অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী,
শিক্ষাবিদ :
মনে পড়ছে সেই শিক্ষকদের মায়াবী মুখগুলোর কথা, যাদের জন্মই
হতো ছাত্রদের মানুষের মতো মানুষ করতে | ছাত্রদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়তে যেমন
শাসন-বারণ করতেন, ঠিক তেমনি নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে
ভালোবাসতেন | সংসারের হাজারটা অভাব-অনটন মাথায় নিয়ে তাদের
একটাই চিন্তা ছিল কিভাবে ছাত্রদের জ্ঞানী মানুষ বানাবেন, বড় মানুষ
বানাবেন | এমনও হয়েছে ছাত্রদের পিছনে নিজের শ্রেষ্ঠ
সময়টুকু দিতে গিয়ে নিজের সন্তানদের দিকে কখনো সেভাবে নজর দিতে পারেননি | ছাত্ররা যখন
বড় মানুষ হয়ে সারা দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন তাদের সন্তানদের জীবন যুদ্ধে লড়তে হয়েছে | তাতে কি? সন্তানদের
মানুষ করতে পারেননি কিন্তু যে মা-বাবা শিক্ষকদের উপর বিশ্বাস রেখে সন্তানদের তাদের
হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তাদের মানুষ বানাতে এতটুকু কার্পণ্য করেননি | বাবা হিসেবে
ব্যর্থতা হয়তো তাদের ভিতরে ভিতরে কাঁদাতো, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে তাদের সফলতা তাদের
ভিতরে ভিতর গর্বের জায়গা তৈরী করতো | একটা কমদামি সাইকেলে করে সাধারণ বেশভূষায়
স্কুলে আসতেন, কিন্তু লাইব্রেরিতে ঘন্টার পর ঘন্টা একটার পর
একটা বই পড়ে নিজেদের ক্লাস নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করতেন |
তারা শিক্ষকতাকে চাকরি বলে মনে করতেননা বরং
শিক্ষকতাকে তারা সেবা বলে মনে করতেন | খেয়ে না খেয়ে ভেঙে পড়া মুখ আর শরীরটা নিয়ে
ছাত্রদের ক্লাস নিতেন | হয়তো শরীরে অসুখ বাসা বেঁধেছে, ক্লান্তিতে
অসার হয়ে আসছে দেহটা কিন্তু তাতে কি, ক্লাস কামাই করলে যে ছাত্রদের বঞ্চিত করা হবে, এই বোধটুকু
তাদের মধ্যে সব সময় কাজ করতো | আহা, আরও কত কি মনে পড়ছে, চোখ গড়িয়ে
তাদের জন্য পানি ঝরছে কিন্তু তাদের ঋণ শোধ করবার সুযোগও তারা দেননি | আর্থিক
অভাব-অনটন তাদের ব্যক্তিত্বকে কখনো আপোষ করতে শেখায়নি | ঋণ শোধ করবার
জন্য কিছু করতে চাইলে তারা বলতেন, না বাবা, আমার কোনোকিছুর প্রয়োজন নেই, আমি অনেক ভালো
আছি, তোমরা আরও বড় হও, তোমরা এমনভাবে
কাজ করবে সেটা যেন আমাদের জন্য কষ্টের না হয়, মর্যাদা ও অহংকারের হয় |
ওই ত্যাগী ও নিঃস্বার্থ মানুষেরা ছিল বলে আজ
হয়তো আমরা মানুষ হতে পেরেছি, পৃথিবীতে নিজেদের একটা পরিচয় তৈরী করতে
পেরেছি | আকাশের তারার দিকে তাকালে মনে হয়, স্যারেরা
আমাদের জন্য সেখানে আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন, যেন আমরা সঠিক পথ চিনতে কখনো ভুল না করি | তাদের অনেকেই
এখন হয়তো নেই, কিন্তু তারা কখনো হারিয়ে যাননি আমাদের জীবন
থেকে |
হাল আমলের শিক্ষকদের দিকে তাকালে খুব কষ্ট হয়, লজ্জায় মাথা
নিচু হয়ে আসে | উনারা শিক্ষক না ব্যবসায়ী এটা বুঝতেই সময়
পেরিয়ে যায় | কিসের ত্যাগ, কিসের ভালোবাসা, কিসের
ব্যক্তিত্ব, স্বার্থপরতা, লোভ, অস্বচ্ছতা এখন শিক্ষকদের শরীরকে শিকড়ের মতো
জড়িয়ে ধরেছে | সবার কথা বলছিনা, এর মধ্যেও কেউ
কেউ এখনও আছেন যারা শিক্ষকতাকে ধরে রেখেছেন, কিন্তু তাদের প্রতিকূলতার সাথে প্রতিনিয়ত
লড়াই করে বাঁচতে হচ্ছে, নিজের আত্মসম্মানটুকু বাঁচাতে খড়কুটোকে আঁকড়ে
ধরে থাকতে হচ্ছে | এখন শিক্ষকরা ছাত্রদের নিজ স্বার্থে ব্যবহার
করেন, ছাত্ররাও শিক্ষকদের এই দুর্বলতা দেখে মনে করে
সব শিক্ষকরাই বুঝি এমন |
ছাত্রদের শাসন-বারণ তো দূরের কথা নিজেদের
দোষে শিক্ষকরাই এখন ছাত্রদের তোপের মুখে থাকেন | এটি ছাত্রদের দোষ নয়, বদলে যাওয়া
সময় আর পরিস্থিতির দোষ, যেখানে শরীরের পচন মনের ভিতরেও পচন ধরিয়েছে | কাউকে ছোট
করার জন্য এমন কথা বলছিনা, সব শিক্ষকের প্রতি বিনীত সন্মান রেখে বলছি, নিজের মুখটা
আয়নায় না দেখে নিজের চোখ দিয়ে দেখার কথা বলছি | কারণ সবকিছু নষ্ট হলেও তা আবার ভেঙে গড়ে তোলা
যায়, শিক্ষাকে যাদের মাথার উপর তুলে দিয়ে জাতি
গড়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সে মাথাতে আবর্জনা জমলে তা পরিষ্কার করা খুব
কঠিন | ঝুড়ির ভিতর একটা আমে পচন ধরলে ঝুড়ির অন্য
আমগুলোতে পচন ধরতে বেশি সময় লাগেনা |
আমি নিজে শিক্ষক বলে স্বজাতির সমালোচনা করতে
এতটুকু ছাড় দেইনা | কারণ আমি বিশ্বাস করি, আত্মসমালোচনা
করতে না পারলে আত্মশুদ্ধির পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় |