আমিনুল ইসলাম কাসেমী, শিক্ষক ও গবেষক :
ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী রহ, এর পরিকল্পনা ছিল মাদ্রাসার পাশাপাশি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। খৃষ্টান মিশনারীর মোকাবেলায় তিনি ইসলামিক স্কুল, সেবামুলক প্রতিষ্ঠান, কারিগরী শিক্ষা, ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি, এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলে ছিলেন।
ঢাকাতে যতবারই আমি হযরতকে দেখেছি, তিনি মাদ্রাসার পাশাপাশি স্কুলের প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। সকলকে উদ্বুদ্ধ করতেন স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে। মালিবাগ জামেয়া শারইয়্যাহ এর প্রোগ্রামে ফেদায়ে মিল্লাত তাঁর বক্তৃতায় বহুবার বলেছেন স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা। মানুষকে দ্বীন মুখি করার জন্য তিনি নতুন কৌশল হিসেবে স্কুল প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবী। যুগের চাহিদা।
মাদ্রাসাতে কিন্তু সব শ্রেণীর মানুষ ভর্তি হয়না। সব পরিবারের ছেলে-মেয়ে মাদ্রাসাতে পড়েনা। কিন্তু বর্তমানে স্কুল কলেজের যে অবস্হা, তাতে বৃহৎ এক জনগোষ্ঠী দ্বীন থেকে মাহরুম হচ্ছে। এবং তারা ধাবিত হচ্ছে গোমরাহীর দিকে। দিনে দিনে তারা ঈমানহারা হচ্ছে। ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছে। অথচ তারা কিন্তু মুসলমান। তাদের ধর্ম ইসলাম।
ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী রহ, একজন চিন্তাশীল এবং উঁচুমানের বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। হুবহু পিতা কুতুবুল আলম সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ, এর নঁকশে কদমে পা রেখে চলে ছিলেন। পিতার মত ব্যাপক চিন্তা- চেতনা সারা জীবন লালন করতেন তিনি। তাই তো হযরত আসআদ মাদানী রহ, তাঁর জীবদ্দশায় বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিলেন। নানা খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন। যেখানে যেতেন, সেখানে তিনি মানুষকে দ্বীনি খেদমতে আত্মনিয়োগ করার পরামর্শ দিতেন সব সময়।
মাদানী পরিবারটা ছিল ইতিহাসের দেদীপ্যমান এক মশাল। যারা শত শত বছর ধরে দ্যুতি ছড়িয়েছেন। বিশ্ববাসীকে বহু উপহার তাঁরা দিয়েছে। বিশেষ করে মজলুম জাতির মুক্তি কামনায় তাঁদের সংগ্রাম অপরিসীম। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে। একশত নব্বই বছর ধরে গেঁড়ে বসা ব্রিটিশকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিল এই মাদানী পরিবারের মহান ব্যক্তি। সে জন্য অতুলনীয় চিন্তা - চেতনা তাঁদের। তাঁদের চিন্তা- ভাবনার সাথে হয়ত অনেকে বুঝতে সক্ষম হয়নি। কেউ কেউ ভুলও বুঝেছেন। কিন্তু শেষমেষ মাদানী ফর্মুলা শ্রেয় সেটা প্রমাণ হয়েছে।
সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী রহ, এর চিন্তা- চেতনা, তাঁর ফর্মুলা শ্রদ্ধেয় পিতার বাতলানো নীতি অনুযায়ী। তিনি যেসব কর্মকান্ড পরিচালনা করেছিলেন, সবই ছিল সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানীর দেখানো পথ।
তিনি যে স্কুল প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেছিলেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন জায়গাতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেন। এগুলো অত্যান্ত সময়পোযোগী সিদ্ধান্ত ছিল। মানব কল্যাণে তাঁর যথার্থ উদ্যোগ। কেননা, জেনারেল লাইনের মানুষগুলোকে দ্বীন মুখি করার যথাযথ প্রয়াস। আর সেই ভাবনায় বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেটা এখন বিশ্বব্যাপি সমাদৃত। আলেম- উলামাসহ লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয় কেড়ে নিয়েছে।
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করা সকলের জন্য অপরিহার্য। কয়টা পরিবারের ছেলে দ্বীন শিখতে যায়। কজন মাদ্রাসার গন্ডির ভিতর থাকার ইচ্ছে করে। সবই তো চলে যায় স্কুল- কলেজ- ভার্সিটিতে। সেখানে তারা যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ায়। অনেকে তো মাদ্রাসার কথা কানেই নিতে পারেন না। কিন্তু তারা তো মুসলমান। তাদের কে কি দ্বীনের পথে আনতে হবে না?
আমাদের ছেলেরা আজ ডিসি হয়, এসপি হয়, মন্ত্রী - এমপি হয়। কিন্তু তারা দ্বীন থেকে বহু দুরে। কোরআন হাদীসের কোন জ্ঞান তাদের নেই। ইসলামী আদর্শ, ইসলামী তাহযীব তামাদ্দুনের সাথে কোন সম্পর্ক তাদের নেই। ইসলামী রীতি- নীতি সম্পর্কে তারা ওয়াকিফহাল নয়। এমনকি ইসলামের প্রাথমিক বিষয়গুলো তাদের অজানা।
আজ আমাদের সন্তানেরা বড় অফিসার হয় কিন্তু কোরআন পড়া জানেনা। বড় ডাক্তার - ইন্জিনিয়র,কিন্তু ইসলামী জ্ঞানে সে মুর্খ। কোরআন সহী করে পড়ার যোগ্যতা থাকেনা। কোন মাসয়ালা জানেনা। অথচ দুনিয়াবী ভুরি ভুরি ডিগ্রি তার আছে।
তাই ফেদায়ে মিল্লাতের মোবারক ভাবনা ছিল। এটা তাঁর গুরুত্বপুর্ণ নসীহত। ইংরেজী শিক্ষিত মানুষগুলো যেন ইসলামের ব্যাপারে মুর্খ না হয়। তারা যেন ইসলামী জ্ঞান আহরণ করতে পারে। তার জন্য স্কুল গড়ে তুলুন।
আজকের ইকরা বাংলাদেশ স্কুল, যেটা ফেদায়ে মিল্লাতের পরিকল্পনার ফসল। বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক জেলাতে এখন ইকরার শাখা। সবই আওলাদে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রুহানী তাওয়াজ্জুহ দ্বারা দেশব্যাপি গড়ে উঠেছে। আরো দেশের বিভিন্ন জায়গাতে ওলামা - মাশায়েখদের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠছে।
দারুল উলুম দেওবন্দের বর্তমান সদরুল মুদাররিসীন, কুতুবুল আলম সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানীর মেঝো সাহেবজাদা, ফেদায়ে মিল্লাতের ভ্রাতা, সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানী দামাতবারাকাতুহুম, তিনিও এখন আলেমদের স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উৎসাহিত করছেন। যেটা খুবই প্রসংসনীয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আলেম সমাজের আরো জোরদার ভুমিকা রাখা দরকার। স্কুল প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যেরকম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কাজে এগিয়ে যাচ্ছি, স্কুল এর জন্য ঐ রকম ভুমিকা রাখা জরুরী।
বড় দুঃখ লাগে, আমাদের দেশের সাধারণ শিক্ষিত ভায়েরা যেভাবে দ্বীনের জ্ঞান থেকে মাহরুম হয়ে আছে, এটা যদি আমরা না করি, তাহলে আরো অধঃপতনে চলে যাবে তারা। ভবিষ্যতে মুসলমান হিসেবে খুঁজে পাওয়া যাবেনা তাদের।
এজন্য দেশের আলেম সমাজ স্কুল প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসুন। মানুষকে গোমরাহী থেকে বাঁচান। স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যম মানুষকে দ্বীনি জ্ঞান দান করুন।