রোকসানা মনোয়ার : দূষণ-দখলের কারণে ঢাকার চারপাশের
নদী ও জলাশয়ের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ফলে নগরীর প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ
বাসিন্দার ঘরে ও শিল্প কারখানায় সরবরাহ করা প্রায় ৭০ শতাংশ পানি উত্তোলন করতে
হচ্ছে মাটির নিচ থেকে। শুধু ঢাকা ওয়াসাই প্রতিদিন প্রায় ৩৩ লাখ ঘনমিটার ভূগর্ভস্থ
পানি উত্তোলন করে। আবার উত্তোলন করা এ পানির অন্তত ২৫ শতাংশ অপচয় হচ্ছে সরবরাহ
প্রক্রিয়ার ত্রুটির কারণে।
সারা দেশে ১ হাজার
২৭২টি পর্যবেক্ষণ কূপের মাধ্যমে ৬০ বছর ধরে পানির পরিমাণ ও গুণমান পর্যবেক্ষণ করছে
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তাদের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকার ভূগর্ভস্থ
পানির স্তর প্রতি বছর ২ মিটার বা প্রায় ৭ ফুট করে নেমে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি বিশেষজ্ঞ
এবং পাউবো পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ বলেন, ‘ঢাকার মাটির নিচে একটি বড় বিপর্যয়
তৈরি হচ্ছে। মাটির নিচে হচ্ছে বলে আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ
করে আমরা বিপর্যয়ের ধারণাই পাচ্ছি।’
কয়েক দশক আগেই ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন পাউবো
এবং গবেষকরা। ১৯৯৬ সালে ঢাকায় পানির স্তর ছিল ২৫ মিটারে, যা ২০০৫ সালে ৪৫ মিটার,
২০১০ সালে ৬০ মিটার এবং ২০২৩ সালে এসে ৭৫ মিটারে নেমেছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এটি
নেমে যেতে পারে ১২০ মিটারে। ওয়াসার প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে প্রতিদিন ৩৫ লাখ
ঘনমিটার, ২০৩০ সালে প্রতিদিন ৪৩ লাখ ঘনমিটার এবং ২০৩৫ সালে প্রতিদিন ৫২ লাখ
ঘনমিটার পানির চাহিদা থাকবে ঢাকায়।
বিশ্বের তৃতীয়
সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকার ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা মেটাতে ওয়াসার ১ হাজার
পাম্প ছাড়াও ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপন করা অন্তত ২ হাজার গভীর নলকূপ ও আরো কয়েক
হাজার অননুমোদিত গভীর নলকূপ দিয়ে প্রতিদিন ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হচ্ছে। অপরিকল্পিত
শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে এ নগরী প্রতিনিয়ত বর্ধিত হচ্ছে এবং এর বাসিন্দাও বাড়ছে।
ফলে ঢাকায় পানির চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে। পরিসংখ্যানবিষয়ক জার্মান প্রতিষ্ঠান
স্ট্যাটিস্টার তথ্যানুসারে, কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়েও
ঢাকার জনঘনত্ব বেশি। কুতুপালংয়ে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করেন ২৮ হাজার ৯৫৮ জন,
আর ঢাকায় ৩০ হাজার ৯১১ জন।
অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি
উত্তোলনের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে পাউবোর পরিসংখ্যানে।
১৯৭০ সালেও ঢাকা শহরে ৬ মিটার বা প্রায় ২০ ফুট মাটির নিচেই পানি পাওয়া যেত। অথচ
২০২৩ সালে ৭৩ মিটার বা প্রায় ২৪০ ফুটের আগে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকার কেন্দ্রে
ভূগর্ভস্থ পানি স্তর নেমে যাওয়ায় একটি শূন্যস্থান চিহ্নিত করেছেন ভূবিজ্ঞানীরা।
ভূতত্ত্বের ভাষায় যাকে বলে ‘কম্পাউন্ড কোন অব ডিপ্রেশন’।
এ কম্পাউন্ড কোন অব ডিপ্রেশনের বিস্তার ঢাকার কেন্দ্র থেকে আশপাশের উপজেলা; যেমন
টঙ্গী, সাভার, ধামরাই, দোহার ও নবাবগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এ
অবস্থায় ভূমিধসের আশঙ্কা তৈরি হওয়ার কথা থাকলেও আশার ব্যাপার হলো, বিশ্বের বৃহত্তম
ব-দ্বীপ বাংলাদেশের ভূগর্ভের বালির স্তরের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে তা এখন পর্যন্ত
বিপর্যয় ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
ভূগর্ভস্থ জলাধারের উপরের অংশের পুরু পলির স্তর বালুর কণা পুনর্গঠন ও কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত পানির পরিমাণ কমে যাওয়ার চাপ সামলে নিতে পারছে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানি বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যখন ওয়াসা এবং অন্যরা গভীর নলকূপের সাহায্যে ৩০০ মিটার বা ৯৮৪ ফুট গভীর থেকে পানি উত্তোলন করতে শুরু করবে, তা হবে অপূরণীয় ক্ষতির কারণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কাজী মতিন আহমেদ বলেন, ‘কাদামাটির স্তরা বালুর স্তরের ঠিক বিপরীত আচরণ করে। কাদার স্তরে (পুরুত্ব ৬০ ফুট পর্যন্ত) কোন অব ডিপ্রেশন তৈরি হলে ভূমিধস এবং ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ ধ্বংস হতে পারে।
কাজী মতিন আহমেদ আরো বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ অসীম না। সরকারকে
অবশ্যই জাতীয় অগ্রাধিকার বিবেচনায় এর ব্যবস্থাপনা করতে হবে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে
এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।’ এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও
পানির সংকটকে আরো জটিল করে তুলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেও মিঠা পানির
রিজার্ভে হুমকি বাড়ছে। তারপরও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হলে
ঢাকা সংকটমুক্ত থাকতে পারে বলে মনে করেন প্রধান গবেষক ও পাউবো পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ।
ড. জাহিদ বলেন, এ
বিষয়ে সবার আগে নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে যে পানির সংকট অতি সন্নিকটে। যদি তারা
এটা বিশ্বাস করে, তাহলে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি প্রতিটি সরকারের শীর্ষ
অগ্রাধিকারে পরিণত হবে। সরকার ২০১৩ সালে ‘বাংলাদেশ পানি আইন’
প্রণয়ন করে এবং ২০১৮ সালে আইন পাশ করে। অথচ আজও আইনটি কার্যকর করা হয়নি। এ আইনেরও অনেক
অপ্রতুলতা রয়েছে। সব ধরনের পানি নিয়ে এ আইন তৈরি করা হলেও এতে ভূগর্ভস্থ পানির বিষয়ে
খুব একটা জোর দেওয়া হয়নি। অথচ দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার ও অপব্যবহার করা হচ্ছে এ ভূগর্ভস্থ
পানি।
তিনি আরো বলেন, আইনে খাতভিত্তিক পানি ব্যবহারে অগ্রাধিকারের রূপরেখা, পানির চাহিদা
বেশি থাকা অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ এবং জলসম্পদ সংরক্ষণের জন্য ওয়ারপো বা পানি সম্পদ
পরিকল্পনা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ভূবিজ্ঞানী বা প্রকৌশলীদের নেতৃত্বে
পরিচালনার বদলে ওয়ারপো পরিচালিত হচ্ছে আমলাদের মাধ্যমে এবং বাস্তবে তারা শুধু
পরিকল্পনাই করছে, কোনো বাস্তবায়ন নেই। ড. জাহিদ মনে করেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের
অধীনে একটি পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন একক কর্তৃপক্ষকে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনার
দায়িত্ব দেওয়া উচিত। ভূবিজ্ঞানী বা ভূগর্ভস্থ পানি বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে একটি
ভূগর্ভস্থ পানি কমিশন তৈরি করা হলেই, শুধু ঢাকাকে পানিশূন্য হয়ে যাওয়া থেকে
বাঁচানো সম্ভব।