ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়।
তিন দিন পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী
সরকার গঠিত হয়। আজ মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস পূর্ণ হলো।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েই কঠিন ভয়াবহ বন্যা
মোকাবিলাসহ নানা চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়েছে সরকারকে। পাশাপাশি জুডিসিয়াল ক্যু,
প্রশাসনিক ষড়যন্ত্র, সংখ্যালঘু ইস্যু, আনসার বিদ্রোহ, পাহাড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির
অপচেষ্টা করা হয় এই সময়ে। ধৈর্যের সঙ্গে এসব পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে
সরকার।
গত মাসে জাতিসংঘে ড. ইউনূসের উপস্থিতি বিশ্বে বাংলাদেশকে
অনন্য মর্যাদার আসনে নিয়ে যায়। বিশ্বনেতারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের
সঙ্গে বৈঠক করেন। বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সহযোগিতারও প্রতিশ্রুতি দেন তারা। বাংলাদেশ
প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তার প্রতিশ্রুতি পায়।
বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী মহলের হাত ধরে ব্যাংক ও আর্থিক
প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে লাখো কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ায় ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা
করে ড. ইউনূসের সরকার। তবে প্রবাসী আয়ের পালে হাওয়া লাগায় অর্থনৈতিক দুরাবস্থা কাটিয়ে
ওঠার চেষ্টায় রয়েছে সরকার। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি
সরকার।
শিক্ষাঙ্গনেও অস্থিরতা পুরোপুরি কাটেনি। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর
ক্লাস পরীক্ষা চালু হলেও এখনো অনেক প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা রয়ে গেছে। শিক্ষা সম্পর্কিত
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বসে আছেন পতিত সরকারের অনুগতরা।
অন্যদিকে, যত্রতত্র বিভিন্ন দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার
মানুষ, যার কারণে অস্থিরতা রয়েছে রাষ্ট্রে। এসব বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগও নেই সরকারের।
অনেকে সরকারকে অস্থিরতায় ফেলতে এমন করছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতি বিনষ্ট করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায় একটি গোষ্ঠী। অস্থিরতা রয়েছে পোশাকখাতেও।
এখনও পোশাকখাতে শৃঙ্খলা ফেরানো যায়নি। বিক্ষোভে বন্ধ রয়েছে অসংখ্য পোশাক কারখানা।
ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্কেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
এতদিন ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে একতরফা পেয়ে আসছিল, এখন দেওয়ার বিষয়টিও মাথায়
রাখতে হচ্ছে ভারতকে। সম্প্রতি ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল থেকে বিদ্যুৎ
আমদানি করতে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়। ভারতে
অনীহার কারণে বহু বছর ধরে ঝুলে ছিল বিষয়টি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় করতে
নানামুখী পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে ইতোমধ্যে।
অন্যদিকে, বন্যায় মাঠঘাট ডুবে যাওয়ায় উৎপাদন কমে যাওয়ায়
উচ্চ দ্রব্যমূল্যে ভুগছে সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া অস্থিরতা রয়েছে জনপ্রশাসন, পুলিশ,
ব্যাংক ও শিক্ষাখাতে। পুরোপুরি পুনর্গঠন করা যায়নি বিচার বিভাগ। এ ছাড়া সরকারি
কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, কল-কারখানা অচলায়তন, বন্যাসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ
মোকাবিলা করতে হচ্ছে সরকারকে। এসব মোকাবিলা করে ড. ইউনূস সরকারকে পুরোপুরি সফল হতে
সময় লাগছে।
অভিযোগ রয়েছে, পুরোনো সরকারের আমলারা সরকারকে ঠিকমতো
সহযোগিতা করছেন না। এ ছাড়া পদোন্নতি ও দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রতিনিয়ত সরকারকে বেকায়দায়
ফেলছে সরকারি চাকরিজীবীরা। অন্যদিকে প্রশাসনের লোকদের দুর্নীতির অভিযোগও সামনে
আসছে। যা সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে। বেহাল আর্থিক খাতও। বিশেষ করে খেলাপি ঋণের ভারে
জর্জরিত ব্যাংকিং খাত। এ ছাড়াও তারল্য সংকট, সুশাসনের অভাবসহ একাধিক সমস্যায় ভুগছে
অনেকগুলো ব্যাংক।
প্রধান উপদেষ্টাসহ এ সরকারের সদস্যসংখ্যা ২১। উপদেষ্টামণ্ডলীতে রয়েছেন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ। এ ছাড়া
প্রধান উপদেষ্টার দুজন বিশেষ সহকারী, একজন আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত আছেন।
মানবাধিকার, অর্থনীতি, প্রশাসন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলাসহ নানা ক্ষেত্রে বেশ কিছু
সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ক্ষমতা গ্রহণের পর গত দুই মাসে প্রশাসনের শীর্ষপদে ব্যাপক রদবদল করেছে সরকার, যা
এখনও চলমান আছে। আর্থিকখাতসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে সংস্কার উদ্যোগ।
স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে তাদের জায়গায় বসানো হয়েছে প্রশাসক।
এদিকে কর্মবিরতি ও হামলার ভয় কাটিয়ে আবারও মাঠে ফিরেছে পুলিশ।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে নানা পদে বসানো
হয়েছে নতুন কর্মকর্তাদের। দুর্নীতিবাজ অনেক কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছে। অনেককে
বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে, অনেককে করা হয়েছে ওএসডি। পরিবর্তন করা হয়েছে
বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতও।
পুঁজিবাজারের অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত
কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালী করতে গঠন করা হয় একটি
বিশেষজ্ঞ কমিটি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কালাকানুন বাতিল
করার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু
করেছে সরকার। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সইও করা হয়েছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে ড.
মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার বিরল সুযোগ পেয়েছেন। নানা কারণে
প্রধান উপদেষ্টার এ সফরকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে
গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি সংকট ছিল, এ সফরে
সেটি কাটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিও তুলে
ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
চার দিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী
জাস্টিন ট্রুডোসহ ১২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান।এছাড়াও বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইএমএফ, ইউএসএইড,
এডিবিসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দেয়ার
অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।
এদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই
মাসে (জুলাই-আগস্ট) সরকারের রাজস্ব আদায় আগের অর্থবছরের তুলনায় ১১ শতাংশ কম হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১৬
দশমিক ২৭ শতাংশ। রেমিট্যান্সের প্রবাহও বেড়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা শুরু হয়েছে দুর্গম পথের মধ্য
দিয়ে। দুই মাসে সরকার এই পথ কতটা পাড়ি দিতে পেরেছে, তার মূল্যায়ণ স্বাভাবিকভাবেই
জনগণ করবে।