বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই টানাবর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা
পাহাড়ি ঢলে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে সিলেটের
সবকটি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গত চার দিন ধরে থেমে থেমে ভারী বর্ষণে
মৌলভীবাজারের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বেড়েছে তিস্তা নদীর পানিও। ব্যারাজ
রক্ষার্থে ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। হঠাৎ পানি
বৃদ্ধি পাওয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন লালমনিরহাটের তিস্তাপাড়ের কৃষকরা। ভারী বর্ষণে
রংপুরের কাউনিয়ায় তিস্তার চরে ফসলের খেত তলিয়ে গেছে। ভাঙন আতঙ্কে রয়েছেন নদীপাড়ের
বাসিন্দারা।
সিলেট : কয়েক দিনের টানাবর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে
সিলেটের সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও শনিবার বিকেল পর্যন্ত নদ-নদীর
পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। তবে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বিপৎসীমা ছাড়িয়ে যেতে
পারে। গত বছরের এই সময়ে সিলটে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছিল। অবশ্য এবার বন্যা
পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সিলেটে আরো কয়েক দিন ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা
রয়েছে। গত দুই দিন সিলেটে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। শনিবার সকাল ৬টা
থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। এর আগে গত ২৪
ঘণ্টায় ১১৫ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
শনিবার সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে পানি বেড়েছে বলে জানিয়েছে
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড। নির্বাহী প্রকৌশলী আশিফ আহমেদ জানান, নদীর পানি বিপৎসীমার
কাছাকাছি অবস্থান করছে। সামান্য বাড়লে তা অতিক্রম করবে। একইসঙ্গে হাওর ও
নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করছে। শনিবার বিকেল পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১২
দশমিক ৩৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ
পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৩ দশমিক ৬৩ সেন্টিমিটার ও শেওলা পয়েন্টে ১০ দশমিক ৭৫
সেন্টিমিটার দিয়ে নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
এদিকে, আরো ১৫ দিন সিলেটে বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা
রয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। তাছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বর্ষণের আভাস দেওয়া
হয়েছে। সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, শনিবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে
আবহাওয়া অফিস। এর আগে গত ২৪ ঘণ্টায় ১১৫ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা
হয়েছে। আরো ১৫ দিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে।
এদিকে বন্যার পদধ্বনিতে গত বৃহস্পতিবার জরুরি সভা করেছে
জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি। সভায় সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির সম্ভাবনায় আগাম
প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান।
মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারে গত চার দিন ধরে থেমে থেমে ভারী বর্ষণে
নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। হাকালুকি, কাউয়াদিঘী, হাইল
হাওরসহ নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। হাকালুকি হাওরের অভ্যন্তরে অবস্থিত কুলাউড়া
উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির জানান, হাকালুকি হাওরের অভ্যন্তরে প্রবাহিত সোনাই ফানাই ও কন্টিনালা নদীতে গোলা
এসেছে। এখন নদী উপচে পানি হাওরে প্রবেশ করছে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজিক্যাল বিভাগের
উপবিভাগীয় প্রকৌশলী বাবু সত্যেন্দ্র চন্দ্র বৈদ্য প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, শুক্রবার রাতেও বৃষ্টি
হয়েছে। শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে
সিলেটের লালা খালে। সেখানে ১৭১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এছাড়া
শ্রীমঙ্গলে ১০২ মিলিমিটার, কমলগঞ্জে ৬২ মিলিমিটার, সুনামগঞ্জের ছাতকে ৮৫ মিলিমিটার এবং শহর পয়েন্টে ৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত
রেকর্ড করা হয়।
লালমনিরহাট : পানি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি
(সব) জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন
লালমনিরহাটের তিস্তাপাড়ের কৃষকরা। শনিবার (১৭ জুন) বিকেল ৩টায় দেশের বৃহত্তম সেচ
প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১
দশমিক ৯১ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার) যা বিপৎসীমার দশমিক ৬৯
সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে দুপুর ১২টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা
হয় ৫১ দশমিক ৯৩ সেন্টিমিটার, সকাল ৬টায় ৫২ দশমিক ৬
সেন্টিমিটার ও সকাল ৯টায় এই পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ও ৫২ দশমিক ২
সেন্টিমিটার।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার রাত থেকে তিস্তার
পানি বাড়তে শুরু করেছে। সকাল থেকে পানি প্রবাহ কিছুটা কমতে শুরু করে। এভাবে কমতে
থাকলে বিকেলের দিকে পানি কমে যেতে পারে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ্দৌলা
বলেন, কয়েক
দিনের অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তায় পানি
বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। এ কারণে ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে পানি নিয়ন্ত্রণ করার
চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্ষাকালে নদীর পানি বাড়া-কমার মধ্যে থাকবে। পানি বাড়লে
তিস্তাপাড়ের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। তাই বন্যা মোকাবিলায় পানি উন্নয়ন বোর্ড
সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।
তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরের অনেক বসতবাড়িতে পানি
উঠেছে। ফসলের খেত পানিতে ডুবে ফসলহানির শঙ্কা করছেন কৃষকরা। হঠাৎ পানি বাড়ার কারণে
গবাদি পশুপাখি নিয়েও বিপাকে পড়েছেন তারা। তিস্তা চরাঞ্চলের কৃষকরা জানান, মাস খানেক আগে হঠাৎ করেই
শুকিয়ে যাওয়া তিস্তা আবারও ফুলে ফেঁপে ওঠেছে। ওই সময় তিস্তার বুক জুড়ে থাকা ফসলি
জমি ডুবে যাওয়ার কারণে মরিচ, পেঁয়াজ, তামাক,
ভুট্টা, বাদাম, বীজতলা,
ধানসহ বিভিন্ন ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। সে ধকল কাটতে না কাটতে
আবারও বাড়তে শুরু করেছে পানি। এ কারণে তিস্তা চরাঞ্চলের সাধারণ কৃষকরা চিন্তিত।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী
মিজানুর রহমান বলেন,
উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানিপ্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। ব্যারাজ
রক্ষার্থে সব কটি (৪৪টি) জলকপাট খুলে দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
প্রতি বছর জুন মাসে বন্যা দেখা দেয়। তাই তিস্তাপাড়ের মানুষকে সতর্ক থাকতে বলা
হয়েছে বলেও তিনি জানান।
কাউনিয়া (রংপুর) : কাউনিয়ায় উজানের পাহাড়ি ঢলে হঠাৎ তিস্তা নদীর
পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে তিস্তার চরে চাষাবাদ করা উঠতি ফসলের খেত তলিয়ে গেছে।
তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মৌসুমি জেলেরা মাছ ধরার উৎসবে মেতে উঠেছেন। তবে
তিস্তার তীরবর্তী মানুষ ভাঙন আতঙ্কে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
শনিবার দুপুরে কাউনিয়ার তিস্তা রেলসেতু পয়েন্ট গিয়ে দেখা
গেছে, তিস্তার
পানি বিপৎসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ছুঁই ছুঁই করছে। তিস্তা রেল সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমা
নির্ধারিত রয়েছে ৯৬ সেন্টিমিটার। বর্ষা মৌসুমের প্রথমেই তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায়
বাদাম, মরিচ, ভুট্টা, পাটসহ আমন বীজতলা তলিয়ে গেছে। দুই দিন ধরে বৃষ্টি ও উজানের ঢলে হঠাৎ
তিস্তা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এক সপ্তাহ আগেও তিস্তা নদীর বালুচরে কৃষক ও পথচারীরা
হেঁটে চলাচল করতে দেখা গেছে। শনিবার সেই তিস্তার পানির স্রোতের গর্জনে তীরবর্তী
মানুষরা চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তিস্তার পানি যে হারে বাড়ছে তাতে করে ঢুষমারার চর,
হয়বত খাঁর চর, আজম খাঁর চর, গণাই চর, জিগাবাড়ীর চরসহ তিস্তার সাত চরের
নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়তে পারে।
উপজেলা ত্রাণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আহসান হাবীব
জানান, সংশ্লিষ্ট
এলাকার ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের কাছে খোঁজ নিয়ে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে ফসলের তেমন
ক্ষতি হয়নি। তবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।