দেহ নেই, নীতিশ কুমারের প্রস্তাবেও যথেষ্ঠ যুক্তি ছিল বলে তিনি মনে করেন।

আগামী পঞ্চাশ বছরে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ কী?

ফারাক্কা থেকে টানা ফিডার ক্যানালে শুষ্ক মৌসুমে কতটা জল টানা যাবে, আর মূল নদী দিয়ে পদ্মায় কতটা জল ছাড়া হবে – ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তির মূল কথা কিন্তু সেটাই।

এখনকার চুক্তি বলছে, প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে – এই শুকনা মৌসুমের সময়টায় প্রথম দশদিন ক্যানাল আর পরের দশদিন করে পদ্মা অন্তত ৩৫০০০ কিউসেক পরিমাণ জল পাবেই (‘অ্যাশিওর্ড অ্যামাউন্ট’ বা প্রতিশ্রুত পরিমাণ)।

এই জলের প্রবাহ ঠিকঠাক যাচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য ব্যারাজ থেকে কয়েকশো মিটার দূরে ভাঁটির দিকে মনিটরিং স্টেশন-ও আছে, যেখানে ভারত ও বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা একসঙ্গে সার্বক্ষণিক অবস্থান করেন।

ঠিক একই ধরনের যৌথ মনিটরিং স্টেশন আছে বাংলাদেশের দিকে পদ্মার ওপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছেও।

এখন আগামী বছর (২০২৬) কোনো শর্তে সেই গঙ্গা চুক্তির নবায়ন হয় – বা আদৌ হয় কি না – যথারীতি তার ওপরও অনেকটা নির্ভর করছে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ।

এদিকে উজানের বিহারে কিংবা ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানিকচক-ধুলিয়ানে ফারাক্কাকে নিয়ে যতই বিতর্ক থাক, খোদ ফারাক্কা এলাকার গ্রামবাসীরা কিন্তু প্রকল্পের কারণে খুশি - তারা চান বাঁধের দীর্ঘায়ু।

ফারাক্কা উপনগরী লাগোয়া পলাশিগ্রামের বাসিন্দা তপন মিশ্র যেমন বলছিলেন, ‘অনেক কিছু থেকে সুবিধা হয়েছে। যেমন কৃষকরা জল পাচ্ছে, জেলেরা মাছ ধরে দুটো খেতে পাচ্ছে।’

‘এই বাঁধ হওয়াতে এখানে শহর তৈরি হয়েছে মোটামুটি ছোটমোট একটা, কেউ বিজনেস করে খাচ্ছে, কেউ চাকরি করে খাচ্ছে ... দূর দূর ঝাড়খন্ড-ফাড়খন্ড কোথায় বন্যা হচ্ছে ওটা তো ধরলে চলবে না! ভালো হয়েছে, খারাপ হয়নি!’

ফারাক্কা ব্রিজ হওয়ায় স্থানীয় মৎস্যজীবী খগেন প্রামাণিকের আবার খুব সুবিধা হয়েছে দূরদূরান্তে মাছের চালান পাঠাতে।

তিনি পাশ থেকে যোগ করেন, এই গঙ্গায় যে ব্রিজটা হওয়া, ব্রিজটা হওয়াতে কি উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দারুণ যোগাযোগ হয়ে গেছে – এইটা মেইন মেরুদন্ড হয়ে গেছে উত্তরবঙ্গের জন্য!

‘আগে এখানে সকালে নৌকাতে চাপলে দুপুর, বৈকালে গিয়ে পৌঁছাত ওপারে – সেই জিনিসটা এখন আর নেই!’

ফারাক্কার ‘হিউম্যান জিওগ্রাফি’ নিয়ে কাজ করেছেন যে গবেষকরা, তারা অবশ্য নিশ্চিত নন সাধারণ লোকের ভাবনা প্রকল্পে কতটা গুরুত্ব পেয়েছে।

সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলছিলেন, ‘আমার রেজিলিয়েন্স বিল্ডিংয়ের মধ্যে যদি আমি মানুষের মতামত, তাদের চোখে দেখা বা তাদের এক্সপেরিয়েন্স – কীভাবে তারা দেখছে নদীটাকে, সেটা যদি আমরা না ধরতে পারি, তাহলে কিন্তু একটা গ্যাপ রয়ে গেল।’

‘আর যেটা আপনি বলছেন যে পঞ্চাশ বছর পরে কী হবে, এই গ্যাপটা কিন্তু আগাগোড়া রয়েই গেছে। আমরা কিন্তু কখনও দেখছি না এই রেজিলিয়েন্স বিল্ডিংয়ের মধ্যে মানুষকে ইনভলভ করা হচ্ছে বা কমিউনিটিগুলোকে ইনভলভ করা হচ্ছে।’

তিনি আরও মনে করেন, ফারাক্কাকে ঘিরে যে প্রযুক্তিগত সমাধানগুলো ভাবা হয়েছে - কত বছর তার মেয়াদ, বা তার পরে কী হবে – এগুলো নিয়ে একটা অস্পষ্টতা আছেই, আর সেখানে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের সঙ্গে প্রোজেক্টের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

‘কারণ এটা একটা শক্তিশালী নদী, সেটাও তো আমাদের মেনে নিতে হবে যে তার একটা ন্যাচারাল প্রসেস বা স্বাভাবিক গতি ও ছন্দ আছে! সেটা গ্রামের মানুষ যেভাবে বুঝছে আমরা বুঝছি না’, বলছিলেন সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায়।

আবার এই প্রেক্ষাপটেই কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করেন, বাঁধটা কিন্তু বর্তমান আকারে আর না রাখলেও চলে!

হিমাংশু ঠক্কর বিবিসিকে বলছিলেন, আমেরিকা, ইউরোপ ও সারা দুনিয়া জুড়ে অজস্র বাঁধের ডিকমিশনিং হচ্ছে – শুধু আমেরিকাতেই গত ৩০ বছরে ২০০০রও বেশি ড্যাম ডিকমিশন করা হয়েছে, ইউরোপেও হয়েছে শত শত।

‘তবে এটাও ঠিক, গঙ্গার মতো বিশাল একটা নদীতে কোনো ড্যাম ডিকমিশন করার পূর্ব অভিজ্ঞতা কিন্তু তেমন নেই। তবে তার পরেও কাজটা খুবই সম্ভব – আর নানাভাবেই এই ডিকমিশনিং করা যায়।’

এখানে তিনি প্রস্তাব দিচ্ছেন ‘অপারেশনাল ডিকমিশনিং’-এর, অর্থাৎ ব্যারাজের ওপরে ট্রান্সপোর্ট লিঙ্কটা রেখে গেটগুলো সব খুলে রাখার বা তুলে দেওয়ার, যাতে রেল ও সড়ক সংযোগ রেখেও নদীকে স্বাভাবিকভাবে বইতে দেওয়া যায়।

‘পাশাপাশি ক্যানালটা এখন যে সুবিধাগুলো দিচ্ছে, সেটা কীভাবে বজায় রাখা যায় তাও দেখতে হবে। এতে কী হবে, ড্যামের মূল কাঠামোটা অক্ষত রেখেও ফারাক্কার অপারেশনাল ডিকমিশনিং করা যাবে’, বলছিলেন হিমাংশু ঠক্কর।

আবার এর একদম উল্টো মতবাদটা হল – কলকাতার স্বার্থেই ফারাক্কাকে যেভাবে হোক বর্তমান আকারেই রক্ষা করতে হবে!

এই মতে বিশ্বাসী ড. পার্থসারথি চক্রবর্তীর কথায়, কলকাতা নদীবন্দরকে বাঁচাতেই হবে। কারণ কলকাতা নদীবন্দর শুধু কলকাতা কলকাতা বললে হবে না, সমগ্র পূর্ব ভারত এবং নর্থ-ইস্টার্ন রিজিওন – তার একটাই পোর্ট ভারতবর্ষের বলতে গেলে, আমাদের কলকাতা বন্দর। সেখানে কোনও কম্প্রোমাইজ নেই।

‘এর জন্য ফারাক্কা ব্যারাজটাকে যেভাবে হোক রেনোভেট করতে হবে, ইঞ্জিনিয়ারিং স্ট্রাকচার কীভাবে রেনোভেট করবে সেটা পুরোপুরি প্রকৌশলীদের ওপর।’

‘আমার নদীটা তো আছে, নদীর খাত আছে ... আর আপনারা যেটা ভাবেন নদীর পার ভাঙছে, সব নদীরই পার ভাঙে! আমি নদীর ধারে থাকবো কেন? নদীর ধারে একটা বাফার থাকবে তো, সেই বাফার জোনটা দিয়ে রাখতে হবে’, যুক্তি দিচ্ছেন তিনি।

এটা ঠিকই, পৃথিবীতে কোনো নদীবাঁধের আয়ুই অনন্তকাল নয় - কখনও তিরিশ, কখনও চল্লিশ বা কখনও আশি বছর পর একটি ব্যারাজ ডিকমিশনিং করা বা তুলে দেওয়ার বহু নজির নানা দেশে আছে।

ফারাক্কার ক্ষেত্রে ঠিক কী করা হবে আর কখন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের – কিন্তু সেই লক্ষ্যে নির্দিষ্ট ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে বলে এখনও কোনো প্রমাণ নেই।

ফারাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ কিন্তু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, এই প্রকল্পের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ের কোনো কারণই নেই।

ফারাক্কা ব্যারাজ প্রকল্পের মহাপরিচালক আর ডি দেশপান্ডে বিবিসিকে বলছিলেন, ‘দেখুন, এটা তো শুধু একটা ডাইভারশান বা জল টানার প্রকল্প, এখানে কিন্তু তেমন স্টোরেজ বা জলাধার কিছু নেই।’

‘স্টোরেজ প্রকল্পগুলোর আয়ু হয়তো একশো বছর হয়, কারণ পলি পড়ে তার ধারণক্ষমতা পূর্ণ হয়ে যায়। ফারাক্কায় সে সমস্যা নেই, ফলে এটা অনায়াসে একশো বছরেরও বেশি টিঁকতে পারে।’

তবে তিনি স্বীকার করেন ফিডার ক্যানালের বেড (খাত) আর দু’পারের ক্ষয় ও ভাঙন একটা বড় সমস্যা, যেটা হয়তো 'ক্রস রেগুলেটরে'র মতো কিছু বসিয়ে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই মোকাবিলা করতে হবে।

‘কিন্তু ফারাক্কা বাঁচবেই, বাঁচাতেই হবে – কারণ কলকাতা শহর, কলকাতা বন্দর আর গত পঞ্চাশ বছরে নদীকে ঘিরে যে ইকোসিস্টেম তৈরি হয়ে গেছে তাকে রক্ষা করতে হলে ফারাক্কাই একমাত্র ভরসা’, খুব আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গীতে বলেন প্রকল্পের প্রধান।

ফলে ফারাক্কা নিয়ে আগামী দিনে কী করা উচিত, সে সম্বন্ধে ভারতেও নানা ধরনের মতামত আছে।

ফারাক্কার ভবিষ্যত ঠিক কোন পথে, তা এখনও কারও জানা নেই, কিন্তু এটা বলা যায়, ফারাক্কাকে নিয়ে বিতর্ক বোধহয় পরের ৫০ বছর ধরেও চলবে! সূত্র: বিবিসি বাংলা


আরও খবর