জিতেন চন্দ্র দাস,কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: হাজারও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন পূরণের দিকে দৃষ্টিজয়ী অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান।
অন্ধত্ব তাঁকে হার মানাতে পারেনি। চোঁখে দেখতে না পারলেও এসএসসিতে ঢাকা বোর্ড থেকে নবম স্থান অর্জন করেছেন তিনি। বর্তমানে ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে মানবিক বিভাগে পড়াশোনা করছেন দৃষ্টিজয়ী মেহেদি হাসান। তাঁর স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগ নিয়ে পড়ালেখা শেষ করে হবেন ব্যারিষ্টার। কিন্তু তাঁর এই স্বপ্ন পূরণে আছে হাজারও প্রতিবন্ধকতা। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হলেও আত্মসম্মান বোধের কারণে নেন না প্রতিবন্ধী ভাতা।
দেশের দারিদ্রপীড়িত কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের কাজিপাড়ার বাসিন্দা ট্রাক চালক আক্কাছ আলী-মল্লিকা বেগম দম্পত্যির সন্তান মেহেদি হাসান। দরিদ্র এই পরিবারে ৬ ভাই-বোনের মধ্যে সব ছোট মেহেদি হাসান। এরমধ্যে ৩বোনের বিয়ে হয়ে গেছে এবং আছমা আকতার নামে এক বোন জন্ম থেকে বহু মাত্রিক প্রতিবন্ধী। বয়সের ভারে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা হওয়ায় আর ট্রাক চালাতে পারেন না।
সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বেকার হয়ে পড়ায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে পরিবারের বাকি ৩ সদস্যের। আর অর্থাভাবে লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম মেধাবী মেহেদি হাসানের। আবাদ উপযোগি কোনো জমি জমা না থাকলেও রয়েছে শুধু ৬শতক বসতভিটে। মেহেদি জন্মান্ধ না। তার ৭-৮বছর বয়সে ডান চোঁখে সমস্যা দেখা দেয়। পরে উলিপুর উপজেলার মরিয়ম চক্ষু হাসপাতালে দেখানো হয়। সেখানে চিকিৎসকরা সিরাজগঞ্জ চক্ষু হাসপাতালে রেফার্ড করে। এরপর চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকরা অপারেশন করেন। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে মেহেদির বাম চোঁখে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে। দু’চোঁখে আস্তে আস্তে ইনফেকশন হয়ে ২০১২সালে অন্ধত্ব বরণ করতে হয় মেহেদিকে। ঢাকা চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসকরা মেহেদির পরিবারকে ভারতের চেন্নাইতে নিয়ে যেতে বলেন। সেখানে প্রায় ২৫লাখ টাকা খরচ করে উন্নত চিকিৎসা করা গেলে মেহেদি আবারও দেখতে পাবে বলে আশার বাণী শুনিয়েছেন চিকিৎসক।
মেহেদি হাসান বলেন, তিনি ২০২১ সালে ঢাকার খিলখেত এলাকার জানে আলম সরকার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করেছেন। এসএসসিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিসহ ঢাকা বোর্ডে ৯ম স্থান লাভ করেন তিনি। বর্তমানে ঢাকা কলেজে পড়াশোনা করছেন। থাকেন আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের ৩২১নং কক্ষে। চলতি বছর কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিবেন তিনি। ভালো ফলাফল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন তার।
এর আগে মিরপুর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৪.৫৮ এবং জেএসসিতে গোল্ডেন এপ্লাস পেয়েছিলেন মেহেদি হাসান। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও ঢাকায় চলা ফেরা করেন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতোই। অর্থাভাবে আর পুরাতন অডিও বইয়ের কারণে সামনে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার বিষয়ে দুশ্চিন্তায় কাটছে দিন মেহেদির। পরীক্ষার সময় সূচি ঘোষণা হলেও হাতে আসেনি মেহেদির মতো আরও ৫জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই। শ্রেণি কক্ষেও পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। শিক্ষকরা পাঠদানের সময় ব্লাক বোর্ডে লিখে দিলেও সেগুলো আর তোলা হয় না শ্রুতি লেখকের অভাবে। এদিকে নেই কোনো প্রাইভেট শিক্ষক। ফলে আগামী এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় কাটছে তাদের দিন।
সরকারি এবং দাতা সংস্থার মাধ্যমে যে বই গুলো
ভিউ ফাউন্ডেশন এবং ইফশা সংগঠনের মাধ্যমে দেওয়া হয় সেগুলোও পুরাতন। যদিও
নতুন বই দেওয়ার নিয়ম কিন্তু সংগঠন দু’টি সেগুলো মানছে না। প্রায় ৪মাস আগে
প্রতিবন্ধী ভাতা হলেও নিজের আত্মসম্মান বোধ থেকে সেই ভাতা নেন না মেহেদি।
তবে তিনি শিক্ষা ভাতার জন্য আবেদন করেছেন আজিমপুর সমাজসেবা অফিসে। এছাড়াও
পরীক্ষার সময় শ্রুতি লেখকের সম্মানিভাতা নিজেদের পকেট থেকে হয়।
মেহেদির বাবা আক্কাছ আলী বলেন, বসতভিটা ছাড়া কিছু নেই তাঁর। ছেলে পড়াশোনা করছে ঢাকাতে। দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি বাজারে মেয়ের প্রতিবন্ধী ভাতা দিয়ে কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলেছেন মেহেদিকে ভালো করা যাবে চেন্নাইতে নিয়ে গেলে। এজন্য প্রায় ২২-২৫লাখ টাকা খরচ হবে। যেখানে নুন আনতে পানতা ফুরায় সেখানে কিভাবে ছেলের চিকিৎসার স্বপ্ন দেখি।
মেহেদির মা মল্লিকা বেগম কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, সংসারে দুটি প্রতিবন্ধী সন্তান আছে। এরমধ্যে মেহেদি ভালোই ছিল ৭-৮ বছর বয়স পর্যন্ত। কিন্তু একটি চোঁখে সমস্যা হওয়ার পর ভুল চিকিৎসায় ছেলেটার দুই চোঁখে আজ অন্ধ। চিকিৎসক বলছেন, মেহেদিকে ভালো করা যাবে টাকা-পয়সা খরচ করলে। সরকার বা সমাজের বিত্তবানরা যদি একটু এগিয়ে আসে তাহলে আল্লাহ চাইলে মেহেদি আবারও দেখতে পাবে।
এই বিষয়ে ঢাকা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারি অধ্যাপক নাসরিন আক্তার বলেন, মেহেদি হাসান জন্মান্ধ নয়। সে চিকিৎসা জনিত কারণে অল্প বয়সে অন্ধত্ব বরণ করতে হয়েছে। সে মেধাবী শিক্ষার্থী হলেও শ্রুতি লেখক এবং বই সংকটের কারণে পড়াশোনা বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়াও মেহেদির পরিবারে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে ঠিক মতো মেহেদি প্রাইভেট পড়া ও শ্রুতি লেখকের টাকা দিতে পারে না। ফলে আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে মেহেদি হাসান।