আশরাফ সিজেল, সাভার থেকে :
আদালতের নির্দেশনায় ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার নামা বাজার এলাকার বংশী নদী ও নদী তীরের স্থাপনায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। জনবল ও অর্থ ব্যয় করে এই অভিযান পরিচালনা করা হলেও, অভিযানের মাত্র চার মাসের মাথায় ফের দখল শুরু হয়েছে। শুধু দখল বললে ভুল হবে, এ যেন দখলের মহোৎসব চলছে। আর এই দখল প্রক্রিয়া টেকসই করতে অর্ধ কোটি টাকা চাঁদা বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠেছে।
জানতে চাইলে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘এখনো কোনটা নদীর জায়গা, কোনটা খাস এটা নির্ধারণ করা হয়নি। আমরা নদীর সীমানা নির্ধারণ করে দেব। উচ্ছেদের পর পুনরায় কেউ দখল করলে আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেব।’
বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বংশী নদীর তীরে উচ্ছেদ হওয়া শত শত দোকান ভিটা খালি পড়ে আছে। পাশে পড়ে আছে ভাঙা দেয়াল, টিন ও ইটের টুকরো, পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বর্জ্য। এর মধ্যে কিছু ভিটায় চলছে নতুন স্থাপনা নির্মানের কাজ। ট্রাকে করে আনা হচ্ছে নতুন ইট, বালু, রড। রাজমিস্ত্রিরা ইট বালু সিমন্টে দিয়ে দিন দুপুরে প্রকাশ্যে করছেন কাজ। দখলদার দোকান মালিকেরা পাশে দাঁড়িয়ে কাজের তদারকি করছেন।
নামা বাজারের চাল পট্টি এলাকায় উচ্ছেদ হওয়া ভ‚মিতে নতুন স্থাপনা তৈরি করতে দেখা গেছে দখলদার মুজিবুর রহমানকে। সেখানে তার হিসাম অয়েল মিল নামে একটি কারখানা ও একটি চালের আড়ৎ ছিল। মুজিবুর বলেন, ‘অন্যরা দোকান তুলছে, তাই আমিও তুলছি। আর প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে সমিতির মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। আরও ৩০ হাজার টাকা দিতে বলছে।
সেলামত আলীর টিনের একটি দোকান ছিল। উচ্ছেদ হওয়ার পর ওই জায়গায় এখন পাকা ঘর তুলছেন তিনি। সেলামত বলেন, নদীর জায়গা সরকার উচ্ছেদ করচে। এখন সরকার ঘর তুলবার কইচে তাই তুলতাচি।’
নামা বাজারের ডাল পট্টি এলাকায় নির্মাণ কাজ করছিলেন কয়েকজন শ্রমিক। সেখানে টিটু নামের একজন জানান, উচ্ছেদে তাদের দুটো দোকান ভাঙা পড়েছে। সম্প্রতি প্রশাসন তার দোকানের অংশ লাল কালি দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করায়, একটি দোকান নদীর মধ্যে পড়েছে। অন্যটি খাস জায়গায়। খাস জায়গার দোকানটি তিনি নতুন করে তৈরি করছেন।
জানা গেছে, হাই কোর্টের নির্দেশে বংশী নদীর তীরের সাভার নামা বাজার অংশে ২০২২ সালের অক্টোবরের ২৮ থেকে ৩১ তারিখ পর্যন্ত চারদিনব্যাপী উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এই অভিযানে ২৮৬ জন দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এতে চার একর নদীর জায়গা ও ৪০ শতাংশ খাসজমি দখল মুক্ত হয়েছে। উচ্ছেদ তালিকার বাইরে আরও শতাধিক দখলদার রয়েছে, যারা এখনো উচ্ছেদের আওতায় আসেনি। অথচ ২০১৫ সালে সাভার উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) কার্যালয় থেকে জানানো হয়ছিল, বংশী নদীর তীরের সাভার নামাবাজর অংশে দখলদার রয়েছে মাত্র ৬২ জন। তখন প্রভাবশালীদের চাপ ও আর্থিক সুবিধা নিয়ে দখলদারদরে তথ্য গোপন করা হয়েছে অভিযোগ উঠেছে।
উচ্ছেদ তালিকায় দখলদার হিসেবে একাধিক জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নাম রয়েছে। মূলত তাদের ক্ষমতার প্রভাবে নতুন করে দখল আড়ৎদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি’ গড়ে তুলেছেন। সমিতির কার্যালয় হিসাবে নদীর জায়গায় করা হয়েছে আরেকটি স্থাপনা। এই সমিতির মাধ্যমে দোকান মালিকদের কাছ থেকে তোলা হয়েছে ১০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। বলা হয়েছে প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে এই টাকা ব্যবহার করা হচ্ছে। সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিন দোকান প্রতি টাকা তোলার কথা স্বীকার করে, ‘উচ্ছদে হওয়া ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনরে জন্য সরকারের কাছে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করেছি। বিভিন্ন পর্যায় থেকে আশ^াস পেয়ে কিছু ভাঙা দোকান মেরামত করা হচ্ছে। এজন্য প্রশাসন কোন বাধা দিচ্ছে না। আর টাকা নিয়েছি, সমিতির সদস্যদের উন্নয়নের স্বার্থে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রির্সাচ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান ও নদী গবেষক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, প্রশাসন সাহসী উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছে। তবে এই উচ্ছেদ অভিযানের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিরা যুক্ত না থাকায় আবার দখল হওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কারণ দখলদারেরা জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয়-স্বজন, কাছের লোক। উচ্ছেদের পর সীমানা চিহিৃত করে দিতে হবে। আর অবৈধ নির্মানকাজ এখনি বন্ধ করতে হবে।’