রোকসানা মনোয়ার : গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল। এই দুইয়ে মিলে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে দেখা দিয়েছে বন্যার আশঙ্কা। ইতোমধ্যে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় চরাঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ১২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়া লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলার তিস্তার চরাঞ্চল ও তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের অন্তত পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। লাগাতার বৃষ্টির কারণে মৌলভীবাজারের নদ-নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। লাগাতার বর্ষণের কারণে বন্যার পাশাপাশি পাহাড়-টিলা ধসের আশঙ্কা করছে স্থানীয় প্রশাসন। পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টির কারণে সিলেটের নদ-নদীতেও পানি বাড়ছে।
সিলেট : সিলেটের উজানে ভারতের আসামেও ভারী বৃষ্টির কারণে
সেখানে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। আসাম থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টির
কারণে সিলেটের নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে সোমবার (১৯ জুন)
বিকেল ৩টায় সুরমার পানি বিপৎসীমার ১৩ দশমিক ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত
হচ্ছিল। এই পয়েন্টে বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। গত ২১ ঘণ্টায় কানাইঘাট
পয়েন্টে পানি বেড়েছে ৩৭ সেন্টিমিটার। এছাড়া সিলেট সদর পয়েন্টে সুরমার পানি বিপৎসীমা
ছুঁই ছুঁই করছে। পানি বেড়েছে সিলেটের কুশিয়ারা, ধলাই, লোভা ও সারী
নদীতে। সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসাইন বলেন, সোমবার ভোর থেকে শুরু করে বেলা ১১টা পর্যন্ত সিলেটের বিভিন্ন এলাকায়
বৃষ্টি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১১২ আর সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৫১ মিলিমিটার
বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে।
সুনামগঞ্জ : সময়টা যেন একদম ভালো যাচ্ছে না সুনামগঞ্জবাসীর।
অঝরে ঝরে চলেছে বৃষ্টি। থামার যেন কোনো লক্ষণ নেই। আরও দুই-তিন দিন এভাবে বৃষ্টি
হতে থাকলে বন্যার কবলে পড়বে সুনামগঞ্জের ২০ লাখেরও বেশি মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের
তথ্যমতে,
গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এতে সুরমা, যাদুকাটা, রক্তি নদীর পানি
বাড়লেও বিপৎসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দা পেয়ারা বেগম বলেন, গত বছর বন্যার পানিতে সবকিছু
ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সেজন্য এ বছর পানি পুরোপুরি আসার আগে ঘরের আসবাবপত্র নৌকায় করে
নিয়ে উঁচু স্থানে নিয়ে যাচ্ছি।
তবে স্বস্তির বাণী শোনাতে পারেননি পানি উন্নয়ন বোর্ডের
কর্মকর্তারা। তারা বলছেন,
আগামী ৪৮ ঘণ্টা সুনামগঞ্জে অতিভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। এতে
সুনামগঞ্জের সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। গত ৪-৫
দিনে সাত উপজেলায় থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগের
উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সত্যেন্দ্র চন্দ্র বৈদ্য প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, এখন বেশি বৃষ্টি হচ্ছে
ভারতের চেরাপুঞ্জি সংলগ্ন এলাকায়। সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায়
জাফলংয়ে ১৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে লাগাতার বৃষ্টিপাতের কারণে মৌলভীবাজারের নদ-নদীর পানি
বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। সোমবার দুপুর ১২টায় হাকালুকি হাওরের উজান থেকে প্রবাহিত জুড়ী
নদীর পানি বিপৎসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। লাগাতার বর্ষণের
কারণে বন্যার পাশাপাশি পাহাড়-টিলা ধসের আশঙ্কা করছে স্থানীয় প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, মনু, ধলাইসহ
নদ-নদীর পানি এখানো বিপৎসীমার নিচে অবস্থান করছে। তারপরও আমরা সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায়
বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। রবিবার (১৮ জুন) অনুষ্ঠিত জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায়
সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নিজ নিজ উপজেলায় কন্ট্রোল রুম খুলে পরিস্থিতি
পর্যবেক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পাহাড় টিলায় বসবাসরত নাগরিকদের নিরাপদ
আশ্রয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজীব মাহমুদ
মিঠুন বলেন,
জেলা উন্নয়ন কমিটির সভা থেকে ফিরে এসে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের
চেয়ারম্যান দের পাহাড়-টিলা ধসের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি
কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির মিটিং ডাকা হয়েছে।
রংপুর : পূর্বঘোষণা ছাড়াই ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট
খুলে দেওয়ায় হু-হু করে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা
পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। রবিবার দুপুরের পর পানি বৃদ্ধি
পাওয়ায় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তাবেষ্টিত ২৫টি চরাঞ্চলের গ্রামগুলো তিন থেকে
চার ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ১২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
সোমবার (১৯ জুন) বিকেল ৩টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প
তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫১ দশমিক
৯০ সেন্টিমিটার,
যা বিপৎসীমার দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫
সেন্টিমিটার) নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে সকাল ৬টায় ওই পয়েন্টে তিস্তার পানি
প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫২ দশমিক ২০ সেন্টিমিটার, সকাল ৯টায়
৫২ দশমিক ১০ সেন্টিমিটার ও দুপুর ১২টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫১ দশমিক ৯৮
সেন্টিমিটার।
কোলকোন্দ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুর রউফ বলেন, চিলাখাল, চর মটুকপুর, বিনবিনা এলাকার ১২০০ এবং লক্ষ্মীটারী
ইউনিয়নের শংকরদহ, চর ইচলী এলাকার ৭০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে
পড়েছে। তাদের বাড়িঘর দুই থেকে তিন ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে।
গজঘণ্টা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আলতাফ জানান, ছালাপাক, জয়দেবসহ নিম্ন এলাকার চার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়িঘরে পানি
ওঠায় বিনবিনা এলাকায় অনেক পরিবার গবাদিপশু, বাড়ির
আসবাবপত্রসহ রাস্তায় এবং উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।
লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের আবদুল্লা আল হাদী জানান, শংকরদহ, ইচলি, জয়রামওঝা ও বাগেরহাট এলাকায় দুই হাজার পরিবার
পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
লালমনিরহাট : তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে লালমনিরহাটের পাঁচ
উপজেলার অন্তত পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে রাস্তাঘাট।
তিস্তা ও ধরলার পানি বৃদ্ধিতে পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী,
দোয়ানী, ছয়আনী, সানিয়াজান
ইউনিয়নের নিজ শেখ সুন্দর, বাঘের চর, ফকিরপাড়া
ইউপির রমনীগঞ্জ, সিঙ্গামারি ইউনিয়নের ধুবনী, সিন্দুর্না ইউপির পাটিকাপাড়া, হলদিবাড়ী, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি,
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা, পলাশী ও সদর
উপজেলার ফলিমারীর চর খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুণ্ডা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করায় প্রায়
পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ বলেন, কিছুটা পানি বৃদ্ধি পেয়েছে,
তা আবারও কমে গেছে। আমরা সব সময় খোঁজখবর রাখছি। পরিস্থিতি
মোকাবিলায় যাবতীয় প্রস্তুতি রয়েছে।
নীলফামারী : হঠাৎ তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নীলফামারীর
নিম্নাঞ্চল ও চরের অনেক বাড়িতে পানি উঠেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এছাড়া ফসলের
খেত পানিতে ডুবে গিয়ে ফসলহানির শঙ্কায় চিন্তিত কৃষকরা। হঠাৎ পানি বাড়ার ফলে গবাদি
পশুপাখির খাবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ্দৌলা
বলেন, উজান থেকে
নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তার পানি বেড়েছে।
ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে পানি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পানি এভাবে বাড়তে
থাকলে বন্যার শঙ্কা রয়েছে। তবে বন্যা মোকাবিলায় পানি উন্নয়ন বোর্ড সর্বদা প্রস্তুত
আছে।
কুড়িগ্রাম : কয়েকদিনের বৃষ্টি ও উজানের ঢলে দ্রুত বৃদ্ধি
পাচ্ছে কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা,
দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি। নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চলগুলোতে
এরইমধ্যে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। এখনো ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ না করলেও তলিয়ে গেছে
এসব এলাকার পটল, ঢেঁড়সসহ বিভিন্ন সবজি খেত। পানিবৃদ্ধি
অব্যাহত থাকায় বন্যার শঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন চরাঞ্চলের মানুষ।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী
আব্দুল্লাহ-আল-মামুন বলেন,
জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও
এখনো বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে আগামী ২২ ও ২৩ জুন এসব নদ-নদীর পানি
বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানতে পেরেছি। তবে আগামী ১০
দিনের মধ্যে বড় কোনো বন্যার সম্ভাবনা নেই বলেও জানান তিনি।