শারদোৎসবে মাতোয়ারা চারদিক। আনন্দময়ীর আগমনী সুরে অনুরণিত এখন চারদিক। খ—গ-কৃপাণ, চক্র-গদা, তীর-ধনুক আর ত্রিশূল হস্তে শক্তিরুপেন দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধে ম-পে ম-পে আজ ঠাঁই নেবেন। ‘যা দেবী সর্বভূতেসু মাতরুপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যে নমস্তসৌ নমস্তেসৌ নমোঃ নমোঃ’ মন্ত্রোচ্চারণে আজ শুক্রবার জেগে উঠবেন দক্ষিণায়নের নিদ্রিত দশভুজা দেবী দুর্গা।
বোধনে খুলে যাবে দশপ্রহরণধারিণী ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার অতল স্নিগ্ধ চোখের পলক।
আর আজ দেবীর বোধন ও ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে সারাদেশে শুরু হচ্ছে পাঁচ দিনব্যাপী বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ শারদীয় দুর্গোৎসব।
মহাষষ্ঠীতে ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে সূচনা ঘটছে শারদোৎসবের।
পাঁচ দিনের এ উৎসব শেষ হবে আগামী ২৪ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে।
এর আগে গত ১৪ অক্টোবর দেবী দুর্গার আবাহন বা মহালয়ার মধ্য দিয়ে সূচনা হয় দেবীপক্ষের।
সাধারণত দেবীপক্ষ শুরুর সাতদিন পর পাঁচদিনের দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে থাকে।
বছর ঘুরে আবার এসে গেল দেবী পক্ষ। সারাদেশে হাজারো মণ্ডপে নিখুঁত তুলির আঁচড়ে ফুঠে উঠেছে দেবী দুর্গার অনন্যসুন্দর অভয়দানকারী রূপ। আজ থেকে শুরু হচ্ছে দুর্গাপূজা। সারাদেশে ৩২ হাজারেরও বেশি পূজাম-পে আজ ঢাকে পড়বে কাঠি। সায়ংকালে ধূপের ধোঁয়া, ঢাক-ঢোল আর কাঁসর-মন্দিরার সঙ্গে ভক্তিমন্ত্রে মেতে উঠবে পূজাম-প। বর্ণাঢ্য আলোকসজ্জায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে পূজাম-পগুলো। দেবীদুর্গাকে ভক্তিভরে বরণ করতে সারাদেশের কোটি কোটি হিন্দু নর-নারী প্রস্তুত।
দুর্গতিনাশিনী দুর্গা সবার মঙ্গলের জন্য আসছেন। শান্তি, সংহতি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামের প্রতীক দেবী দুর্গা। মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা হচ্ছেন দুর্গতিনাশিনী। সব অনাচার তিনি দূর করে দেন তার মঙ্গলালোক, শুভ ও কল্যাণচিন্তায়। হিন্দু শাস্ত্রানুসারে, মা দুর্গা হচ্ছেন আদ্যশক্তি দেবী ভগবতী। তার বহুরূপ। পর্বতরাজ হিমালয়ের কন্যা বলে তিনি পাবর্তী। আবার দুর্গম নামের অসুরকে বধ করেছিলেন বলে তার অন্য নাম দুর্গা। আবার তিনিই চণ্ডী মহিষাসুরমর্দিনী।পূজায় চন্ডীপাঠ করার সময় তাই এই দেবীর প্রার্থনায় বলা হয়-
‘রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশো দেহি, দ্বিষো জহি।’ অর্থাৎ হে দেবী তুমি আমাকে রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও এবং শত্রুর কবল থেকে মুক্ত কর।
পূরাণ মতে, রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। তিনি বসন্তে পূজার আয়োজন করায় দেবীর এ পূজাকে বাসন্তী পূজাও বলা হয়। কিন্তু রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে লংকা যাত্রার আগে শ্রী রামচন্দ্র দেবীর পূজার আয়োজন করেছিলেন শরৎকালের অমাবস্যা তিথিতে, যা শারদীয় দুর্গোৎসব নামে পরিচিত। দেবীর শরৎকালের পূজাকে এজন্যই হিন্দুমতে অকাল বোধনও বলা হয়।
এ বছরের দুর্গাপূজার নির্ঘণ্ট অনুযায়ী, আজ শুক্রবার মহাষষ্ঠী। এদিন ষষ্ঠীতিথিতে সকাল ৯টা ৫৮ মিনিটের মধ্যে দেবীর ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠীবিহিত পূজা শুরু হবে। সায়ংকালে দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হবে মূল দুর্গোৎসব। চন্ডিপাঠে মুখরিত থাকবে সকল মন্ডপ
মন্দির এলাকা। শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রাক্কালে এই বোধনের মাধ্যমে দক্ষিণায়নের নিদ্রিত দেবী দুর্গার নিদ্রা ভাঙার জন্য বন্দনা পূজা করা হয়।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন আগামীকাল শনিবার মহাসপ্তমী পূজা অনুষ্ঠিত হবে সকাল ৬টা ১০ মিনিটে। পরদিন রবিবার মহাষ্টমী পূজা অনুষ্ঠিত হবে সকাল ৬টা ১০ মিনিটে এবং বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত হবে কুমারী পূজা। সন্ধিপূজা শুরু হবে রাত ৮টা ৬ মিনিটে। সোমবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে শুরু হবে মহানবমী পূজা। পরদিন মঙ্গলবার দশমী পূজা শুরু হবে সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে। পূজা সমাপন ও দর্পণ বিসর্জন হবে সকাল ৯টা ৪৯ মিনিটের মধ্যে। সন্ধ্যায় আরাত্রিকের পর প্রতিমা বিসর্জন ও শান্তিজল গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাঁচদিন ব্যাপী এই উৎসবের।
দুর্গোৎসব চলাকালে পূজার প্রতিদিনই অঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ ও ভোগআরতির আয়োজন করা হবে। এছাড়া দেশজুড়ে দুর্গোৎসব চলাকালে মণ্ডপে মণ্ডপে আলোকসজ্জা, আরতি প্রতিযোগিতা, স্বেচ্ছায় রক্তদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, নাটক, নৃত্যনাট্যসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হবে।
দুর্গোৎসব উপলক্ষে পৃথক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-
খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ এবং মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটিসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারাও।
পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার ঘোটকে (ঘোড়া) চড়ে স্বর্গালোক থেকে মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) আসবেন (আগমন)। দেবী বিদায়ও (গমন) নেবেন ঘোটকে চড়ে। যার ফল হচ্ছে ফসল ও শস্যহানি।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের প্রতিটি পূজামন্ডপের নিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশ, আনসার, র্যাব ও বিডিআর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। পুলিশ এবং র্যাবের পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি মণ্ডপে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দায়িত্ব পালন করবেন। মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির উদ্যোগে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে।
এবারের দুর্গাপূজায় সারাদেশে যে কোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে পূজাম-প এবং আশপাশের এলাকায়। ৩২ হাজার পূজামন্ডপে পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য মিলিয়ে লক্ষাধিক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, র্যাবের প্রতি ইউনিটেই প্রস্তুত থাকবে স্ট্রাইকিং ফোর্স। পূজামন্ডপ ঘিরে কোনো রকম বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া মাত্রই স্ট্রাইকিং ফোর্স ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
রাজধানীতে কেন্দ্রীয় পূজা উৎসব বলে পরিচিত ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পূজামন্ডপে আজ পাঁচদিনের শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা ঘটবে। পূজার পাশাপাশি ভক্তিমূলক সংগীতানুষ্ঠান, দুস্থদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আরতি প্রতিযোগিতা, স্বেচ্ছায় রক্তদান ও শেষ দিনে বিজয়া শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।
রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ পূজামন্ডপে মহাষ্টমী ও কুমারী পূজার দিনে মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হবে। গুলশান-বনানী সার্বজনীন পূজা উদ্যাপন পরিষদের আয়োজনে বনানী পূজামন্ডপে পূজার পাঁচদিনই বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে। রাজারবাগের বরোদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির ও শ্মশান কমিটির পূজামন্ডপে
পূজার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াও দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নৃত্যনাট্য ও নাটক পরিবেশিত হবে। মিরপুর কেন্দ্রীয় মন্দির পূজাম-পে অনুরূপ আয়োজন থাকছে। জয়কালী রোডের রামসীতা মন্দিরে আলোচনা সভা ও দরিদ্রদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ করা হবে।