অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী শিক্ষাবিদ :
কখনো কখনো নিজেকে চিনতে পারিনা | হ্যাংলা পাতলা
একটা মানুষ এসেছিলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ে | তখন ভাবতাম, আমি শিক্ষক হিসেবে এসেছি | সময় যত
গড়িয়েছে ততই বুঝেছি শিক্ষক হওয়া খুব কঠিন, বরং যতই দিন যাচ্ছে ততই বুঝতে
পারছি আমি শেখাতে আসিনি, শিখতে এসেছি | আমি শিক্ষক হতে পারিনি, তবে ছাত্র
হবার চেষ্টা করছি |
তখন চোখে চশমা ছিলোনা, এখন কানের উপর ভর
করে দু'চোখে চশমা জায়গা দখল করে নিয়েছে | যখন চোখে চশমা
ছিলোনা তখন ব্ল্যাকবোর্ড আর সাদা চক ছিল সম্বল | বই হাতে কখনো ক্লাসে ঢুকবোনা, নিজেই একটা বই হবার চেষ্টা
করবো, এমন একটা চিন্তা নিয়েই আমার এখানকার যাত্রাটা
শুরু হয়েছিল | জানিনা নিজে বই হতে পেরেছি কিনা, তবে যাদের
ছাত্র হিসেবে পেয়েছি তারাই আমার কাছে এক একটা বই, এক একটা বিস্ময় হয়েছে | ওদের পড়াতে
গিয়ে, নিজে শিখেছি | শিখতে গিয়ে বুঝেছি, শিক্ষক হওয়া
হয়তো আর কখনো হয়ে উঠবেনা | অদ্ভুত মনে হলেও সত্য, এখনও শিক্ষক
হতে পারিনি, তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি | হয়তো এই
চেষ্টাটা আমৃত্যুই চলতে থাকবে, কিন্তু শিক্ষক হওয়ার পিপাসাটা
কখনোই মিটবেনা |
গবেষণার কিছুই জানতাম না, এখনো জানিনা | এখনও গবেষণা
শিখছি, আমার ছাত্ররাই আমাকে শেখাচ্ছে | ওদের নতুন
নতুন চিন্তা, নতুন নতুন আইডিয়া, নতুন নতুন
স্বপ্ন, আমাকেও বিষয়গুলো নিয়ে
ভাবতে আগ্রহী করছে | ওদের মতো এতো মেধাবী আমি নই, ওদের চিন্তার
গতির সাথে আমার চিন্তার গতি কখনোই পেরে উঠেনি, বরং ওদের চিন্তা আমার চিন্তাকে এগিয়ে নিয়েছে | আমার কাছে
আমার ছাত্ররাই আমার শিক্ষক, আমি তাদের ছাত্র | আর শিক্ষকরা মেধাবী হলে
গবেষণায় ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই | বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে মনে হয়েছিল, গতানুগতিক
শিক্ষাদানের মধ্যেই বুঝি শিক্ষা বন্দি হয়ে থাকবে | কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে ততই বুঝেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে
শিক্ষাদানের চেয়েও বড় নতুন নতুন জ্ঞানের জন্ম দেওয়া | কিন্তু সেটাতে
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতটা এগিয়েছে, সেটা হয়তো ভাবনার বিষয় | সেখানে
আত্মসমালোচনটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ | কিন্তু আত্মসমালোচনাতে আমরা ভয় পাই, যতটা সাহসী
আমরা আত্মপ্রচারে | এর সাথে ক্ষমতার অসুখও এখন প্রায় সবার শরীরে
বাসা বেঁধেছে | শরীরের রোগ সরানো যায়, মনের রোগ
সারানোর কোনো ওষুধও নেই, চিকিৎসাও নেই |
তখন শুনেছি, গবেষণা করার পরিবেশ এই দেশে নেই | গবেষণা করতে
দামি দামি যন্ত্রপাতি লাগে, অনেক অর্থের বাজেট লাগে | এতো অর্থ, এতো দামি যন্ত্রপাতি
কেনার কি আমাদের সাধ্য আছে | এমন সময়টাতেই আমার ছাত্ররাই
খুব কম বাজেটে আধুনিক যন্ত্রপাতি ডিজাইন করেছে, তৈরী করেছে | | গবেষণার অধরা স্বপ্ন ওদের সৃজনশীল সৃষ্টি
দিয়েই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে | সেই ধারা এখনও অব্যাহত আছে | ওদের এখন
দেখছি, মলিকুলার ডিনামিক্স, ডেনসিটি
ফাংশনাল থিওরি, মেটল্যাবের মতো জটিল জটিল বিষয়গুলো
কত সহজে সমাধান করছে | তখন আমি মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলোকে এলিয়ে
নিচ্ছি, যদি চুলগুলো নড়াতে গিয়ে আমার ভোঁতা মগজটাই
নতুন করে নড়েচড়ে উঠে !
ব্ল্যাকবোর্ড-চকের যুগ গেলো, হোয়াইট
বোর্ড-মার্কার পেনের যুগ গেলো, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের যুগ গেলো, এখন এসেছে
স্মার্ট বোর্ড | খুব আনস্মার্ট আর বোকা মানুষ আমি, স্মার্ট
বোর্ডে পড়াতে গিয়ে যখন প্রায় প্রতিদিন খেই হারিয়ে ফেলি, তখন আমার
এখনকার মেধাবী ও সম্ভাবনাময় ছাত্ররাই আমাকে শিখিয়ে দিচ্ছে কত সহজে স্মার্ট বোর্ড
ব্যবহার করে সারা পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারকে হাতের নাগালে আনা যায় | ওদের কাছে
শিখতে গিয়ে খুব আনন্দ পাচ্ছি, গর্বিত হচ্ছি, ওরাও আমার মতো বোকা একটা ছাত্র পেয়ে আনন্দ
পাচ্ছে | শিক্ষার মধ্যেই তো আনন্দ, যে শিক্ষায়
আনন্দ নেই, সেই শিক্ষা মূল্যহীন | বড় বড়
মনীষীদের কথা | খুব ছোট একটা মানুষ আমি | কিন্তু যখন
দেখছি আমার ছাত্ররা দেশ ছাড়িয়ে সারা পৃথিবী জয় করে চলেছে, তখন চোখে
আনন্দ অশ্রু, গর্বিত বুক | সন্তানরা যখন এগিয়ে যায় বাবারা তখন সত্যিকার
অর্থেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হয়ে উঠে |
আমি ঝুলন্ত তারার মতো, কখনো কেঁদেছি, কখনো হেসেছি, কখনো অভিমান
করেছি কিন্তু জীবনের সবচেয়ে পরম পাওয়াগুলো আমার প্রিয় সন্তানরাই দিয়েছে | আমি ঝুলন্ত
তারা, যেদিন আকাশ থেকে খসে পড়বো, সেদিনও ওদের জীবনজয়ের
জয়োধ্বনিগুলো কান পেতে শুনবো | আমার মতো একটা সাধারণ মানুষকে কেউ হয়তো মনে
রাখবেনা, এটাই প্রকৃতির নিয়ম, সময়ের স্রোতে
সব যে হারিয়ে যায়, তবে জীবনের অনেক না বলা কথা থেকে যাবে
মহাকর্ষীয় তরঙ্গে তরঙ্গে |
আমি হয়তো মানুষ না, ছিলামও না, হয়তো আমি একটা
চিত্রকরের কল্পনায় আঁকা ছবি | আমি কাঁদছিনা, আমি বৃষ্টিতে কল্পনায় হাটছি, বৃষ্টিতে
কাঁদতে গেলে বৃষ্টি সেই কান্না খেয়ে ফেলে, হাসিমুখটা তখন বেরিয়ে আসে | হয়তো কান্না
লুকিয়ে হাসির চেষ্টাটাই জীবন | জীবন খুব কঠিন একটা বিষয়, এর পরীক্ষাটাও
কঠিন, কারণ জীবনের পরীক্ষায় পাশ-ফেল নেই |