উখিয়া প্রতিনিধি :
জাল দলিল বানিয়ে অন্যের জমি দখল করার অভিযোগে অভিযুক্ত কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বহুল বিতর্কিত ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জাল দলিল সৃজন করে জমি জোর পূর্বক দখলে রাখার অভিযোগে রফিকুল আলম মাহমুদ এর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা শাখা ২ এই নির্দেশনা দেন । অভিযোগকারী রফিক উখিয়ার রুমখা পালংয়ের হাজী মরহুম রশিদ আহমেদের ছেলে।
ভুক্তভোগীর আবেদনের প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে জন্য কক্সবাজারের জেলা প্রশাষককে নির্দেশ দিয়ে গত ৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ নোটিশ ইস্যু করে যার স্মারক নং ৪৪.০০.০০০০.০৫৬.২৭.০১০.২৩.১৩২৩। উপসচিব আশাফুর রহমান স্বাক্ষরিত ঐ নোটিশে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে এই নির্দেশ দেয়া হয়।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ১৭ আগস্ট ১৭১২ নং দলিলমূলে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার চট্টশ্বরী রোড়স্থ মৃত সুরেন্দ্র বিজয় রায়ের পুত্র প্রণব কুমার রায় নামের এক ব্যাক্তির ভূয়া জাতীয় পরিচয় পত্র ব্যবহার করে ২ একর ১০ শতক জমি ক্রয় করে। এই জমি ক্রয় করার সময় প্রনব কুমার রায়ের জাতীয় পরিচয় পত্র নাস্বার দেখানো হয় ১৫১১৮৯৫৫৫০৭২৮। উখিয়া সাব রেজিস্ট্রা অফিস কোন ধরনের যাচাই বাছাই নাকরে ঐ ভূয়া এনআইডি দিয়ে সাব কবলায় জমি রেজিস্ট্রেরি করতে সহযোগিতা করে।
জাল দলিল সৃজন অভিযুক্ত ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার রুমখাঁ মাতবর পাড়ার নুরুল আলমের ছেলে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। জমির মালিক ঐ ভূয়া
সৃজিত দলিলে জমি বিক্রেতা প্রণব কুমার রায়ের ব্যবহৃত জাতীয় পরিচয় পত্র নং ১৫১১৮৯৫৫৫০৭২৮ যাছাইবাছাইয়ের আবেদন করলে চট্টগ্রামের জামালখান রোড়স্থ জেলা নির্বাচন অফিসার-১ এর কার্যালয় ২৪ অক্টোবর ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে নথি নং জেনিঅ-১/চট্ট/১৪৭(১)/০৭/ভোঃতাঃপ্রঃ(খন্ড-২)/৪৮৭ মুলে জানা যায়, ব্যবহৃত জাতীয় পরিচয় পত্রের নং ১৫১১৮৯৫৫৫০৭২৮ চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার চট্টশ্বরী রোড়স্থ মৃত সুরেন্দ্র বিজয় রায়ের পুত্র প্রণব কুমার রায়ের নয়।
ওই জাতীয় পরিচয় পত্র নাম্বারটি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার সাতবাড়িয়ার মোহাম্মদ আলী গ্রামের বাসিন্দার আহমদ নবীর স্ত্রী সাকী আকতারের।
অভিযোক্ত জাহাঙ্গীর কক্সবাজারের উখিয়ার রুমখাপালং মাতব্বর পাড়া পেশায় ছিলেন রংমিস্ত্রি। উন্নত জীবনের আশায় তিনি সৌদি আরবে গিয়ে রং মিস্ত্রির কাজ করতেন। তার আগে সে উখিয়ার কোর্টবাজার স্টেশনে সৈকত সড়কে মোবাইল লোডের ব্যবসাও করতেন। সেই সময় থেকে বিভিন্ন প্রতারনা অভিযোগ আছে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। জানাগেছে সৌদি আরবেও প্রতারনা করে ধরাপড়ে টাকা পয়সা হারিয়ে ২০১৮ সালে দেশে ফিরে আসেন।
২০১৯ সালে ২৫ মার্চ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন তিন। ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের সময়ও নির্বাচন কমিশনের সাথেও প্রতারনা করেন জাহাঙ্গীর আলমের। নির্বাচনের হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করেন। হলফনামায় তার মাত্র ১২ লাখ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ দেখানো হলেও সেই সময় তার একাধিক জমি ছিলো। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সম্পদের তথ্য বিবরনীতেও তথ্য গোপন করে সম্পদের হিসাব দেন। এখন এই অভিযোগ উঠেছে জাহাঙ্গীর সাড়ে ৪ বছর আগে মাত্র ১২ লাখ টাকা সম্পদ দেখালেও বর্তমানে সে ২৬৫ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। মাদক ব্যবসা, মানবপাচার ও স্বর্ন চোরাচালান করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া, রামু ও বান্দরবানের নাইক্ষংছড়িতর গড়েছেন অবৈধ টাকার সম্পদের পাহাড়। নামে-বেনামে এসব সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জাহাঙ্গীর আলমের এত অর্থ-সম্পদের অনুসন্ধান চেয়ে প্রধানমন্ত্রী, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), নির্বাচন কমিশনসহ ১৮টি স্থানে অভিযোগ করেছেন জসীম উদ্দিন আজাদ নামে এক ব্যক্তি। স্থানীয় সূত্র জানায়, জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই সরওয়ার আলম একসময় লাইফ ইন্স্যুরেন্সে চাকরি করতেন। জাহাঙ্গীর ভাইস চেয়ারম্যান হওয়ার পর সরওয়ারকে লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চাকরি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। জাহাঙ্গীর তার চাচাতো ভাই সরওয়ার ব্যাক্তিগত সহযোগী উখিয়ার রুমখাঁ কোলালপাড়ার সোনা আলীর ছেলে সেলিম উল্লাহ ও উখিয়ার মরিচ্যা বাজারের শীর্ষ ইয়াবা পাচারকারী জসিম আহম্মদকে দিয়ে জ্ঞাতঅজ্ঞাত ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন।
সুত্রে জানাযায়, উখিয়া উপজেলা পরিষদের পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের বাবার নাম মো. নুরুল আলম। উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের রুমখাপালং মাতব্বর পাড়ার ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম। ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী থাকলেও ২০০৩ সাল পর্যন্ত ৩ বার পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন তিনি। ২০০৪ সালে যান সৌদি আরবে। সেখানে রংমিস্ত্রির কাজ করতেন। ২০১৬ সালে তার প্রভাবশালী আত্মীয় সৌদি আরবে গেলে সেখানকার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমকে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর থেকেই তিনি সেখানে থেকে দেশে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। পরে দেশে ফিরে ২০১৯ সালে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপরই শত শত কোটি টাকার সম্পদ ও অর্থ বানান বলে অভিযোগ উঠেছে।
বর্তমানে ভাইস চেয়ারম্যান এর দুটি বিশাল বাড়ি, কক্সবাজারে হোটেল, চট্টগ্রামে আবাসিক এলাকায় দামি ফ্ল্যাট, প্রাইভেটকার, বাস, ট্রাক সবই আছে তার। এই ভাইস চেয়ারম্যানের বর্তমান অর্জিত সম্পদ হলো উখিয়া উপজেলা রুমখাঁ বাজার এলাকায় ২৯৪০ খতিয়ানে নিজের ও কলেজপড়ুয়া ভাই মামুনের নামে কোটি টাকা মূল্যের ১৭ শতকের একটি জমি ক্রয় করে, সে স্থানে ৩ কোটি টাকা খরচ করে একটি বহুতল ভবন বানিয়েছেন। ওই ভবনে গত তিন বছর ধরে জাহাঙ্গীর নিজে বসবাস করে আসছেন।
উখিয়া উপজেলার ব্যয়বহুল কোটবাজার এলাকায় রত্নাপালং মৌজায় ৩৭৬৮ খতিয়ানে ৬৫ শতক জমি ক্রয় করেন যার বর্তমান বাজারমূল্য ৫ কোটি টাকার ওপরে (খতিয়ান সংযুক্ত)।
ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কোটবাজার স্টেশনে একই মৌজায় ৫৩২৩ খতিয়ানে ১৬ শতক জমি ক্রয় করে একটি বহুতল অত্যাধুনিক ভবন তৈরি করেছেন জমিসহ যার বাজারমূল্য ১০ কোটি টাকা।
২০১৯ সালে কক্সবাজার শহরের কলাতলির সৈকতের লাগোয়া ঝিলংজা মৌজায় যৌথভাবে তিনি একটি জমির মালিক যার বর্তমান বাজারমূল্য ৮ কোটি টাকা।
অভিযোগে বলা হয়েছে, উখিয়া উপজেলার ইনানী মৌজায় মেরিন ড্রাইভ রোডের হ্যাচারি জোন, ইনানী ও মনখালী এলাকায় ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর, তার আত্মীয় স্বজনের নামে প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের জমি রয়েছে। এ ছাড়াও চট্টগ্রামের চান্দগাঁও এলাকায় নিজ নামে, পিতার নামে ও ভাইয়ের নামে ৪০ কোটি টাকা মূল্যের চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
গত কয়েক বছরে ভাইস চেয়ারম্যান তার স্বজনদের নামে কক্সবাজারের কলাতলিতে ২টি হোটেল যার আনুমানিক মূল্য ৬০ কোটি টাকা। পাশাপাশি কক্সবাজার থেকে উখিয়া রোডে পালং স্পেশাল সার্ভিসের সভাপতিও তিনি। তার ১০টি বাস যার বাজারমূল্য ২ কোটি টাকা। এ ছাড়াও তার চারটি ট্রাক আছে যার বাজার মূল্য ৫০ লাখ টাকা।
অভিযোগকারী অভিযোগ করেন, উখিয়ার রত্নাপালং, রুমখাপালং ও জালিয়াপালং মৌজা, রামুর উপজেলার খুনিয়াপালং, হিমছড়ি, পেঁচারদ্বীপ মৌজা এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় নিজের নামে, স্ত্রী ও আত্মীয় স্বজনের নামে প্রায় ১০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। যার সবকিছুই অবৈধ উপায়ের মাধ্যমে গত সাড়ে চার বছরে তিনি অর্জন করেন।
ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর ও তার চাচার যৌথ মালিকানাধীন কোটবাজার স্টেশনে রয়েছে একটি গ্যাস পাম্প যার বাজারমূল্য ২ কোটি টাকা। সৌদি প্রবাসী একজন রংমিস্ত্রি ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ১২ লাখ টাকার সম্পদ থেকে এখন প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক বনে যাওয়ায় হতভম্ব খোদ এলাকাবাসী। অভিযোগে আরও বলা হয়, এসব স্থাবর সম্পদ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে নিজের নামে ও আত্মীয় স্বজনের নামে অঢেল অর্থ জমা আছে।
কক্সবাজারের সদর, রামু ও উখিয়া সাব রেজিস্ট্রার অফিসের পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়ও তার অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া যাবে বলে তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেন।