ফেব্রিক আমদানিতে ন্যূনতম
ট্যারিফ মূল্যের সুযোগ নিয়ে দিনের পর দিন সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে কিছু
স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ী। এতে দেশে উৎপাদিত ফেব্রিক মূল্য তুলনামূলক বেশি হওয়ায়
প্রতিযোগিতার বাজারে পিছিয়ে পড়ছে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি করা ফেব্রিকের
মূল্য ট্যারিফ ভ্যালুর চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি।
ফলে
একদিকে যেমন দেশীয় টেক্সটাইল মিলগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে, অপরদিকে হুন্ডির
মাধ্যমে পাচার হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। তাছাড়া কর্মসংস্থানহীন হয়ে পড়ছে
লাখো মানুষ এবং সঠিক এলসি না হওয়ায় যথাযথ চার্জ ও কমিশন বঞ্চিত হচ্ছে ব্যাংক এবং
বিমা খাত। এক্ষেত্রে ট্যারিফ ভ্যালু পরিবর্তনে বারবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে
(এনবিআর) চিঠি দেওয়া হলেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটির। এমন
প্রেক্ষাপটে সবকিছুর জন্য এনবিআরের উদাসীনতা ও নির্লিপ্ততাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট
মহল। তাদের অভিমত, এনবিআরের উদাসীনতায় দেশীয় অর্থনীতি
প্রতিনিয়ত বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
জানা
গেছে, ২০১৯ সালের ৩০ মে প্রকাশিত ১৬৩-আইন/২০১৯ ৩২ কাস্টমস এসআরও-তে কটন ফেব্রিক,
পলিস্টার/সিনথেটিক ফেব্রিক, শার্টিং ফেব্রিক,
রেয়ন ফেব্রিক, সার্টেইন ফেব্রিকসহ বিভিন্ন
ধরনের ফেব্রিকের ট্যারিফ মূল্য ২.২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৫.৫০ ডলার ধার্য করা হয়েছে।
ট্যারিফ মূল্য হলো উৎপাদন ও প্রস্তুত পর্যায়ে পণ্যের ন্যূনতম খরচের নির্ধারণ। মূলত
শুল্ক ও কর ফাঁকি রোধে এবং ভোক্তা পর্যায়ে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যের নিশ্চয়তা দিতে
সরকার ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ করে। অর্থাৎ এই দামের নিচে কোনো পণ্য আনা যাবে না,
আনা গেলেও ন্যূনতম খরচ অনুসারে শুল্ক ও কর দিতে হবে।
কিন্তু
আন্তর্জাতিক বাজারে এসব ফেব্রিকের মূল্য প্রকারভেদে কেজিপ্রতি সর্বনিম্ন ৭.৩৮ ইউএস
ডলার থেকে ১৮.৯০ ডলার পর্যন্ত। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিক্রেতাদের যোগসাজশে
আন্ডার ইনভয়েস (কম মূল্য) বা ন্যূনতম মূল্য দেখিয়ে এসব ফেব্রিক আমদানি করে কিছু
অসাধু ব্যবসায়ী। এতে তাদের ন্যূনতম মূল্যের শুল্ক ও কর দিতে হয়। ফলে উপযুক্ত শুল্ক
ও কর থেকে বঞ্চিত হয় সরকার। তবে আন্ডার ইনভয়েস বা ন্যূনতম মূল্য দেখালেও যেহেতু আন্তর্জাতিক
বাজারে প্রচলিত দর হিসেবেই বিক্রেতাকে মূল্য পরিশোধ করতে হবে, তাই ন্যূনতম
মূল্যের পর যে অর্থ বাকি থাকে তা হুন্ডির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিক্রেতাকে পরিশোধ
করতে হয়। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের
ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের দিকে নজর দিলেই তা স্পষ্ট হয়। বিলাসী পণ্য
আমদানিতে সরকার নিষেধাজ্ঞা দিলেও ফরেক্স মার্কেটে ডলার ক্রয়-বিক্রয় বেড়েছে।
এই
কর্মকাণ্ডের ফলে একই মানসম্পন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে দেশীয় উৎপাদকদের তুলনায় কম মূল্যে
পণ্য আমদানি করছেন আমদানিকারকরা। পরবর্তী সময়ে সেই পণ্য নামমাত্র মুনাফায় বিক্রি
করে দিচ্ছেন স্থানীয় বাজারে। এতে আইন ভঙ্গ হলেও কম মূল্যে বিদেশি পণ্য পেয়ে মানুষও
তা কিনছে দেদার। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশীয় উৎপাদক কারখানা ও সংশ্লিষ্টরা। কারণ
দেশীয় উৎপাদকদের প্রতি কেজি সুতার মানভেদে ন্যূনতম উৎপাদন খরচ ২.৯০ ইউএস ডলার বা
তার চেয়েও বেশি। এর সঙ্গে পরিবহন, ব্যাংক সুদ, সাইজিং খরচ,
ইয়ার্ন ডায়িং খরচ, উইভিং, ডায়িং ও ফিনিশিং খরচ যোগ করলে ন্যূনতম ব্যয় দাঁড়ায় ৫.৪০ ডলার। ক্ষেত্র
বিশেষে তা ৮-১০ ইউএস ডলার পর্যন্ত হতে পারে। এ কারণে আমদানিকারদের সঙ্গে
প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেন না স্থানীয় উৎপাদকরা। এমনিতেই বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে
কারখানাগুলোতে উৎপাদন নেই বললেই চলে, এর মধ্যে যদি
আমদানিকারদের সঙ্গে এমন অসম প্রতিযোগিতায় নামতে হয় তবে কয়েক হাজার কারখানা বন্ধ
হওয়ার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে এসব কারখানার সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ মানুষ
কর্মহীন বা বেকার হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই ট্যারিফ মূল্য আন্তর্জাতিক
বাজার মূল্যের ওপর ভিত্তি করে পুনর্নির্ধারণ বা এই সুবিধা উঠিয়ে দেওয়ার জন্য ২০২০
সালের জানুয়ারিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সংগঠন
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)।
একই
বছরের মার্চ মাসে ট্যারিফ মূল্য পুনর্নির্ধারণের পাশাপাশি এসব ফেব্রিক ও ইয়ার্ন
কেজির পরিবর্তে মিটারে হিসাবায়ন করতেও বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের প্রতি আহ্বান
জানিয়েছিল সংগঠনটি। সে সময় সংগঠনটি জানায়, আমদানিকৃত পলিস্টার টুইস্টেড ইয়ার্ন দিয়ে জর্জেট ও
হিজাবের জন্য ফেব্রিক তৈরি হয়। একই পরিমাণ ১ কেজি কটন ইয়ার্নের চেয়ে পলিস্টার
টুইস্টেড ইয়ার্নের আয়তন ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি হয়। ফলে এই সুতা দিয়ে বেশি পরিমাণ কাপড়
উৎপাদন করা যায়, যা কটন ইয়ার্নের ক্ষেত্রে পরিমাণ খুবই কম।
বিটিএমএ জানায়, ফেব্রিকের ট্যারিফ ভ্যালু কেজির পরিবর্তে
মিটারে নির্ধারিত হলে আমদানিকৃত ফেব্রিক বন্ড সুবিধায় বা বাণিজ্যিক, যেভাবেই আমদানি করা হোক না কেন; অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা
গ্রহণের সুযোগ হ্রাস পাবে।
বিষয়গুলোতে
নিজেদের পর্যালোচনা ও মতামত দিয়ে এর সঙ্গে একাত্মতা জানায় ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ
কমিশনের বাণিজ্যনীতি বিভাগের সদস্য শাহ মো. আবু রায়হান আলবেরুনী। পরবর্তী সময়ে
বিষয়টি অবগত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর বাণিজ্য
মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে নির্দেশক্রমে চিঠি পাঠায় কমিশনের সহকারী প্রধান মাহমুদুল
হাসান। পরে এ নিয়ে ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি তৎকালীন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের
নেতৃত্বে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআরের চেয়ারম্যান, ট্রেড
অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ’র প্রেসিডেন্টদের
নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর ২৩ জানুয়ারি ২০২১ ট্যারিফ ভ্যালু পুনর্নির্ধারণে
এনবিআরের তৎকালীন দ্বিতীয় সচিব রকিবুল হাসানকে চিঠি লেখেন বিটিএমএ’র সদস্য সচিব মনসুর আহমেদ। এরপর পেরিয়ে গেছে চারটি বছর। পাস হয়েছে
৪টি জাতীয় বাজেট। এরই মধ্যে আরো অনেক ব্যবসায়ী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান থেকে এ বিষয়ে
এনবিআরকে চিঠি দিলেও অন্ধকার থেকে আলোর মুখ দেখেনি ট্যারিফ পুনর্নির্ধারণের এই
প্রস্তাবনা। ফলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উদাসীনতায় হুমকির মুখে
দেশীয় শিল্প-কারখানাগুলো,
কর্ম হারাবে লাখ মানুষ।
এ
বিষয়ে বিটিএমএ সচিব মনসুর আহমেদ বলেন, আমরা ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর এ নিয়ে এনবিআরকে
চিঠি দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বাজেটেই তার প্রতিফলন দেখিনি। ট্যারিফ
ভ্যালু পরিবর্তন বা ট্যারিফ নির্ধারণে ইউনিট হিসেবে কেজির পরিবর্তে মিটারে
হিসাবায়নের প্রস্তাব কেন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না, সে
সম্পর্কেও তারা কিছু বলেন না।
অপরদিকে
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস অটোমেশন বিভাগের প্রথম সচিব রাকিবুল হাসানের সঙ্গে
কথা বললে তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সাধারণত আমাদের যখন চিঠি দেওয়া হয় তখনই বিষয়টি
নিয়ে কাজ করা হয়। এটা দুই বছর আগের একটি চিঠি, তাই এটা নিয়ে
এখন আমাদের কোনো পদক্ষেপ নেই।
দেশীয়
অর্থনীতির ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কেন বাজেটে প্রতিফলিত হলো
না জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, তারা চিঠিটি এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে দিয়েছেন।
তাই তিনিই এ নিয়ে ভালো বলতে পারবেন।