নিজস্ব প্রতিবেদক ,কুমিল্লা :
প্রতারণার খবর পাওয়া যায় যা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। এমনি এক ধূর্ত প্রতারক তাজুলকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। তথ্য গোপন করে ২২বছর কারারক্ষীর চাকুরী করা প্রতারক তাজুল ইসলামকে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া বাজার থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। ওই এলাকার বাড়ি থেকে ৩ সেট কারারক্ষী ইউনিফর্ম, ১ টি কারারক্ষী জ্যাকেট,১ সেট কারারক্ষী রেইনকোট, ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি-পত্রাদি উদ্ধার করেছে র্যাব।
শুক্রবার সকালে কুমিল্লার শাকতলা র্যাব কার্য্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব -১১উপ-পরিচালক,
কোম্পানী অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন
জানান- ভুয়া পরিচয় দিয়ে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে চাকুরী করে গেছে কারারক্ষীর মত স্পর্শকাতর জায়গায়। গত ২০০১ সালে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার শাহজাহানপুর গ্রামের মোঃ নুর উদ্দিন খান এর ছেলে মোঃ মঈন উদ্দিন খান কারারক্ষী পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে হাজির হয়ে শারীরিক ফিটনেস, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রত্যেকের স্থায়ী ঠিকানায় নিয়োগপত্র পরবর্তীতে ডাকযোগে প্রেরণ করা হবে। একই নিয়োগ দেখে উক্ত প্রতারকও পরীক্ষা দেয় এবং অকৃতকার্য হয়। এরই মধ্যে প্রতারকসহ আরো দুইজন সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মঈন উদ্দিন খানের বাড়িতে যান ও নিজেদের কারাকর্তৃপক্ষের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেয় এবং মঈন উদ্দিন খানকে বলে সে যদি কিছু টাকা দেয় তবে তাকে নিয়োগপত্র প্রদান করা হবে অন্যথায় তার নিয়োগ বাতিল করা হবে। কিন্তু মঈন উদ্দিন খান ঘুষ দিয়ে চাকুরী করবে না বলে টাকা প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে মঈন উদ্দিন খান নিয়োগপত্র না পাওয়ায় আশাহত হয়ে বেসরকারী চাকুরী শুরু করেন। এরই মধ্যে প্রকৃত মঈন উদ্দিন খান এর ঠিকানা ব্যবহার করে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার স্থলে কারারক্ষী হিসেবে চাকুরী শুরু করেন এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারাগারে চাকুরী সম্পন্নও করেন ও সর্বশেষ ঐ প্রতারক সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্মরত ছিলেন। এরই মধ্যে জাতীয় বেতনস্কেল ২০১৫ অনুযায়ী সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন প্রাপ্তির জন্য জাতীয় পরিচয় পত্রের প্রয়োজন হলে প্রতারক প্রকৃত মঈন উদ্দিন খান এর নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে একটি জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরী করে ফেলে। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার ২০২০ সালের শেষ দিকে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক প্রিন্ট সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সংবাদে প্রকাশিত হয় যে, সিলেট বিভাগে প্রায় ২০০ জন কারারক্ষী সিলেটের স্থায়ী বাসিন্দা না হয়েও প্রায় ২০/২২ বছর যাবত চাকুরী করে আসছে। উক্ত সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সিলেট বিভাগে কর্মরত প্রত্যেক কারারক্ষীর ঠিকানা যাচায়েরই জন্য তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। তেমনিভাবে প্রকৃত মঈন উদ্দিন খান এর ঠিকানা যাচাইয়ের লক্ষ্যে কারা উপ-মহাপরিদর্শক, সিলেট কার্যালয়ে হতে শাহাজাহানপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বরাবর একটি পত্র পাঠানো হয় এবং মঈন উদ্দিন খান সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা কি না এ ব্যাপারে একটি প্রত্যয়ন পত্র প্রেরণের জন্য বলা হয়। পত্র প্রাপ্তির পর শাহাজাহানপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান একটি প্রত্যয়নপত্রে উল্লেখ করেন যে, মঈন উদ্দিন খান, পিতা-মোঃ নুর উদ্দিন, গ্রাম-শাহজাহানপুর, ডাকঘর-তেলিয়াপাড়া, থানা-মাধবপুর, জেলা-হবিগঞ্জ-কে তিনি চিনেন এবং মঈন উদ্দিন খান কারারক্ষী হিসেবে চাকুরী নয় বরং স্থানীয় একটি ফার্মেসীতে ঔষুধের ব্যবসা করেন। চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেট এর বিষয়ে জানার পর প্রতারক গত ২০২১সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হতে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ পর্যন্ত ৫ দিনের নৈমিত্তিক ছুটিতে গমন করেন ও ২০ সেপ্টেম্বরে যোগদান করার কথা থাকলেও সে ইতিমধ্যে তার কিছু নিকট সহকর্মীদের মাধ্যমে জানতে পারে কারা কর্তৃপক্ষ তার ভুয়া ঠিকানার ব্যাপারে জানতে পারে। তার সে যোগদান থেকে বিরত থাকে। এপ্রেক্ষিতে কারা কর্তৃপক্ষ গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে তাকে ছুটি হতে যোগদান না করলে চাকুরিচ্যুত করার বিষয়টি অবগত করলে সে যোগদান না করে অতিবাস করতে থাকে।
পরবর্তীতে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ মঈন উদ্দিন খান বিভাগীয় দপ্তরে চাকুরীতে যোগদানের জন্য একটি আবেদনপত্র প্রেরণ করেন যেখানে উল্লেখ করেন তিনি কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারারক্ষী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন এবং তার ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হলেও কোন যোগদানপত্র পান নাই। বিষয়টি প্রতারক জানতে পারে ও সে শাহাজাহানপুরে মঈন উদ্দিন খান এর দোকানে গিয়ে তাকে বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দেয় এবং সত্য ঘটনা প্রকাশ না করার জন্য বলে। কিন্তু মঈন উদ্দিন খান হুমকির কোন তোয়াক্কা না করে বিষয়টি উন্মোচন করে দিবে বলে জানালে প্রতারক ব্যক্তি মঈন উদ্দিন খানকে ১০ লক্ষ টাকা প্রদানের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু প্রকৃত মঈন উদ্দিন খান তার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে মঈন উদ্দিন খান চাকুরী পেতে উচ্চ আদালতের দারস্থ হন। এরই মধ্যে কারা কর্তৃপক্ষের পুরো বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে।
কারা কর্তৃপক্ষের তদন্ত কার্যক্রমে সংগৃহীত কাগজপত্রাদি পর্যালোচনা, সাক্ষীগণের সাক্ষী, জাল শিক্ষা সনদ ব্যবহার করে চাকুরীতে বহাল থাকা ও স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাতে প্রাপ্ত তথ্য, ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করা, প্রকৃত মঈন খান কে হুমকি ধামকি দিয়ে সত্যতা ধামাচাপা দেয়াসহ বিভিন্ন লোমহর্ষক তথ্য প্রমাণিত হয়। আরো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চাকুরীরত প্রতারক কারারক্ষীকে গত ২০২১সালের ২০ নভেম্বর তদন্ত কমিটির নিকট উপস্থিত হওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলে সে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে আত্নগোপনে চলে যায়। পরবর্তীতে গত বছরের ৪ আগষ্ট তারিখে অন্যের ঠিকানা-পরিচয় ব্যবহার করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে চাকুরীরত থাকায় তার বিরুদ্ধে এস.এম.পি এর জালালাবাদ থানায় মামলা করা হয়।
যেহেতু কারা কর্তৃপক্ষের নিকট এই প্রতারকের প্রকৃত ঠিকানা ছিল না তাই তারা মামলায় আসামীর নাম মোঃ মঈন খান এবং অন্যান্য তথ্যাদি অজ্ঞাত দিয়ে একটি মামলা রুজু করে। মামলা দায়েরের পর প্রতারক পুরোপুরিভাবে আত্নগোপনে চলে যায়। মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে জানতে পারেন তৎকালীন সময়ে কুমিল্লা জেলা হতে অনেক লোক কারারক্ষী পদে পরীক্ষা দিয়ে চাকুরীরত রয়েছে। পরবর্তীতে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতারককে গ্রেপ্তারের জন্য র্যাব-১১কুমিল্লা এর সহায়তা কামনা করে।
এরই প্রেক্ষিতে র্যাব ১১, গোয়েন্দা সূত্র ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় গত ১২ জানুয়ারি বিকালে কুমিল্লা ব্রাহ্মণপাড়া বাজার এলাকা থেকে প্রতারক তাজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তারঁ বাড়ি থেকে ৩ সেট কারারক্ষী ইউনিফর্ম, ১ টি কারারক্ষী জ্যাকেট, ১ সেট কারারক্ষী রেইনকোট, ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি-পত্রাদি উদ্ধার করে র্যাব।
গ্রেপ্তারকৃত,মোঃ তাজুল ইসলাম (৪২) জানায়,ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ৬নং দক্ষিণ শশীদল গ্রামের মৃত মোঃ কালা মিয়ার ছেলে। নাম-ঠিকানা গোপন করে প্রকৃত মঈন উদ্দিন খান এর নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে চাকুরী করা সহ সরকারী সুযোগসুবিধা ভোগ করে আসছিল।
এ বিষয়ে গ্রেপ্তারকৃত আসামীকে সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত পরিচালনাকারী কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।