-অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরীর ফেসবুক থেকে নেয়া ঃ
পৃথিবীর নিয়মটাই অদ্ভুত | আর এই নিয়ম পরিবর্তনে সময়ের একটা মুখ্য ভূমিকা আছে | যখন সন্তানরা ছোট থাকে তখন সব ভাইবোনেরা মাকে নিজের সম্পদ বলে দাবি করতে গিয়ে ঝগড়া শুরু করে দেয় | সেই সময় মায়ের বুকটা গর্বে ভরে উঠে | সন্তানদের তার প্রতি এতো ভালোবাসা দেখে মা ভিতরে ভিতরে এমন ভাগ্য নিয়ে জন্ম নিতে পেরেছেন বলে আনন্দে কেঁদে উঠেন | সময় গড়ায়, সন্তানরা বড় হয় | নিজ নিজ সংসার গড়ে তুলে | মায়ের তখন বয়স হয়েছে | একসময়ের মূল্যবান মা তখন মূল্যহীন হয়ে যায় | অনেকটা নতুন প্রযুক্তি আগমনের সাথে সাথে পুরাতন প্রযুক্তির অপ্রচলিত পণ্যে পরিণত হবার মতো | সে সময়টাই মা খুব অসহায় হয় | সময় কেমন করে যেন সন্তানদের পাল্টে দেয় | এখন ভাইবোনদের কাছে তাদের মা আর সম্পদ নেই বরং মাথার বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে | এক সময় আমার মা, আমার মা দাবি করা সন্তানরা, ঠিক উল্টোভাবে বলতে থাকে তোর মা, তোর মা | তোর মায়ের দায়িত্ব তুই নে | খুব নির্মম একটা পৃথিবী যেখানে আমার মা একদিন তোর মা হয়ে যায় | তখন কেউ আর মায়ের সন্তান হতে চায়না, দায়িত্ব নেবার মতো বড়ত্ব দেখাতে পারেনা | এতগুলো সন্তান জন্ম দিয়ে এভাবেই একদিন আমাদের মায়েরা সন্তানহীন হয়ে পড়ে | মায়ের সেদিনের গর্বে ভরে উঠা বুকটাতে বরফ জমতেই থাকে, জমতে জমতে হয়তো তা একদিন সবার অজান্তে বাস্প হয়ে যায় | মা এতগুলো কুসন্তান জন্ম দিয়েও তখনও সন্তানদের জন্য মঙ্গল কামনা করতে থাকেন | সন্তানদের কাছে মায়ের পরিচয় বদলে যায় কিন্তু মায়ের কাছে সন্তানরা সন্তান হিসেবেই আমৃত্যু থেকে যায় |
একটা বস্তির ছেলে | লেখাপড়ার খুব ইচ্ছে অথচ দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া হয়ে উঠছেনা | যে বয়সে হাতে বই থাকার কথা, সে বয়সে সংসারের দায়িত্বভার তাকেই নিতে হচ্ছে | ঠিক উল্টোদিকে খুব নামকরা এক পরিবারের সন্তান | মা-বাবা কোনো ধরণের অভাব তার রাখেনি অথচ লেখাপড়ায় তার মন নেই | লেখাপড়ার চেয়ে ভোগ-বিলাসিতায় তার ঝোক বেশি | দুটো ছেলেই ভবিষ্যতে বড় হতে পারবেনা হয়তো | কিন্তু বস্তির ছেলেটার অনেক বড় একজন মানুষ হবার সম্ভাবনা ছিল, তা তো হলোনা |কারণ স্বার্থের সমাজ নিজেরটাই বুঝে, সমাজের দায়িত্ব নেওয়াটা বুঝেনা | হয়তো সমাজ বস্তির ছেলেটার দায়িত্ব নিলে ছেলেটার জীবনটাই বদলে যেত | সমাজ এখানে ব্যর্থ, যেমন ব্যর্থ অনেক মানবিক জায়গাতেও |
সমাজে এমন অনেক অমীমাংসিত ও বিপরীতমুখী ঘটনার জন্ম হচ্ছে | আমরা কতটুকু এগুলোর বিশ্লেষণ করছি | বরং আমাদের বেশিরভাগ বিশ্লেষণ অন্য বিষয়গুলোতে যেগুলোর আসলে কোনো মানবিক মূল্য নেই | হয়তো সমাজ বদলাতে অর্থনৈতিক ভাবনার চেয়ে মানবিক ভাবনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার | অর্থনীতির চাকা ঘুরলে টাকার পরিমান হয়তো বাড়বে কিন্তু মানবিক মূল্যবোধের মানুষের সংখ্যা কমবে | সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সমাজ যখন মানবিক ধারণা দ্বারা তাড়িত হবে তখন অর্থনীতি নিজে নিজেই শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে যাবে |
-