মুন্সী মো: আল ইমরান: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের এই শিক্ষার্থী নিজের স্কুটি চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা শিক্ষা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবীর দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছিলেন।
যে কাভার্ড ভ্যানটি মীমের স্কুটিকে ধাক্কা দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে তার চালককে গতকাল রাতেই চট্টগ্রাম থেকে আটক করা হয়েছে। তার নাম সাইদুল বলে জানা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ দেখে কাভার্ড ভ্যানটি শনাক্ত করা হয়। পরে রাত ১০টার দিকে এর চালক চট্টগ্রামে ধরা পড়ে। আটকের পর তাকে নিয়ে পুলিশের একটি দল ঢাকায় রওনা হয় বলেও জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা। তাৎক্ষণিকভাবে আটক চালক সাইদুলের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি।
খিলক্ষেত থানার এসআই মিজানুর রহমান জানান, নিহত মীম স্কুটি চালিয়ে উত্তরার বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রওনা হয়েছিলেন। কুড়িল ফ্লাইওভারে ওঠার পর মাঝামাঝি জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটে।
রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লাইওভারেই পড়ে ছিল মিমের দেহ। পাশেই পড়ে ছিল তার স্কুটি। এক পথচারী জাতীয় জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯-এ কল করে পুলিশকে বিষয়টি জানান। পথচারীরাই মিমকে উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মীমের মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে তার মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়। এরপর দুপুরে মরদেহ গাজীপুরের মৌচাকের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
খিলক্ষেত থানার ওসি মুন্সি সাব্বির আহমেদ জানান, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে দুর্ঘটনা ঘটে। পাশে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে মীমের স্কুটিকে ধাক্কা দেওয়া একটি কার্ভাড ভ্যান শনাক্ত করেছেন তারা।
ওসি বলেন, ‘খুব দ্রুত ওই কাভার্ড ভ্যান জব্দ ও এর মালিককে শনাক্ত করে আমরা প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারব বলে আশা করছি। এই ঘটনায় সড়ক পরিবহন আইনে মামলা হবে।
নিহত মীমের স্বজনরা জানান, দুর্ঘটনায় মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়েই অসুস্থ হয়ে পড়েন তার বাবা নূর মোহাম্মদ মামুন। তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। পরে মীমের লাশ গ্রামের বাড়ি নেওয়ার সময় তার বাবা মৃত মেয়ের মুখ দেখে আবারও অসুস্থ পড়েন। সকালে ঘটনা ঘটলেও বিকেল ৬টা পর্যন্ত মেয়ের মৃত্যুর বিষয় জানতেন না মা আসমা বেগম।
মীমের মৃত্যুতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গতকাল ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগের সিনিয়র লেকচারার শর্মি হোসেন ফেইসবুকে লিখেন, ‘সকাল ৯.৩০টা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ইমার্জেন্সির ডাক্তারের ফোন পেলাম। ইংরেজি বিভাগের আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের ছাত্রী মায়শা মমতাজ মীম কুড়িলের সামনে বাইক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছে। ডাক্তার জানালেন হাসপাতালে তার লাশ নিয়ে গিয়েছেন একজন গরিব রাজমিস্ত্রি। আহা, কত গাড়ি, বাইক, বাস হয়তো পাশ দিয়েই চলে গেছে। কারও সময় হয়নি থামার। হাসপাতালে আনার পর তার ব্যাগে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড পাওয়া গেছে। আমার নম্বর ডাক্তার পেয়েছেন আমার আরেক ছাত্রীর কাছ থেকে। জিজ্ঞাসা করলেন মেয়েটার বাবা-মা’র সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব কি না। আমি সাথে সাথে প্রক্টর অফিসকে জানালাম। উনারাও খবর পেয়েছেন!
শর্মি হোসেন আরও লিখেন, ‘আজ আমাদের বিভাগে একটা ইভেন্টে আসার জন্য মেয়েটা রওনা হয়েছিল। দুই বছর অনলাইনে ক্লাস করা বাচ্চা মেয়েটা হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের এইসব এক্সট্রা কারিকুলাম অনুষ্ঠানে খুব আনন্দ নিয়ে যুক্ত হয়েছিল, কিছু কাজ শিখবে, প্রিয় বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দিবে, রাতে কিছু ছবি পোষ্ট করবে। এইই তো। শেষ হয়ে গেল সব।
মর্গে যাওয়া মীমের মামাতো ভাই আইনজীবী জাকির হোসেন বলেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে তারা শুনেছেন, একটি কাভার্ড ভ্যান মীমের স্কুটিকে চাপা দিয়ে চলে যায়। পুলিশকে তারা বিষয়টি জানিয়েছেন।
গাজীপুরের মৌচাক আইডিয়াল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নূর মোহাম্মদ মামুনের দুই মেয়ের মধ্যে মীম বড়। স্বজনরা জানান, রাজধানীর উত্তরা ৬নং সেক্টরের ১০ রোডের ৯ নম্বর বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন মীম। তার ছোট বোন রৌদোসী মমতাজ মৌ উত্তরা রাজউক কলেজের এইচএসসির শিক্ষার্থী। সন্তানদের লেখাপড়ার কারণে তাদের বাবা-মা সন্তানদের নিয়ে উত্তরায় বসবাস করেন। তাদের মা আসমা বেগম গৃহিণী।
গতকাল ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে উত্তরার বাসা থেকে ক্যাম্পাসে যাচ্ছিলেন মীম। গতকালই তার ছোট বোনের ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসেই ছোট বোন জানতে পারে বড় বোন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। মাকে জানানো হয়েছে আরও অনেক পরে। মেয়েকে হারিয়ে বাবা-মা দুজনেই শয্যাশায়ী। স্বজনরা জানান, ময়নাতদন্ত শেষে মীমের মরদেহ গাজীপুরের মৌচাক বাজারসংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থানে রাত সাড়ে ৮টার দিকে দাফন করা হয়। মীমের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায়, তবে মৌচাকেও তাদের বাড়ি আছে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শর্মী হোসাইন জানান, মীম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল ২০২০ সালে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এখন ভাষা প্রতিযোগিতা চলছে ক্যাম্পাসে। মীম সেখানে স্বেচ্ছাসেবীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। গতকাল চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই ক্যাম্পাসে যাচ্ছিলেন।
মীমের মামা অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেসুর রহমান বাদল বলেন, ‘পাঁচ মাস হলো ও স্কুটি চালাতে শুরু করেছিল। মাথায় হেলমেট পরত। দুর্ঘটনার সময়ও মাথায় হেলমেট ছিল। তবে মূল আঘাতটা মাথাতেই লেগেছে।’
মীমের আরেক মামা অ্যাডভোকেট এ কে এম হাবীবুর রহমান চুন্নু বলেন, ‘আমার ভাগনি এমন অসময়ে চলে যাবে ভাবতে পারিনি। গত বুধবারও ওর সঙ্গে কথা হয়েছে। মেয়েটা খুব মিশুক ছিল।’
তিনি আরও বলেন, মীমের বাবা তার ছোট বোন মৌকে নিয়ে মিরপুর এসেছিল। মৌয়ের মেডিকেলের একটি পরীক্ষার সিট পড়েছিল বাংলা কলেজে। আমাদের বাসা মিরপুর। পরীক্ষা শেষে বলেছিল বাসায় আসবে। পরে মীমের ঘটনার পর সব ওলটপালট হয়ে গেছে।’
স্বজন-সহপাঠীদের আহাজারিতে চিরবিদায়: নিহত মাইশা মমতাজ মীম তার বাবা নুর মোহাম্মদ মামুন প্রতিষ্ঠিত মৌচাক আইডিয়াল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার মৃত্যুর খবর এলাকায় পৌঁছালে শোকের ছায়া নেমে আসে। শিক্ষক, সহপাঠী, আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী ছুটে আসেন তাদের বাড়িতে। বিকেলে মীমের মরদেহ মৌচাকের বাড়িতে আসার পর স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাকে একনজর দেখার জন্য মৌচাক আইডিয়াল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকার শত শত মানুষ ছুটে আসেন।
মীমের স্কুলের শিক্ষক আবুল কালাম বলেন, ‘মীম অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল। মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য সব রকম ত্যাগ স্বীকার করতেন তাদের বাবা-মা