তিনস্তরে ভ্যাট কমানোর সুবিধা ভোক্তা পর্যায়ে কার্যকর করতে আজ রবিবার বেলা ৩টায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে জরুরী বৈঠক ডাকা হয়েছে। সভায় ভোজ্যতেলের আমদানিকারক, মিলমালিক, রিফাইনার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা উপস্থিত থাকবেন। ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণসহ ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমিয়ে আনতে এই বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। এদিকে, আসন্ন রমজান মাস সামনে রেখে দাম কমাতে ভোজ্যতেল ও চিনির মতো অতিপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। নিত্যপণ্যের বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে সয়াবিনের আমদানি পর্যায়ে ১০ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ ভাগ অর্থাৎ মোট ৩০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। গত কয়েক দশকের মধ্যে দেশে এখন সর্বোচ্চ দামে ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে। ভ্যাট কমানোর এই সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে কার্যকর হলে খুচরা পর্যায়ে দাম অনেক কমে আসবে। অথচ প্রজ্ঞাপন জারির পরও খুচরা বাজারে দাম কমেনি। ভ্যাট কমানোর সুফল যাতে ভোক্তারা পান সেদিকে তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমান বাজারে সয়াবিন তেলের প্রতিলিটার বোতলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৬৮ টাকা। ঘোষিত হারে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলে প্রতি লিটারে দাম ২৯-৩০ টাকার মতো কমতে পারে বলে ধারণা দিয়েছেন সয়াবিন তেল আমদানিকারক অন্যতম কোম্পানি সিটি গ্রুপের বিপণন বিভাগের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা। তিনি জানান, ভ্যাট কমানোর ইতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়বে। এছাড়া বাংলাদশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো বলেন, রমজান সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা আগেই ভ্যাট কমানোর দাবি জানিয়ে আসছিল। অবশেষে ভ্যাট প্রত্যাহার করায় ভোজ্যতেলের বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক অন্যান্য সঙ্কটের মুখে অস্থির বাজার। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ভোগ্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
বাজারে গোয়েন্দা নজরদারি ও অভিযান পরিচালনা আরও জোরদার করা হচ্ছে ॥ রোজা সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম কমাতে বাজারে অভিযান আরও জোরদার করা হচ্ছে। বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো ও অবৈধভাবে মজুদ করার বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ইতোমধ্যে তারা সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের তালিকা করেছেন। তালিকা অনুযায়ী প্রত্যেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গুদামে নজরদারি করা হচ্ছে। একইসঙ্গে প্রতিটি পাইকারি বাজারে সাদা পোশাকে নজরদারি করা হচ্ছে। যেসব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে অধিক মুনাফার আশায় বাজারে সঙ্কট তৈরি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে একাধিকবার বৈঠকও করেছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, আমরা বাজারের অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্মকা- মনিটরিংয়ের কাজ শুরু করেছি। গোয়েন্দা পুলিশের সব ইউনিটকে এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে সিন্ডিকেট তৈরি করে কোনও পণ্যের দাম বাড়াতে না পারে, সেজন্য নজরদারি চলছে। প্রয়োজনে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হবে। একাধিক গোয়েন্দায় সংস্থার সদস্যরা জানান, ‘সম্প্রতি সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার পর আরও সঙ্কট দেখিয়ে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী বেশি দামে বিক্রি করছে। বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা শুরু হলে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি দেখতে বলা হয়। এই নির্দেশনার পরপরই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ গোয়েন্দা ইউনিটকে অসাধু ব্যবসায়ীদের ধরতে নজরদারি করতে বলে।
গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তারা ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকার ভেতরে যত পাইকারি বাজার রয়েছে, সেই তালিকা করে বাজার অনুযায়ী আড়দদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের তালিকা করা শুরু করেছেন। কে কোন পণ্য আমদানি-রফতানি করে, সেই তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি কার কোথায় গুদাম রয়েছে, তা জানার চেষ্টা চলছে। ছদ্মবেশে বা ক্রেতা সেজে সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা এসব পাইকারি মার্কেট থেকে পণ্য কেনার পর-সঙ্কট তৈরির হোতাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, প্রতিবছর রমজান আসার আগে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী পণ্য গুদামজাত করে বাজারে সঙ্কট তৈরি করে। পরে তা বেশি দামে বিক্রির চেষ্টা করে। চলতি বছরও আসছে রমজানের আগেই বাজার কিছুটা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ঢাকার বাইরে থেকে আনা পণ্য কেন দ্বিগুণ বা তিনগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
পুলিশের বিশেষ শাখার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্যান্য বছরের মতো চলতি বছরেও রমজান মাসে বিভিন্ন পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে দ্রব্যমূল্য উর্ধগতিতে তোলার জন্য একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। এখন থেকেই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা ও নজরদারি করা না হলে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এই সিন্ডিকেট সরকারকে বেকায়দায় ফেলে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পারে। এজন্য গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশও করা হয়েছে।
ঢাকার বাইরে থেকে পণ্য আসার ক্ষেত্রে পথের সব ভোগান্তি, বিশেষ করে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। কনজিউমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজারে এমনভাবে নজরদারি করতে হবে যাতে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি না হয়-আবার অসাধু ব্যবসায়ীরাও যাতে কোন কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করতে না পারে। অর্থাৎ দুষ্ট দমনের পাশাপাশি শিষ্টের পালন করতে হবে। ভাল ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দিতে হবে। আর খারাপ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই বাজারে একটা স্থিতিশীল পরিবেশ আসতে পারে