রোকসানা মনোয়ার : দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ
করেছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। প্রতিদিন মৃতের সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে। আক্রান্তের
তালিকাটাও লম্বা হচ্ছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর পানিশূন্যতা ও রক্তের ঘনত্ব
স্বাভাবিক রাখতে তাদের শিরায় স্যালাইন দিতে হয়। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়
স্যালাইনের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। এর ফলে ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যবহৃত পণ্যটির
সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষত রাজধানীর ফার্মেসিগুলো থেকে এক প্রকার ‘উধাও’ হয়ে গেছে
স্যালাইন। তবে হাসপাতালে কোনো সংকট নেই বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
রোগীরা
আশঙ্কা করছেন, যেভাবে রোগী বাড়ছে তাতে হাসপাতালে সরকারি খরচে দেওয়া আইভি ফ্লুইড সরবরাহ
যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় ব্যবহার করা স্যালাইনের
সংকট তীব্র হতে পারে।
প্রধানত
শিরায় চার ধরনের স্যালাইন দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে সাধারণ পানির ঘাটতি পূরণ, গ্লুকোজ স্যালাইন,
হৃদরোগীদের স্যালাইন এবং ডায়রিয়া-কলেরা রোগীদের স্যালাইন। এর মধ্যে
প্রথমটি বা সাধারণ স্যালাইন ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। দেশে যে হারে ডেঙ্গু
আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে হাসপাতালগুলোতে স্যালাইন সংকটের আশঙ্কা দেখা
দিতে পারে। ইতোমধ্যে ওষুধের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না ডেঙ্গুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত
পণ্যটির।
রাজধানীর
শাহবাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা ও মগবাজারের বিভিন্ন ফার্মেসি ঘুরে স্যালাইনের
তীব্র সংকটের চিত্র দেখা গেছে। বিক্রেতাদের দাবি, গত দুই
সপ্তাহ ধরে তাদের কাছে স্যালাইনের সরবরাহ নেই। তবে বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
বলছে, বাজারে স্যালাইনের সংকট থাকলেও হাসপাতালে কোনো সংকট
নেই।
রাজধানীর
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ ব্লকের দু’তলায় স্থাপিত ডেঙ্গু কর্নারে সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালে
অবস্থান করা প্রায় প্রত্যেক রোগীকে শিরায় দেওয়া স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ
রোগীর সরকারি স্যালাইন চললেও অনেকে বাইরে থেকে কেনা স্যালাইন দিচ্ছেন।
মহিলা
ওয়ার্ডের ১০ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন কোহিনূর বেগম। আশুলিয়া থেকে আসা
পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারী ডেঙ্গু ছাড়াও ডায়াবেটিস ও লিভারজনিত রোগে ভুগছেন। কথা বলার
সময় তার শিরায় ৫০০ মিলি লিটারের স্যালাইন চলছিল, যেটি বাইরে থেকে কেনা। ওই সময় পাশের
স্ট্যান্ডেই আগে ব্যবহার করা একটি সরকারি স্যালাইনের খালি প্যাকেট ঝুলতে দেখা যায়।
জানতে
চাইলে কোহিনূরের এক স্বজন বলেন, সাধারণত হাসপাতাল থেকেই স্যালাইন দেয়। না থাকলে
বাইরে থেকে আনতে হয়।
মিরপুর
থেকে হাসপাতালটিতে আসা প্রিয়াঙ্কা তালুকদারের মেয়ে বলেন, তার মা গত চারদিন
ধরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। প্রাথমিক অবস্থায় বাসায় থেকে চিকিৎসা নিলেও হঠৎ তার
(প্রিয়াঙ্কা তালুকদার) প্রচণ্ড বমি হওয়ায় ডেঙ্গু শনাক্তের তৃতীয় দিনে হাসপাতালে
ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালে আসার পর থেকে মোট দুটি স্যালাইন দেওয়া হয়েছে।
হাসপাতালের পক্ষ থেকে ওষুধ দেওয়া হলেও দুটি স্যালাইন বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে।
তবে
বাইরে থেকে স্যালাইন কিনে আনার তথ্য অসত্য দাবি বলে দাবি করেছেন কর্তব্যরত কয়েকজন
নার্স। তাদের দাবি, হাসপাতাল থেকেই স্যালাইনসহ রোগীর সব কিছু দেওয়া হচ্ছে।
নাম
প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্সিং কর্মকর্তা বলেন, যত সেবা বা সুযোগ সুবিধাই দেওয়া হোক না কেন,
রোগীদের অভিযোগ থাকবেই। রোগীদের কোনো স্যালাইন বাইরে থেকে কিনতে
হচ্ছে না। আমাদের স্টকে পর্যপ্ত স্যালাইন আছে।
সরকারি
লোগো ছাড়া স্যালাইনের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি
স্যালাইনেই সরকারি লোগো আছে। বাইরের যেগুলো দেখেছেন, ভালো
করে লক্ষ্য করে দেখবেন সেগুলোর গায়েও সিল দেওয়া আছে। চাহিদা বাড়ায় সরকারি
প্রতিষ্ঠানের বাইরেও স্যালাইন কেনা হচ্ছে। ফলে সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে
বাইরের কিন্তু আসলে সেগুলো আমাদেরই দেওয়া।
এছাড়া
নতুন ভর্তি হওয়া অনেক রোগীদের নামে বরাদ্দ চালু না হওয়ায় এবং অনেকে অপেক্ষা করতে
রাজি না হওয়ায় তারা নিজ উদ্যোগে স্যালাইন কিনে আনছেন বলেও দাবি করে তিনি।
বিএসএমএমইউর আশপাশের কোনো ফার্মেসিতে স্যালাইন নেই বলে জানান কর্তব্যরত ওই নার্সিং
কর্মকর্তা।
একই
চিত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। সেখানে ঘুরে দেখা গেছে, রোগীদের সিংহভাগই
স্যালাইন পাচ্ছে হাসপাতাল থেকে। তবে বিশেষ কারণে কয়েকজন রোগীকে স্যালাইন কিনতে
হচ্ছে ফার্মেসি থেকে।
ঢামেকে
স্যালাইন সংকট নেই জানিয়ে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, আমাদের এখন প্রতি
মাসে এক লাখ ব্যাগ স্যালাইন লাগে। ডেঙ্গু আসার পর থেকে ৪০-৪৫ হাজার ব্যাগ বেশি
লাগছে। অর্থাৎ প্রতিদিন রোগী ভেদে স্যালাইন প্রয়োজন হচ্ছে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার
ব্যাগ। এখন পর্যন্ত হাসপাতালে স্যালাইনের কোনো সংকট নেই। রোগীদের প্রয়োজনীয়
স্যালাইন হাসপাতাল থেকেই দেওয়া হচ্ছে।
বাজারে
নেই স্যালাইন : বিএসএমএমইউর সরেজমিনকালে একজন নার্সিং কর্মকর্তা বলেন, হাসপাতালটির
আশপাশের কোনো ফার্মেসিতে শিরায় প্রয়োগ করা সাধারণ স্যালাইন নেই। এটি প্রমাণে তিনি
একটি কাগজে ৫০০ মিলির স্যালাইনের চাহিদার কথা লিখে দেন। সেটি নিয়ে হাসপাতালটির আশপাশের
আট থেকে দশটি দোকান ঘুরলেও কোথাও স্যালাইন পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে বিএসএমএমইউর
পাশের মেডিসিন মার্কেটের ‘জনপ্রিয় ফার্মেসি’তে ১০০০ মিলির স্যালাইন পাওয়া গেলেও ৫০০ মিলির স্যালাইন পাওয়া
যায়নি।
বাজারে
স্যালাইন নেই জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলেন, ডেঙ্গুর কারণে চাহিদা বেড়েছে। ফলে গত দুই সপ্তাহ
ধরে সরবরাহ নেই। অনেক ক্রেতা কিনতে চাইলেও তারা দিতে পারছেন না।
কারণ
হিসেবে শাহবাগের সরকার ফার্মেসির স্বত্ত্বাধিকারি বলেন, ডেঙ্গু রোগীর চাপ
বাড়ায় কোম্পানিগুলো ফার্মেসিতে না দিয়ে সরাসরি হাসপাতালকে স্যালাইন দিচ্ছে। ফলে
আমাদের সাপ্লাই নাই।
একই
চিত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার ওষুধের দোকানগুলোতেও। বিক্রেতারা বলছেন, গত এক সপ্তাহের
অধিক সময়ে সাপ্লাই নেই। ফলে ক্রেতারা আসলেও আমরা দিতে পারছি না। মূলত হাসপাতালে
চাহিদা বাড়ায় কোম্পানিগুলো তাদের সরবরাহ করছে।
যা
বলছে কর্তৃপক্ষ : দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সরকারি
হাসপাতালগুলোতে ওষুধ ও স্যালাইন সরবরাহ করে এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড
(ইডিসিএল)। তবে প্রতিষ্ঠানটির স্যালাইনের নিজস্ব উৎপাদন না থাকায় বিভিন্ন বেসরকারি
কোম্পানি থেকে তা কিনে হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করে।
এ
বিষয়ে ইডিসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. এহসানুল কবির বলেন, গত বছর ৬০ লাখ
ব্যাগ স্যালাইনের চাহিদা ছিল। এখন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় চাহিদা ১০ গুণের বেশি
বেড়েছে। এ চাহিদা পূরণ করেছে বেক্সিমকো, স্কয়ার, একমি, পপুলার, ওরিয়ন, লিব্রা ও অপসোনিন। রেশনিং প্রক্রিয়ায় হাসপাতালগুলোকে স্যালাইন সরবরাহ করা
হচ্ছে।
সরকারি-বেসরকারি
হাসপাতালগুলোতে যেন স্যালাইন সংকট না হয়, সেজন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা
নিয়েছে বলে জানিয়েছেন অধিদফতরের এমআইএস শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. শাহাদাত
হোসেন।
গত
৬ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে শাহাদাত হোসেন বলেন, এই সংকটের দায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের
একার নয়। এ বিষয়ে ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে জানানো হয়েছে। কেন সংকট ও কোথায় দাম
বেশি রাখা হচ্ছে এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর তদারকি করছে।’