মাজহারুল ইসলাম মাসুম, সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক : করোনাভাইরাসের ধকল কাটিয়ে সশরীরে ক্লাসে ফিরেছে অনেক আগেই। নিয়মিত ক্লাস করছে, পরীক্ষাও দিচ্ছে। কিন্তু করোনাকালীন ক্লাস-পরীক্ষা চলেছে অনলাইনে। এই সময়ে স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ছিল তাদের সঙ্গী। এখন এই সঙ্গীই সর্বনাশের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। গেল অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় মিলেছে এর প্রমাণ। শিক্ষার্থীরা আশঙ্কাজনক হারে খারাপ করেছে। দ্বিগুণ হয়েছে ফেল করা শিক্ষার্থী।
রাজধানীর প্রথম সারির কয়েকটি স্কুলের অর্ধবার্ষিক বা অর্ধসাময়িক পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশি ফেল করা বিষয়ের তালিকায় গণিত, ইংরেজি, বাংলা, বিজ্ঞান ও ধর্মশিক্ষা। ক্লাস অনুযায়ী ফেলের হার ৭০-৯৫ শতাংশ পর্যন্ত।
ক্লাস শিক্ষকরা বলছেন, করোনায় দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা হাতের লেখায় অনেক পিছিয়ে গেছে। সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারছে না। নবম শ্রেণিতে বিশেষ বিষয়ের ওপর জ্ঞানের মাত্রা অনেক কম। সে কারণে ফেলের হার বেড়ে গেছে।
হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্রী জানায়, বিজ্ঞান বিভাগে তাদের ৬০ জন ছাত্রী রয়েছে। অর্ধসাময়িক পরীক্ষায় ৪২ জন ফেল করেছে। এক থেকে চার বিষয় পর্যন্ত কেউ কেউ ফেল করেছে। তার মধ্যে উচ্চতর গণিত, বিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞানে ফেল বেশি। তবে ফেল করা অনেক মেয়ে ক্লাস শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেটে পড়ে। স্যারদের কোচিংয়ে পড়েও তারা ফেল করেছে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলো অনেক কঠিন মনে হচ্ছে। গণিতের অনেক সূত্র ভুলে গেছি। সেগুলো নতুন করে মুখস্ত করতে হচ্ছে। একটি অধ্যায়ে স্যাররা একটি অংক করিয়ে বাকিগুলো আমাদের করতে বলেন। সেগুলো একার পক্ষে সমাধান করতে পারছি না। স্যারকে বললে ভালো করে আর বেঝাতে চান না।
আবার ক্লাস শিক্ষক বলছেন, বাড়িতে কাজ দিলে সেটি ক্লাসে করতে পারছে না। দীর্ঘদিন বাড়িতে বসে থাকায় হাতের লেখায় তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা নিয়মিত বই পড়লেও গত দুই বছর লেখার প্র্যাকটিস কম করেছে বলে পরীক্ষায় তারা খারাপ করছে। এটি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আবু সাঈদ ভূইয়া বলেন, করোনার ক্ষতি এখনো আমাদের শিক্ষার্থীরা ধকল কাটিয়ে ওঠেনি। স্কুল বন্ধ থাকায় তাদের অনেক শিখন ঘাটতি হয়েছে। তবে করোনার মধ্যে আমরা প্রথম ও নিয়মিত অনলাইন ক্লাস শুরু করি। সে কারণে অনেকে পড়ালেখায় এগিয়ে থাকলেও হাতের লেখার গতি ও সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লেখার অভ্যাস ভুলতে বসেছে। অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে সবাই যুক্ত হতে না পারায় খুব বেশি সহায়ক হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিক আহসান বলেন, করোনায় আমাদের শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পোষাতে চলমান বাড়তি ক্লাস নেওয়া বা বাড়তি মনিটরিং পর্যাপ্ত নয়। শিক্ষার্থীরা ক্ল্যাসিকাল সাবজেক্টের একটি লেভেল বা লেয়ার অতিক্রম করতে পেছনের জ্ঞানগুলো বুঝতে না পারলে পরের স্তরে সমস্যা হয়। তার মধ্যে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয় রয়েছে। এগুলোর শিখন ঘাটতি কাটাতে আরও বেশ কিছু কার্যকর প্রোগ্রাম দরকার। প্রতিবেশী শিক্ষার্থীর মধ্যে লার্নার গ্রুপ তৈরি করে ক্লাসরুমের বাইরেও কিছু কার্যক্রমে যুক্ত করা যায়। এর মাধ্যমে অন্যদের কাছে শেখার সুযোগ তৈরি হবে। শুধু ক্লাসরুমে ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে না। অ্যাসাইনমেন্টগুলো আরও চিন্তা-ভাবনা করে প্রজেক্টভিত্তিক করে তুলতে হবে। যেন শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বাইরে, বাড়িতে ও অবসরে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে তার সমস্যার সমাধান করতে পারে।