রোকসানা মনোয়ার : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বর্তমান কাঠামোর পরিবর্তন চায় বিএনপিসহ রাজপথে থাকা সরকারবিরোধী দলগুলো। বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কাঠামোগত ফর্মুলা এখনো উপস্থাপন করেনি। তবে দলটির দাবি-দাওয়ায় ‘বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের কথা উঠে আসছে। সংবিধানে এ ব্যবস্থা না থাকায় অন্য যে কোনো ফরমেটে নির্বাচনকালীন সরকারকে দলনিরপেক্ষ করার দাবি করছে। তবে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের অনেকগুলো দল নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি না তুলে জাতীয় সরকারের কথা বলছে। নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের বিষয়টিতে বিএনপি আপাতত কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও এ জাতীয় সরকারের পক্ষে তারা নেই বলে দলটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তাই আগামী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিরোধী পক্ষগুলো কার্যত দুইদিকে হাঁটছেন।
দলীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিএনপির সঙ্গে থাকা এলডিপি বাদে বাকি ১৯ দলসহ আরো কয়েকটি দল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে কাজ করছেন। তবে, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি ও কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদের এলডিপিসহ কয়েকটি দল জাতীয় সরকারের পক্ষে। তারা দুজন গত সোমবার রাতে দীর্ঘ প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে জাতীয় সরকারের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠকের বিষয়ে এলডিপির মহাসচিব রেদয়োন আহমেদ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘দেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে দুই দলের মাঝে আলোচনা হয়েছে। এখানে জাতীয় সরকার প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এটা কোনো নির্ধারিত মিটিং নয়; মূলত এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের জন্মদিন উপলক্ষে মিলিত হয়েছেন।’
তত্ত্বাবধায়ক এবং জাতীয় সরকার এ দুই ফর্মুলা নিয়েই জোটের মধ্যে মতবিরোধ আছে। এই বিরোধ নিরসনে অনেকগুলো বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে বিএনপিসহ কিছু দল। তবে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলগুলোর এই বিরোধ নিরসনে বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের’ প্রস্তাব নিয়েও কাজ করছে। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে এরই মধ্যে দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন বিএনপিসহ অপর কয়েকজন জাতীয় নেতা। তারা একাধিক ফর্মুলা নিয়ে জোর আলোচনা করছেন। মূলত ফর্মুলা চূড়ান্ত হওয়ার পরই রূপরেখা নিয়ে কাজ শুরু হবে। সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ও জাতীয় সরকার এ দুই ‘ফমুর্লার’ পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছে দলগুলো। বিএনপি বলছে, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই তা অবাধ ও সুষ্ঠু হবে, জনগণ নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। আর জাতীয় সরকারের পক্ষে দলগুলোর যুক্তি হচ্ছে- দীর্ঘদিন যারা ক্ষমতায়, তারা পুরো প্রশাসন নিজেদের মতো করে সাজিয়ে রেখেছেন। মাত্র তিন মাসে নির্দলীয় ব্যক্তিদের পক্ষে এই প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো সম্ভব না। তাই অন্তত দুই বছর জাতীয় সরকার ক্ষমতায় থাকতে হবে। এরপর তাদের অধীনে আগামী নির্বাচন হবে। ঐক্য ফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্য জাতীয় সরকার এবং নির্দলীয় সরকারের বিষয়ে আপত্তি তুলছে। তাদের দাবি, কোনো ব্যক্তিই নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় নন, সুতরাং এ দাবি অযৌক্তিক।
আর জাতীয় সরকার বলতে যদি সেখানে আওয়ামী লীগেরও প্রতিনিধি থাকে, তা জনগণ কখনো গ্রহণ করবে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছে, তাদের প্রতিনিধি জাতীয় সরকারে থাকলে বিরোধী দলগুলো জনগণের কাছে কী জবাব দেবে?
সূত্র জানায়, এ দুই ফর্মুলার বাইরে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের’ প্রস্তাব করেছে ঐক্যফ্রন্টে থাকা একটি দল। প্রস্তাবটি নিয়ে বিএনপি নেতারা গত কয়েকটি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনাও করেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা দিক নিয়ে পর্যালোচনাও হয়। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে একটি ‘ফর্মুলায়’ ঐকমত্যে পৌঁছাতে এরই মধ্যে বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছেন। এর সঙ্গে আরো যুক্ত হয়েছেন গণফোরামের ড. কামাল হোসেনও। তিনিও এ নিয়ে কয়েকটি দলের সঙ্গে কথা বলেছেন। নেতারা আশা করছেন, সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা বের করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের দলের দাবি—কোনো দলীয় সরকার নয়, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হতে হবে। কেউ যদি জাতীয় সরকারের কথা বলে থাকেন, এটা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন। প্রতিটি দলেরই বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে। এ নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব বা সমস্যা হবে না। যে যার জায়গা থেকে সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি আমরা। আলোচনার মাধ্যমে সব ইস্যুতে ঐকমত্য হবে বলে আশা করছি।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম দল গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন গণমাধ্যমে বলেন, ‘সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চাই। সেটা করতে হলে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার বা জাতীয় সরকার—কোনটা হবে, সেটা আলোচনার বিষয়। যেটার ওপর ঐকমত্যে আসা যায়, সেটার পক্ষে আমি। আমরা কোনো দাবি জানিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাই না।’
গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমরা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলার সঙ্গে একমত। জাতীয় সরকারের বিষয়টি তো পরিষ্কার নয়। এটিতে কি আওয়ামী লীগও থাকবে? আওয়ামী লীগ ছাড়া যদি জাতীয় সরকার হয়, তাহলে আমাদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য।’
বিএনপির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী ঐক্যফ্রন্টের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘মূল দাবিটা হলো এই সরকারের পরিবর্তন। দেশে সরকার পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেদিকে যাবে, তা ঠেকানের জন্য একক দলের পক্ষে সম্ভব হবে না। এলডিপির সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা নিয়মিত বৈঠক। সেখানে দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে কথা হয়েছে। সেখানে জাতীয় সরকার প্রসঙ্গও ছিল।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এটা কোনো বিরোধের বিষয় নয়। বিএনপি নিজেই এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। তারা বলছে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার, মানে নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার।’
সূত্র জানায়, জাতীয় সরকারের পক্ষে সমমনা গণফোরাম (মন্টু), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন প্রভৃতি দলও রয়েছে। তবে হঠাৎ করে জাতীয় সরকারের দাবিতে যেসব দল সরব, তাদের সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি।
দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, জাতীয় সরকারের পক্ষে যারা কথা বলছেন, তারা নিজেদের স্বার্থেই কথা বলছেন। সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারা আশানুরূপ মূল্যায়ন না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে জাতীয় সরকারের দাবিতে একাট্টা হতে পারেন।
তাদের পেছনে একটি তৃতীয় গোষ্ঠীও রয়েছে বলে ধারণা করছেন। যাদের সঙ্গে সরকারেরও সম্পর্ক রয়েছে। নেতারা আরো বলেন, অনির্বাচিত জাতীয় সরকারের অধীনে দুই বছর রাষ্ট্র চলতে পারে না।