অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরীর ফেসবুক থেকে নেয়াঃ
বিশ্বাস কি খুব ঠুনকো আর ভঙ্গুর একটা জিনিস | এটা কি ছায়ার মতো নাকি কাচের আয়নার মতো ! ছায়া আলোয় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠে, অন্ধকারে মিলিয়ে যায় | বিশ্বাস ঠিক তেমনই | সত্যের উপর ভর করে বিশ্বাস যখন জ্বলে উঠে তখন মিথ্যার ছায়ার মৃত্যু ঘটে | অন্ধকার আলোর সাথে লড়াইয়ে পেরে উঠেনা | দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটে | সব কিছু উলোট পালট হয়ে যায়, যখন বিশ্বাসের ভিতরে মিথ্যে প্রবেশ করে | তখন সত্যের ছায়ার মৃত্যু ঘটে | আলো পরাভূত হয় অন্ধকারের কাছে | বিশ্বাস কখনো কাচের আয়নায় নিজেকে দেখতে পায় | আয়নার বাইরের মানুষটার ভিতরে যদি মনুষ্যত্ব থাকে তখন আয়নার ভিতরের মানুষটার ভিতরে বিশ্বাস জন্ম নেয় | আয়নাটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে মানুষের মুখটাও টুকরো টুকরো হয়ে যায়, বিশ্বাস তখন টুকরো টুকরো হয়ে যায় | এমন টুকরো টুকরো কাচের ভিতর মানুষ তার মনুষ্যত্বকে হারিয়ে ফেলে | বিশ্বাস তার অস্তিত্ব হারায় |
বিশ্বাস একটা চাদরের মতো | যখন কাউকে শীতের তীব্রতা গ্রাস করে তখন চাদরটা তার শরীরে উষ্ণতা তৈরী করে | হয়তো চাদরটার উষ্ণতা তৈরী করার শক্তি নেই, কিন্তু চাদরটা যখন বিশ্বাস হয়ে যায় তখন উষ্ণতার জন্ম হয় | যার চাদর কেনার সামর্থ্য নেই, তখন শীতটা তার জন্য চাদর হয়ে যায় | মানুষটার উদোম শরীর আর শীত এক হয়ে যায় | অথচ কেউ কেউ আবার দামি দামি মখমলের একটার পর একটা মোটা চাদর শরীরের উপর জড়িয়েও শীতকে জয় করতে পারেনা |
অন্যকে বিশ্বাস করা যতটা সহজ নিজেকে বিশ্বাস করা ততটা কঠিন | এটা অনেকটা আত্মসমীক্ষণের মতো | যেখানে মানুষ নিজেকে একটা চিত্রকর্মে পরিণত করে | তারপর রংতুলি দিয়ে একটার পর একটা জলরঙে নিজেকে ডুবিয়ে দেখার চেষ্টা করে | বিশ্বাসে যখন মরিচা পড়ে তখন রংগুলো বদলে যায় | বিশ্বাস পরিবর্তিত হয় | বিশ্বাস তখন আত্মঘাতী হয় | যদি জল রঙে ডুবিয়েও রঙের পরিবর্তন না ঘটে তবে বিশ্বাস পরীক্ষায় উতরে যায় |
সব হারিয়ে গেলেও ফিরে পাবার সম্ভাবনা থাকে, বিশ্বাস হারিয়ে গেলে ফিরে পাওয়া যায়না | বিশ্বাস ভেঙে গেলে জোড়া লাগানো যায়না | বিশ্বাস অনেকটা নদীর পানির মতো | যে পানি একবার স্রোতে হারিয়ে যায় তাকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়না |
বিশ্বাস একটা চিঠির মতো | তবে বিশ্বাসের চিঠিতে কোনো কালো অক্ষরের লেখা থাকেনা, একটা অদৃশ্য অনুভূতি থাকে, বিন্দু বিন্দু না বলা কথা থাকে | কষ্ট থাকে, যন্ত্রনা থাকে, আনন্দ থাকে, হাসি থাকে | হয়তো মিথ্যেকে সত্য করে বলার মতো অনেক কিছুই থাকে | অথচ বিশ্বাসের চিঠি কখনো খামবন্দি হতে চায়না, বরং খামকে বন্দি করতে চায় | খামও বন্দি হতে চায়না বরং চিঠিকে তার ভিতরে ঢুকিয়ে বন্দি করতে চায় | এখন যুগ পাল্টেছে | মানুষের উপর চিঠি আর খামের অনেক বিশ্বাস ছিল তা আজ হারিয়ে গেছে | কারণ স্বার্থপর মানুষ নতুন কোনো বিকল্প পেলে পুরাতনের বিশ্বাসকে হত্যা করে | রঙিন মানুষ, রঙিন দুনিয়ার প্রেমে পড়ে সাদা কালো দুনিয়ার বিশ্বাসকে হারায় |
বিশ্বাস একটা সার্কাসের জোকারে মতো | যে নিজে হাসতে না পারলেও মানুষকে হাসানোর বিশ্বাসকে তার কান্নার মধ্যে দিনের পর দিন জমাতে থাকে | সেটা বুকের ভিতরে এমন একটা জায়গায় জমতে থাকে সেটা জোকারটা ছাড়া আর কেউ কখনো দেখতে পায়না | মানুষ ভাবে টাকা দিয়ে জোকারের হাসি কিনেছে | আর জোকারটা জানে মুখে রং মেখে প্রতিদিন তার কান্না মানুষের কাছে বিক্রি করছে সে | বিশ্বাস সেটা যেটা আমরা বিশ্বাস করিনা, বিশ্বাস সেটা নয় যেটা আমরা বিশ্বাস করি | খুব অদ্ভুত একটা মনস্তত্ব | যা বইয়ের পাতায় থাকেনা | অথচ বইয়ের পাতায় মানুষ সারাজীবন বিশ্বাসকে খুঁজে বেড়ায় |
চোখে চশমা পড়ে বিশ্বাসকে খুঁজতে গেলে চশমাটাই একটা বিজ্ঞানের উপাদান হয়ে যায় | চোখও তখন বিজ্ঞানের উপাদান হয়ে যায় | মানুষটাও বিজ্ঞানের উপাদান হয়ে যায় | অথচ বিশ্বাসটা তখনও বিধ্বস্ত করা ঘূর্ণিঝড়ের মতো | কোথায় আঘাত হানবে তা কেউ আগে থেকে বলতে পারেনা |
একটা মানুষ বাজারে গিয়ে বিশ্বাসকে কিনবে বলে খুঁজে বেড়াচ্ছে অথচ ওই মানুষটার নিজের বিশ্বাস অন্যের কাছে কখন বিক্রি হয়ে গেছে তা সে নিজেই জানেনা | বিশ্বাস কখনো বিক্রি হতে ভালোবাসেনা অথচ মানুষ বিশ্বাসকে পণ্য বানিয়ে বিক্রি করতে চায় | যখন বিশ্বাস বিক্রি হয় তখন মানুষও বিক্রি হয় | বিশ্বাসের ভিতর মানুষ থাকে, মানুষের ভিতর বিশ্বাস থাকেনা |
একটা কাঠের লাটিম বিক্রি করে যে মানুষটা সংসার চালায় তার জীবনটা অনেকটা লাটিমের মতো | লাটিম যতটা না ঘুরে লাটিম বিক্রি করা মানুষটাকে জীবনের সাথে লড়ার জন্য তার চেয়ে বেশি ঘুরতে হয় | লাটিমটা যে মানুষটা কিনে সে মানুষটাও লাটিমের মতো ঘুরে | সবাই ঘুরে, বিশ্বাসও ঘুরে | কিন্তু আবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু একেকজনের একেক রকম হয় |
মানুষ মরে যায়, বিশ্বাস তারপরও বেঁচে থাকে | মানুষের বয়স যত বাড়ে বিশ্বাসের বয়স তত কমে | বিশ্বাসের বয়স এভাবে ক্রমাগত কমতে কমতে কখনো ফুরিয়ে যায়না |