
রোকসানা
মনোয়ার : নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বাদশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর
ডাকা হরতাল এবং কয়েক দফার অবরোধে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে অচলাবস্থা তৈরি
হয়েছে। শিল্পের জন্য আমদানিকৃত কাঁচামাল সময়মতো কারখানায় পৌঁছাতে না পারায় তৈরি
পোশাকসহ সামগ্রিকভাবে ব্যাহত হচ্ছে দেশের শিল্পখাত। এতে ক্রেতার বেধে দেয়া সময়ে
পণ্য রপ্তানি নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছেন রপ্তানিকারকরা। সৃষ্টি হয়েছে শিপমেন্ট
বিলম্বসহ নানান জটিলতা। শুধু তাই নয়, অবরোধের প্রভাবে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের সকল
রুটে পণ্য পরিবহন ভাড়া বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এতে চরম বেকায়দায় পড়েছেন
ব্যবসায়ীরা। ফলে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কমে যাচ্ছে তৈরি পোশাকের অর্ডার।
বিকেএমইএর এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন: টি-শার্টের
একটি চালান ১৫ নভেম্বর সমুদ্র পথে জার্মানিতে শিপমেন্ট হওয়ার কথা ছিল। চলমান
অবরোধের কারণে সময়মতো কারখানায় ফ্রেব্রিক পৌঁছানো যায়নি। একইসাথে ছিল গ্যাসের
সংকটও। সময়মতো ফ্রেব্রিক না পাওয়ায় এখনও সব পণ্য প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি। ক্রেতার
বেধে দেয়া টাইমলাইন অনুযায়ী এখন বাধ্য হয়ে এয়ার শিপমেন্ট করা ছাড়া উপায় নেই, বলেন
তিনি। মোহাম্মদ হাতেম আরও জানান, অবরোধের আগে নারায়ণগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামে আমরা ১২
হাজার টাকায় গাড়ি পাঠাতে পারতাম। এখন সেই ভাড়া দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে ২৫ হাজার টাকায়
পৌঁছেছে। সকাল ১০টায় এবং রাত ১০টায় শিডিউল করে কারখানা থেকে রপ্তানি পণ্যগুলো
চট্টগ্রামে পাঠাতে হচ্ছে। একইভাবে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি পণ্যও শিডিউল করে
কারখানায় আনতে হচ্ছে।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পোর্ট অ্যাফেয়ার্স
সেক্রেটারি মো. লিয়াকত আলী হাওলাদার বলেন: অবরোধ কর্মসূচির কারণে পরিবহন সংকট
রয়েছে। এ কারণে এখন আমদানিকারকদের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকায় পণ্য পরিবহনে ১৫
হাজার টাকার জায়গায় প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ট্রাক শ্রমিক
ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মাঈন উদ্দিন বলেন, পণ্য পরিবহনের সময়
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ২টি এবং কুমিল্লায় ২টি প্রাইম মুভার আগুনে পুড়িয়ে দেয়
দুর্বৃত্তরা। এছাড়া, প্রতিদিনই গাড়ি পোড়ানো হচ্ছে। সড়কে গাড়ি চালানো নিয়ে চালকরা
আতঙ্কিত। এমন পরিস্থিতিতে ভাড়া আগের তুলানায় বেড়েছে।
তৈরি পোশাকের অর্ডার কমেছে চট্টগ্রাম বন্দরে: হরতাল অবরোধসহ চলমান রাজনৈতিক
অস্থিরতায় চট্টগ্রামের পোশাক কারখানায় কমতে শুরু করেছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের
বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের অর্ডার। নভেম্বরের প্রথম ১০ দিনে অক্টোবরের প্রথম ১০
দিনের তুলনায় তৈরি পোশাক শিল্পের অর্ডার কমে গেছে ২০ শতাংশের বেশি। নভেম্বরের
শেষ নাগাদ অর্ডার কমার হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গার্মেন্টস
মালিকরা। চট্টগ্রামে বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত ৩৫০টি কারখানাসহ বিকেএমইএ সদস্যভুক্ত এবং
ইপিজেডকেন্দ্রিক প্রায় ৪৫০টি পোশাক কারখানা তৈরি পোশাক রপ্তানির সাথে যুক্ত।
স্বাভাবিক সময়ে প্রতিমাসে গড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার
পায় এসব প্রতিষ্ঠান। তবে এখন এই পরিমাণ অর্ডার পাচ্ছে না গার্মেন্টস মালিকরা।
অক্টোবরে চট্টগ্রামের গার্মেন্টস মালিকরা অর্ডার পেয়েছিলেন ১১৩ মিলিয়ন ডলার।
গার্মেন্টস
মালিকরা জানিয়েছেন : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্ডার কমে গেছে।
এরমধ্যে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্রেতারা অর্ডার আরও কমিয়ে দিচ্ছেন। বিজিএমইএর
ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, চলতি বছরের অক্টোবরের প্রথম ১০ দিনে
বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত চট্টগ্রামের প্রায় ৩৫০টি গার্মেন্টসে তৈরি পোশাকের অর্ডার ছিল
প্রায় ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। নভেম্বরের প্রথম ১০ দিনে এই অর্ডার নেমে এসেছে ৩৫
মিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ, নভেম্বরের প্রথম ১০ দিনে চট্টগ্রামে বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত
গার্মেন্টসগুলোতে অর্ডার কমেছে ২০. ৪৫ শতাংশ।
চট্টগ্রাম
বন্দরে কন্টেইনার ডেলিভারি কমেছে ৫০ শতাংশ: স্বাভাবিক
পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সাধারণত প্রতিদিন প্রায় ৪,০০০ থেকে ৪,৫০০
কন্টেইনার সরবরাহ করা হয়। প্রায় ৬,০০০ থেকে ৭,০০০ ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান এবং প্রাইম
মুভার কন্টেইনারগুলো পরিবহন করে। কিন্তু দফায় দফায় অবরোধ কর্মসূচির প্রভাবে
বর্তমানে কন্টেইনার ডেলিভারি নেমে এসেছে ২,০০০ এ। একইসাথে বন্দরে পণ্যবাহী গাড়ি
আসার সংখ্যাও কমে গেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। আমদানিকারক এবং সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন,
চলমান অবরোধের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি নিতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন
তারা।
বিএনপির অবরোধকালীন সময়ে বন্দরের কন্টেইনার ডেলিভারির তথ্য
পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ ডেলিভারি কমে গেছে।
গত ২৭ অক্টোবর কন্টেইনার ডেলিভারি হয়েছিল ৪১৩২ টিইইউ। এর পর ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত গত
১৯ দিনের মধ্যে ১০ দিন কন্টেইনার ডেলিভারি হয়েছে ২,০০০ থেকে ৩,০০০ টিইইউসের মধ্যে।
৯ দিন কন্টেইনার ডেলিভারি হয় ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ টিইউএসম পর্যন্ত। অবরোধের কারণে
বন্দর থেকে কন্টেইনার ডেলিভারির শিডিউলও বদলে যাচ্ছে। শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন
করার পরও অবরোধের সময় ডেলিভারি না নিয়ে অবরোধ নেই এমন দিনে কন্টেইনার ডেলিভারির
দিকে ঝুঁকছেন ব্যবসায়ীরা। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি কন্টেইনার ডেলিভারি দিতে গিয়ে
বাড়তি চাপে পড়ছেন বন্দর সংশ্লিষ্ট কর্মীরাও। এমন পরিস্থিতিতে আমদানিকারকরা পণ্য
ডেলিভারিতে সরকারি ছুটি কিংবা অবরোধ নেই এমন দিনকেই বেছে নিচ্ছেন।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, কোনো বাড়তি চার্জ ছাড়াই বন্দর থেকে কন্টেইনার
নেয়ার জন্য ৪ দিনের গ্রেস পিরিয়ড পান আমদানিকারকরা। এই প্রাথমিক গ্রেস পিরিয়ডের
পরে, আমদানিকারকদের প্রথম সপ্তাহে ২০-ফুট কন্টেইনারের জন্য প্রতিদিন ৬ ডলার করে
জরিমানা দিতে হয়। দৈনিক এই জরিমানা দ্বিতীয় সপ্তাহে দ্বিগুণ হয়ে ১২ ডলার এবং ২১তম
দিন থেকে বেড়ে ২৪ ডলার হয়। ৪০-ফুট কন্টেইনারের জন্যও একই প্যাটার্নে চার্জের
পরিমাণ হয় দ্বিগুণ। চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে কন্টেইনার ধারণ সক্ষমতা ৫৩,৫১৮
টিইইউ। ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত বন্দরের ইয়ার্ডে কন্টেইনার রয়েছে ২৭,৬৬৫ টিইইউ।