সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে
সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর থেমে নেই
জান্তা সরকার। রাখাইনের সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী ও আরাকান আর্মির
বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর পাশাপাশি নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে এই জান্তা সরকার।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতীর
প্রতিবেদনে এমনটি বলা হয়েছে।
মিয়ানমার বর্তমানে নজিরবিহীন জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়নে
জর্জরিত। দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের তিন বছরের মাথায় সম্প্রতি দেশটির জান্তা
সরকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। তিনটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর
জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের যোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে দিশেহারা জান্তা
বাহিনী। বিদ্রোহী জোটের অন্যতম সদস্য আরাকান আর্মি (এএ) এই মুর্হূর্তে রাখাইন
রাজ্যের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে লড়াই অব্যাহত রেখেছে।
এই রাজ্যে আরাকান আর্মির কাছে বিপর্যয়কর পরাজয়ের শিকার হয়েছে
জান্তা সেনারা। বিষয়টি সহজে মেনে নিতে পারছে না তারা। আর এই কারণেই তারা জাতিগত
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। মিয়ানমারের পুরানো রাজধানী শহর
ইয়াঙ্গুন ও অন্যতম বড় শহর মান্দালয়সহ একাধিক শহরে জাতিগত রোহিঙ্গাবিরোধী পোস্টার,
ব্যানার ও লিফলেট বিলি করা হচ্ছে। এসব পোস্টার ও লিফলেটের মাধ্যমে জাতিগত
রোহিঙ্গাদের বয়কটের আহ্বান জানানো হচ্ছে। রোহিঙ্গা মালিকানাধীন দোকানপাট,
হোটেল-রেস্তোঁরায় না যেতে বলা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এইসব শহরে যেসব জাতিগত রোহিঙ্গা
বসবাস করেন তাদেরকে তাদের নিজ রাজ্য রাখাইনে ফিরে যেতে বলা হচ্ছে।
স্থানীয় অধিবাসীদের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সোমবার
(১২ ফেব্রুয়ারি) থেকে ইয়াঙ্গুন ও মান্দালয়ের মতো শহরগুলোতে জাতিগত রোহিঙ্গা
মালিকানাধীন দোকান ও রেস্তোঁরার সাইনবোর্ডে বা রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট ও বৈদ্যুতিক
খুঁটিতে পোস্টার দেখা যায়। ইয়াঙ্গুনে একটি ল্যাম্পপোস্টে লাগানো একটি পোস্টারে
বলা হয়েছে, সন্ত্রাসী আরাকান আর্মিকে (এএ) নিন্দা জানাতে রাখাইনের রোহিঙ্গা
মালিকানাধীন যেকোনো ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান এড়িয়ে চলুন।
বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশ মিয়ানমার। দেশটিতে কমবেশি ১৩৫টি
নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বা জাতির বসবাস। এরমধ্যে প্রধান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বামার।
অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শান, কারেন, মন, ওয়া ও রাখাইন বা রোহিঙ্গা
উল্লেখযোগ্য। বামাররা বার্মান বা বর্মী নামেও পরিচিত।
আদমশুমারিতে বর্মীদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর ৬৮ শতাংশ বলে
দেখানো হয়। অন্যান্য জনগোষ্ঠী আরও ৩২ ভাগ। শাসকদল আর সেনাবাহিনীতেও বর্মীদের
সংখ্যা ও প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সেই প্রভাব ধরে রাখার লক্ষ্যেই অন্যান্য বিভিন্ন
জাতিগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন ও নিধন চালানো হয়। আর এ দমনপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো
থেকেই শুরু জাতিগত সংঘাত।
অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে প্রায়ই
জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর কৌশল বেছে নেয় সংখ্যাগুরু শাসকগোষ্ঠী। মিয়ানমারে গণতন্ত্র
চর্চার সুযোগ কমায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতিগত বিদ্বেষ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ
করেছে। যার প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা গণহত্যা সংঘটিত হয় এবং ১০ লাখের বেশি
রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। দেশটিতে জাতিগত বিদ্বেষকে রীতিমতো
প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। শুধু সেনাশাসকরাই নয়, বেসামরিক গণতান্ত্রিক সরকারের
আমলেও জাতিগত বিদ্বেষ সব মাত্রাকে ছাড়িয়ে যায়। যা বিভিন্ন সময় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে ভয়াবহ উদ্বেগ হিসেবে উঠে এসেছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যপুস্তকে বর্ণবাদী ও জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। এর জন্য
গণতন্ত্রকামী নেত্রী ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেত্রী অং সান সুচিকেও দায়ী করা হয়।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সু চি’র সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত
করে রাষ্ট্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। এরপর গণতন্ত্রকামী
বিক্ষোভকারীদের নির্মমভাবে দমন করা হয়। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে ভয়াবহ বলপ্রয়োগ ও
দমন-নিপীড়নের ঘটনায় হাতে অস্ত্র তুলে নেন গণতন্ত্রকামীরা। গড়ে তোলেন সশস্ত্র
প্রতিরোধ।