অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন
সুফিবাদ একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক, সহনশীল ও সার্বজনীন প্রেমময় মতবাদ। ব্যক্তিজীবনকে কলুষমুক্ত রাখা; সব ধরনের লোভ, স্বার্থপরতার ঊধর্ে্ব নিজের অবস্থান সংহত রাখা; পারিবারিক জীবনকে শান্তিময় রাখা এবং সামাজিক জীবনকে সুশৃঙ্খল ও সৌন্দর্যময় রাখার জন্য সুফিবাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সুফিবাদ মানুষকে সত্যিকারের মানুষ তথা 'ইনসানে কামেল' বা পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। মানব হৃদয়কে প্রকৃত অর্থে এক প্রেমিক হৃদয়ে পরিণত করে সুফিবাদ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের সমাজজীবনে ও সভ্যতার
বিকাশে এ মতবাদের রয়েছে অনন্য অবদান।
অলি, সুফি, পীর, ফকির, দরবেশ, গাউস, কুতুব ও সাধক হিসেবে যারা আমাদের সমাজে পরিচিত; মূলত তাদের মাধ্যমেই সুদূর অতীত থেকে বাংলা ভূখণ্ডে শান্তির ধর্ম ইসলামের প্রচার-প্রসার ও বিস্তৃতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। সুফিবাদের মহান দীক্ষায় উজ্জীবিত হয়েই তারা আমাদের এতদঞ্চলে ইসলামের শান্তির সুবাতাস বইতে দিকপালের মতো অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। পারস্য সাহিত্য এবং ইরানি সুফিবাদের প্রভাবে প্রভাবিত অলি-আউলিয়াদের মাধ্যমে এ বিশেষ প্রক্রিয়া আমাদের দেশে প্রচারিত হয়। পারস্য সাহিত্যের ভাবধারার শ্রেষ্ঠ সম্পদ এই সুফিবাদে অভিব্যক্তি লাভ করেছে। উমর খৈয়্যাম, ফেরদৌসি, শেখ সাদি, জালালুদ্দিন রুমি, হাফিয শিরাযি, জামি_ সবাই এ সত্যের পথিক, সাধক, ভাবুক এবং সুফিবাদের প্রত্যক্ষ অনুশীলনকারী।
খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় তুর্কি শাসন স্থায়িত্ব লাভ করলে উত্তর ভারতীয় সুফি মতবাদের ক্ষীণধারা অর্ধশতাব্দীর মধ্যেই প্রবল ভাব ধারণ করে একটি প্রকাণ্ড নদীতে পরিণত হয়। প্রধানত গঙ্গার উভয় কূল ধরে উত্তর ভারতীয় সুফি মতবাদ বাংলায় প্রবেশ করেছিল। উত্তর ভারতীয় সুফিদের মধ্যে বাংলায় সুফি ভাব ও ইসলাম প্রচারের জন্য যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি, খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার খাকি, শেখ ফরিদুদ্দিন গান্জে শকর, নিযামুদ্দিন আউলিয়া, শেখ শরফুদ্দিন বু আলি শাহ কলন্দর, বদিউদ্দিন শাহে মদার, শেখ আহমদ সরহিন্দ মোজাদ্দেদে আলফেসানি প্রমুখ সমধিক প্রসিদ্ধ।
সুফিদের কয়েকটি দল পাক-ভারত উপমহাদেশে আগমন করেন মুসলিম সামরিক শক্তির আবির্ভাবের পূর্বে। বাংলাদেশেও তাদের আগমন হয় সেই যুগেই। প্রথম দলের সাফল্য ও দেশের বিস্তৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সুফিদের সেই অনুপ্রবেশের ধারা অব্যাহত থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। মুসলিম শাসনামলে সেই ধারা শাসকশক্তি ও শরিয়তের সহযোগিতায় প্লাবিত করে দেয় সারা বাংলাদেশ। মুসলিম যুগে বঙ্গদেশ সুফি সাধকদের সংস্পর্শে ভালোভাবেই এসেছিল। বাংলার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। বাংলার ভৌগোলিক সংগঠন হয়েছিল পলিমাটির স্তরে স্তরে। দিনে দিনে আমরা সেই স্তরের ইতিহাস আবিষ্কার করে বিস্মৃত হয়ে চলেছি। বাংলার ধর্ম সম্বন্ধেও সেই একই কথা। ধর্মতত্ত্বের বিশ্লেষণে স্তরের পর স্তরের ইতিহাস আবিষ্কৃত হবে। বিশুদ্ধ বৈদিক ধর্ম বাংলায় স্বীকৃত হয়নি। পুরোহিতের মন্ত্রে, পূজার উপকরণে এবং বরণ ডালায় কত সভ্যতার কত ভাবধারার মিলন ও মিশ্রণ! এসব সম্ভব হয়েছিল বাংলার উদার মানস ক্ষেত্রের জন্য।
বাংলায় মুসলিম রাজশক্তির অভ্যুদয়ের আগে দশম ও একাদশ শতাব্দীতে এবং দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম পাদে যারা বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন, সেসব নিবেদিতপ্রাণ আত্মপ্রচারবিমুখ সুফি মুবালি্লগদের মধ্যে সর্বাগ্র গণ্য হলেন শাহ সুলতান মাহিসওয়ার (রহ.)। তার পুরো নাম মির শাহ সৈয়দ সুলতান মাহমুদ বালখি মাহিসওয়ার (রহ.)। বগুড়া জেলার মহাস্থানে তার পবিত্র মাজার অবস্থিত। তিনি ৪৩৯ হিজরি মোতাবেক ১০৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আগমন করেন। শাহ সুলতান বালখি মাহিসওয়ার ও পরবর্তীকালে আরও অনেক অলি-দরবেশদের মাজার থাকায় পৌণ্ড্রবর্ধনের পরিবর্তে মহাস্থানকে 'মাস্তানগড়' অথবা 'মহাস্থান' নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুফি মাহিসওয়ার মৎস্যাকৃতির বাণিজ্য জাহাজে সমুদ্রপথ অতিক্রম করে বাংলায় আগমন করে সন্দ্বীপে অবস্থান নেন। অতঃপর কিছুকাল পর সুদৃশ্য ও জনাকীর্ণ ঢাকার হরিরামপুর নগরে আসেন। তথাকার হিন্দু রাজা বলরামকে তিনি পরাস্ত করেন।তার অলৌকিকত্বে মুগ্ধ হয়ে রাজার মন্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করে মাহিসওয়ার কর্তৃক সিংহাসনে আরোহণ করেন। তারপর তিনি বগুড়ায় আসেন এবং রাজা পরশুরাম কর্তৃক প্রদত্ত ভূমিতে আস্তানা গড়ে তোলেন। কিন্তু রাজা পরশুরাম সুফি মাহিসওয়ারের সঙ্গে বিবাদে এমনকি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং নিহত হন। মাহিসওয়ার তার অলৌকিক শক্তি আর আত্মবিশ্বাস ও অসীম সৎ সাহসের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে প্রবল ক্ষমতাধর অত্যাচারী রাজাদের পরাস্ত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। ইসলামের বিজয় নিশান ওড়াতে পেরেছিলেন। তার সততা, ন্যায় ও ধর্মপ্রবণতা বিজয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তার সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি এখনও স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে।
বাংলাদেশের সুফি-দরবেশদের মধ্যে চট্রগ্রামে সৈয়দ আহম্মদ উল্লাহ মাইজভান্ডারি,
অন্যতম
সিলেটের শাহজালাল ইয়ামেনি এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আগমন করেন। মরক্কোর তাঞ্জানিয়াবাসী বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ৭৪৫ হিজরি মোতাবেক ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা পরিভ্রমণে এসে শাহজালালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার মতে, শাহজালাল ইয়ামেনি ছিলেন তার সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ অলি। ইবনে বতুতার এই সাক্ষাতের পরের বছরই হজরত শাহ জালাল ইন্তেকাল করেন। এ দেশে ইসলাম বিস্তৃতির জন্য বাংলার মুসলমান এই স্বনামখ্যাত সুফি-দরবেশের কাছে প্রভূত পরিমাণে ঋণী। তিনি যে শুধু নিষ্ক্রিয় ও স্থাণুর মতো সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী ছিলেন তাই নয়, বরং তিনি একাধারে ধর্মপ্রচারক ও যোদ্ধা ছিলেন। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম আসাম একদিকে যেমন তার রণ-দুন্দুভি-নিনাদে মুখরিত হয়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনি অপরদিকে তার প্রচার তৎপরতায় মেতে উঠেছিল। এই বিশাল ভূভাগে তিনিই সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্যরূপে সনাতন ইসলামের বীজ বপন করেছিলেন;
তাই এখনও বাংলার মুসলমানরা শত শত পল্লীগাথায় তার স্মৃতি রক্ষা করে চলেছেন। সিলেটের তদানীন্তন হিন্দু রাজা গৌর গোবিন্দের অমানুষিক অত্যাচারে বুরহানুদ্দিন নামক এক মুসলমান অত্যাচারিত হয়ে গৌড়ের সুলতানের শরণাপন্ন হলে সুলতান ফিরোজ শাহ দেহলভি রাজা গৌর গোবিন্দের শাস্তিদান মানসে সিকান্দার গাজিকে বিরাট বাহিনীসহ সিলেটে প্রেরণ করেন। এই বাহিনীর সহযোগী শক্তি হিসেবে শাহজালালও যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং রাজা গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করেন। ফলে রাজা পলায়ন করেন এবং সিলেট সর্বপ্রথম মুসলমান কর্তৃক বিজিত হয়। শাহজালাল (রহ.) ধর্ম প্রচারে বাকি জীবন সেখানেই কাটিয়ে দেন। ইবনে বতুতা বলেন, এই পার্বত্যাঞ্চলের অধিবাসীরা শাহজালালের কাছ থেকে ইসলামের দীক্ষালাভ করেন এবং এ জন্য তিনিও তাদের মধ্যে বসবাস করেছিলেন।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ইসলামের প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে হজরত সৈয়দ শাহ মাখদুম রুপোস প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। রাজশাহী শহরের পাশে পদ্মা নদীর উত্তর তীরে দরগাপাড়া মহল্লায় তার পবিত্র মাজার অবস্থিত। তিনি সুলতান হোসেন শাহের রাজত্বকালে বাংলায় আগমন করেন এবং তৎকালীন মুসলিম সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কার, কুআচার ও অন্ধবিশ্বাসকে দূর করার অভিলাষে আত্মপ্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন।
বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে খুলনা ও যশোর এলাকায় পবিত্র ইসলামের প্রচার-প্রসারে অভূতপূর্ব অবদান রেখে যিনি ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন, তিনি হলেন হজরত খানে আযম খান জাহান আলি। বড়পীর আবদুল কাদের জিলানির বংশধর খান জাহান আলি (রহ.) সুদূর তুরস্ক থেকে প্রথমে দিলি্ল ও পরে গৌড়ে এসে
বসবাস করেন।
এ ছাড়াও আরও অনেক সুফি-সাধক বাংলায় আগমন করেন এবং পূর্বে সিলেট-চট্টগ্রাম থেকে পশ্চিমে বর্ধমানের মঙ্গলকোট এবং দক্ষিণে বাগেরহাট ও ছোট পাণ্ডুয়া থেকে উত্তরে দিনাজপুর জেলার কাঁটাদুয়ার পর্যন্ত সুবিশাল এলাকা ছিল তাদের কর্মক্ষেত্র।
লেখক ও গবেষক; শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়