অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ছয় মাসে বারবার যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে সেটা হলো- কবে হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। শুরু থেকেই বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে চাপ দিয়ে আসছে। সরকারের কাছে নির্বাচনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপও দাবি করেছে। সরকার স্পষ্ট করে তারিখ ঘোষণা না করলেও দুটি সময়সীমার কথা জানিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, চলমান সংস্কার কাজের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাপক পরিসরে সংস্কার চাইলে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। আর সংক্ষিপ্ত সংস্কার চাইলে ২০২৫ সালের মধ্যে ত্রয়োদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তবে বিএনপির পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার চাপ অব্যাহত রয়েছে। এমনকি দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ন্যূনতম সংস্কার শেষে চলতি বছরের জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নির্বাচনের আয়োজন করা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোর এই চাপের মধ্যে অবশেষে সরকারের পক্ষ থেকে চলতি বছরের মধ্যেই নির্বাচন করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
সম্প্রতি একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইঙ্গিত দেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে পারে। সেই ইঙ্গিত আরও জোরালো হলো সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বিএনপির প্রতিনিধি দলের সাক্ষাতের পর। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, সরকার ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা তাদের আশ্বস্ত করেছেন।
ফখরুল সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা এবং তার সঙ্গে যারা আছেন তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, অতি দ্রুত তারা নির্বাচনের ব্যবস্থা করছেন। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেনও- ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করছেন।
ফখরুল বলেন, আমরা আশা করব, জনগণের যে প্রত্যাশা আছে, একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন তিনি। সেটার মধ্য দিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।
এদিকে একই দিন রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, সব রাজনৈতিক দল একমত হলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দিতে সরকারের আপত্তি নেই।
শফিকুল আলম বলেন, জাতীয় নির্বাচন দ্রুত চায় বিএনপি। নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছে বিএনপি। সরকারের পরিকল্পনা, চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা ২০২৬ নাগাদ নির্বাচন হওয়ার কথা বলা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেসময় নির্বাচন চায় তখনই নির্বাচন হবে।
নির্বাচন কমিশনও ডিসেম্বরে নির্বাচনের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সোমবার মানিকগঞ্জে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকারও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্ততি নেওয়ার কথা বলেছেন।
নির্বাচন কমিশনার বলেন, কমিশনের কাছে ভালো নির্বাচন না করার কোনো বিকল্প নেই। দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক নেতারাসহ বিভিন্ন মহলের সহায়তা দরকার। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে যাতে জাতীয় নির্বাচন হয়, সে লক্ষে প্রস্ততি নিচ্ছে কমিশন। আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সবার চাহিদা অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচন করতেই হবে, পেছনে ফেরার সুযোগ নেই।
তবে ডিসেম্বর মাসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের অংশ এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইনের সংশোধনের কারণে আটকে আছে যাবতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি। কেননা এই দুটি আইনে কী কী সংশোধন আনা হবে—সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা ছাড়া কমিশনকে কোনো ধরনের নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি।
এছাড়া এবারের ভোটার তালিকা হালনাগাদে প্রায় ১৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৬ জন নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন যারা ২০২৬ সালের ২ জানুয়ারি ভোটারযোগ্য হবেন। চলতি বছরের ডিসেম্বরে ভোট হলে তারা ভোট দিতে পারবেন না। এটাকে একটি জটিলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে নির্বাচন আগামী বছরের জানুয়ারিতেও হতে পারে।
এ ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসিরউদ্দিন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সংস্কার কার্যক্রমের কারণে প্রস্তুতিতে আমরা আটকে আছি। এখনো পর্যন্ত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ কার্যক্রম শুরু করতে পারিনি। দুটি আইন সংশোধন হবে নাকি বিদ্যমান আইনে কার্যক্রম শুরু করব সে বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। এ বিষয়ে সময়ক্ষেপণ হলে প্রস্তুতিতে আমরা পিছিয়ে যাব। সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন হবে।
এদিকে বিএনপি নির্বাচনের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করলেও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলগুলো ততটা তাড়াহুড়োর পক্ষে না। তারা বলছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন হোক। এক্ষেত্রে কিছুটা দেরি হলেও মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে দলগুলো। যদিও বড় দল হিসেবে বিএনপির চাওয়াই বেশি গুরুত্ব পাবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।