
মাজহারুল ইসলাম মাসুম, সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক, ও গবেষক :
কুতুবে রব্বানী গাউসে সামদানী
বড়পীর হযরত সৈয়্যেদ মহিউদ্দীন আবু মুহাম্মদ আবদুল কাদির জিলানী রহ. এই তরিকার
প্রবর্তক। হযরত বড় পীর রহ.-এর নামানুসারে তাঁহার উদ্ভাবিত ও প্রচারিত তরিকার নাম
কাদেরিয়া তরিকা। রাসূলুল্লাহ সা. হইতে শুরু করিয়া তরিকাতে খেলাফত প্রাপ্ত চতুর্দশ
পুরুষ হইলেন গাউসুল আজম হযরত বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী রহ.।
কালেমা তাইয়্যেবা “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” যথা: লাম, আলিফ, আলিফ, লাম, হা, আলিফ, লাম, আলিফ, আলিফ, লাম, লাম, হা নোক্তা বিহীন এই বারোটি বর্ণের
তালিম কাদেরিয়া তরিকার খাস তালিম। এই নোক্তা বিহীন বারোটি হরফের মধ্যে দুনিয়ার
সমস্ত রহস্য লুকায়িত রহিয়াছে। এই বারোটি হরফই বিশ্ব জগতের মূল কারণ ও উৎস। তৌহিদের
প্রকৃত রূপও এই কালেমা। নোক্তা শূন্য বর্ণ দিয়ে কেন কালেমার সৃষ্টি, তাহা গভীর রহস্যে নিমজ্জিত। এই কালেমাকে জানিলে, চিনিলে ও সঠিক ভাবে গবেষণা করিয়া পড়িলে তাহার নিকট সকল রহস্যের
দ্বার উন্মোচিত হইয়া যায়। এই কালেমা বিশ্ব মহীরুহের মূল ও নূরে মুহাম্মদীর মূল
উৎস। এই তালিম না পাওয়া পর্য্যন্ত কেহ কাদেরিয়া তরিকার সূফী-সাধক ও পীর হওয়ার
যোগ্য হন না। যিনি এই কালেমার রহস্য জানেন - তিনি আরেফ বিল্লাহ ও অলিয়ে কামেল - এর
মর্যাদায় আসীন হন। এই রূপ জ্ঞানী সম্পর্কেই বলা হইয়াছে:
مَن قَالَ لا الَهَ الا اللهُ مُخلِصاً
دَخَلَ الجَنَّةَ
উচ্চারণ: মান কলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুখলিছান দাখালাল জান্নাতা।
অর্থ: “যে তাহকিক (গবেষণা) করিয়া জীবনে
একটি বারের জন্যও কালেমা পাঠ করিয়াছে, তাহার জন্য দোজখের আগুন হারাম।”
এই কালেমা শরীফ প্রথমত: দুই ভাগে বিভক্ত। এর এক ভাগ ফানা ও এক ভাগ
বাকা। ফানাকে নুজুল (অবরোহ) ও বাকাকে উরুজ (আরোহ)ও বলা হয়। কি ভাবে এই কালেমার
শিক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে, কালেমা সাবেত করিতে হইবে - তাহা
সূফী-সাধক ও পীর-মোর্শেদগণ ব্যতীত সাধারণ শুষ্ক আলেমগণ (আরবী ভাষায় বিদ্বান) বলিতে
পারেন না।
হযরত নবী করিম সা. এই কালেমার বিশেষ তালিম হযরত আলী রা.কে প্রদান
করিয়াছিলেন। তিনি এই তালিম তাঁহার খলিফা হযরত হাসান বসরী রহ.-কে দান করেন। তাঁহার
নিকট হইতে গাউসুল আজম হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহ.- এর নিকট আসে। এই কালেমার রহস্য
তাঁহার নিকট আসিবার পূর্ব পর্য্যন্ত ইহার তালিম সিনা-ব-সিনা আসিত। কিন্তু তিনি এই
তালিমকে সু-বিন্যস্ত করিয়া লিখিত আকারে গুপ্ত ভাবে বিশেষ মুরিদানকে দান করেন। এতদ
ব্যতীত এই তরিকার অন্যান্য পদ্ধতিও তিনি সু-সংবদ্ধ করেন।
তরিকার নিয়মানুসারে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরে অজিফা পাঠ, বিশেষ দরূদ শরীফ, নফী-এসবাতের
জিকির ও মোশাহাদা করিতে হয়। মুরিদের মনের অবস্থা ও পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিকতা ভঙ্গ
করিয়া জিক্রে জলী বা জিক্রে খফী উভয় প্রকার জিকির করিবার নিয়ম এই তরিকায় রহিয়াছে।
কাদেরিয়া তরিকা ভুক্ত অনেক উপ-তরিকা রহিয়াছে। তন্মধ্যে প্রধান ও আদি নয়টি উপ-তরিকা
রহিয়াছে, যথা: হাবিবিয়া, তারফুরিয়া, কারখিয়া, সকতিয়া, জুনায়দিয়া, গাজর দিদিনিয়া, তুরতুসিয়া, কারতুসিয়া ও সোহরাওয়ার্দিয়া। এই তরিকা ভুক্ত জুনায়েদিয়া উপ-তরিকা
মতে সামারও প্রচলন রহিয়াছে।
আওলাদে রাসূল সা. হযরত বাবা ফতেহ আলী ওয়াইসী পাক রহ.-এর প্রিয়তম
মুরিদ-খলিফা হযরত শাহ সূফী সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী রহ.
কাদেরিয়া তরিকা সম্পর্কে স্ব-রচিত ‘র্সিরেহক্ক জামেনূর’ কিতাবে একটি ভিন্ন অধ্যায় রচনা করিয়াছেন। নিম্নে উহার অংশ বিশেষ
তুলিয়া ধরা হইল:
“কাদেরিয়া তরিকার সাধনা কোন লতিফার সহিত সম্পৃক্ত নহে। বরং খোদা
প্রেমিকের যেই স্থানে আল্লাহ শব্দের প্রভাব পড়িবে, সেখানেই জিকির জারী হয়। সেইখান হইতে তাহা সমস্ত শরীরে শিহরিত হয়।
অতঃপর সেখানে বিশেষ অবস্থা ও নূর সমূহ বিচ্ছুরিত হইবার পর তাজাল্লী বা আলোক প্রভার
বিকিরণ এবং ঊর্ধ্ব জগতের ভ্রমণ সংঘটিত হয়। ফলে এমন আবেগের উত্থান এবং অবস্থার
পর্য্যায়ক্রমিক উন্নতি সাধিত হয়, যাহা বলা বা
লেখা যায় না।
মোর্শেদের তাওয়াজ্জুহ্ ব্যতীত
সালেকের এই পথে সফল হওয়া খুবই কঠিন। যখনই এই সকল বিশেষ অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়, তখনই মোর্শেদ তাহাকে নিজের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বলে উন্নততর মনজিলে
পৌঁছার পথ নির্দেশ করেন। প্রকৃত মকসুদে পৌছাইবার পথ বাতলাইয়া দেন। সালেক চলার পথে
যখনই ধীরে ধীরে নূরানী জগতে অগ্রসর হয় এবং বিশাল বিশাল ভয়ানক সমুদ্র অতিক্রম
করিবার পর জাতী তথা মূল নূরের প্রভাবে ফানার মাকামের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তখনই মূল সত্তার দরিয়ায় ডুবিয়া যায়। সমুদ্রের মতো যাহার কিনারায়
মূলের মূল, শাখার শাখা বিভিন্ন পর্য্যায়ে
ওয়াহ্দাতুল ওজুদ বা অস্তিত্বের একত্বের অলি-গলিতে ঘুরিতে থাকে। ইহারই মধ্যে শাহে
লা-তায়াইউন বা অসীম অমূর্ত বা নির্বস্তুক জগতের আবির্ভাব ঘটে, যাহার কূল-কিনারা নাই।”
( চলবে...)