বেলা ১১টা। রাজধানীর খামারবাড়ী এলাকা। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে রাস্তার পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে দুই শতাধিক লোক। সময় যত বাড়ছিল সারিও লম্বা হচ্ছিল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। কেউ রাস্তায় বসে পড়েছেন। টিসিবির পণ্যবাহী একটি ট্রাক আসতেই হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। এমন দৃশ্য দেখা গেছে গতকাল বৃহস্পতিবার।
ক্রেতার সারিতে দাঁড়ানো লোকজনের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের চাকরিজীবী ও শ্রমজীবী। তাদের একজন পশ্চিম রাজারবাগের বাসিন্দা মো. কামাল। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, গতকাল (বুধবার) দুপুরের আগেই ট্রাকের সব পণ্য বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। অনেক ক্ষণ অপেক্ষায় থেকেও পণ্য না পেয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। তাই আজ (বৃহস্পতিবার) সকালেই এসেছেন। যত মানুষ সারিতে দাঁড়িয়েছেন তাতে তিনি পণ্য কিনতে পারবেন কি না তাতে সংশয় রয়েছে বলেও জানান।
কামাল বলেন, ‘মানুষ কতটা কষ্টে আছে এই লাইন দেখলেই বোঝা যায়। টিসিবি থেকে ৬০০ টাকার পণ্য কিনলে প্রায় ২০০ টাকা সাশ্রয় হয়। এটা আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কম না।
টিসিবির ট্রাকে তেল, চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ বিক্রি হয়। ক্রেতাকে একসঙ্গে চারটি পণ্যই কিনতে হয়। এর মধ্যে পেঁয়াজ ছাড়া বাকি তিন পণ্যের দামই দিন দিন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
গত প্রায় দুই বছর ধরে চলা করোনা মহামারীতে একদিকে মানুষের আয় কমেছে, বেড়েছে অতি দরিদ্রের হার। অন্যদিকে বেড়েই চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। একই সঙ্গে বেড়েছে অন্য সরকারি-বেসরকারি সেবার দামও। এতে মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। কিছুটা কম দামে পণ্য কিনতে তাই নিম্ন আয়ের মানুষ ভিড় করছেন টিসিবির ট্রাকের সামনে। এই তালিকায় যোগ হয়েছে মধ্যবিত্তও।
ভোগান্তি উপেক্ষা করেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা সারিতে দাঁড়িয়ে থাকছে মানুষ, তবু যেন কিছু অর্থ সাশ্রয় হয়। তবে ট্রাকে চাহিদার তুলনায় কম পণ্য থাকায় বেশিরভাগকেই ফিরতে হয় খালি হাতে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারেও ডাল, তেল ও চিনির দাম বাড়ছে। নিত্যপণ্যের মূল বৃদ্ধির লাগাম টানতে বিভিন্ন পণ্যে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।
গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, টিসিবির খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি স্পটগুলোতে সকাল থেকে মানুষ সারি বেঁধে অপেক্ষা করে।
গতকাল রাজধানীর সচিবালয় গেটে গিয়ে দেখা যায়, বেলা না গড়াতেই সব পণ্য বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। নয়ন নামে এক ক্রেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সকালে অফিসের চাপ থাকায় নামাজের বিরতিতে এসেছি। এসে লাইনে (সারি) ৩০ মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন তারা (টিসিবির বিক্রেতা) বলছে পণ্য শেষ। বাসায় আজ তেলও নেই। এখন বাড়তি দাম দিয়ে দোকান থেকে কেনা ছাড়া উপায় নেই।’
টিসিবির আলাউদ্দিন নামে এক বিক্রেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রতিদিন ৪০০ জনকে দেওয়ার মতো পণ্য পাই। মানুষের যে পরিমাণ চাপ থাকে তাতে শেষ পর্যন্ত সকলকে দেওয়া সম্ভব না। আমাদের যতটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয় ততটুকুই বিক্রি করি।’
টিসিবির ট্রাকের মাধ্যমে কিছুটা কম দামে পণ্য কিনতে পারলেও এতে অনেক সময় অপচয় হচ্ছে বলে জানান ক্রেতারা। তারা বলেন, পণ্য কিনতে তাদের সকাল ৯টার আগেই এসে অপেক্ষায় থাকতে হয়। কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা লাগে। অনেক সময় আবার ট্রাক আসতে দেরি করলে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হয়। এতে করে তাদের ওই দিন অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ থাকে না। ফলে কিছু টাকা নগদ লাভ হলেও ওই দিনের আয় বন্ধ হয়ে যায়। আর যদি বেশি ভিড় থাকে, তাহলে তো দিনটাই মাটি হয়ে যায়।
ক্রেতারা বলছেন, দেশজুড়ে টিসিবির ট্রাকের সংখ্যা অন্তত দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। রাজধানীতে এই সংখ্যা তিন গুণ করার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
টিসিবির ট্রাক কেবল জেলা ও উপজেলা শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রামের লোকজন এর বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের বড় অংশই সরকারের এই সেবার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
তবে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘সরকার ১ কোটি মানুষকে পণ্য সরবরাহ করবে এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে টিসিবির পণ্য পেতে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়াতে হয়। এতে করে সময় নষ্ট হচ্ছে। আমাদের অনুরোধ থাকবে, যাতে মানুষের ভোগান্তি কমিয়ে আনা হয়। শুধু শহর নয় গ্রাম পর্যায় নিম্ন আয়ের মানুষ যাতে টিসিবির সেবা পায় সেদিকেও সরকারের নজর দিতে হবে।’
টিসিবির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা ইতিমধ্যে তাদের সেবার আওতা দ্বিগুণ করেছে এবং বছর জুড়ে তাদের এই কার্যক্রম চলছে। সেবার পরিধি বাড়াতে ইতিমধ্যে বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে এই সেবার মান দেড়গুণ উন্নীত করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া রাজধানীসহ সারা দেশে আরও ৩টি ওয়্যারহাউজ স্থাপনের কাজ চলছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে সময়মতো ট্রাক পৌঁছাতে পারবে। এতে সেবার মানও বাড়বে, ভোগান্তিও কমবে।
টিসিবি সূত্র বলছে, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সারা দেশে ৪৫০টি পয়েন্টে এখন ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরসহ ঢাকা বিভাগে ১০১টি পয়েন্টে পণ্য বিক্রি হয়। শুক্রবার বাদে সপ্তাহে প্রতিদিন প্রতিটি ট্রাকে দিনে ৬০০ লিটার সয়াবিন তেল, ৪০০ কেজি ডাল, ৫০০ কেজি চিনি এবং ৫০০ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়।
এ বিষয়ে টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, টিসিবির সেন্টার থেকে পণ্য ডিলারদের মধ্যে সরবরাহ করা হয়। দেখা যায় যেগুলো কাছের সেগুলো আগে পৌঁছায়, আর যেগুলো দূরে সেখানে সময় বেশি লাগে। এতে করে বেশিরভাগ স্থানে দুপুরের আগেই পণ্য শেষ হয়ে যায়। প্রতিটি ট্রাকে ৩০০-৪০০ জনের পণ্য থাকে। ফলে অনেক সময় সবার পক্ষে পণ্য পাওয়া সম্ভব হয় না। আবার ঠিকমতো পরিবহন পৌঁছতে না পারায় অনেককে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, রমজান সামনে রেখে টিসিবি বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে। আগের চেয়ে দ্বিগুণ পণ্য সরবরাহ করা হবে। এখন এক কোটি মানুষকে পণ্য সরবরাহ করা হবে। রমজানের আগে এবং পুরো রমজানে এক কোটি মানুষকে পণ্য সরবরাহ করা হবে। এসময় বিক্রয় কেন্দ্রও বাড়ানো হবে।