রোকসানা মনোয়ার : প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট যে কোন ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ এখন সক্ষম। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলায় ইতোমধ্যে যথেষ্ট সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। ভূমিকম্প, অগ্নিকা- ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সুউচ্চ ল্যাডারসহ আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন (এ এফ ডি), কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, পুলিশ একযোগে কাজের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্বে এখন শুধু উন্নয়নের রোল মডেলই নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়ও রোল মডেল হিসেবে একটা সম্মান পেয়েছে। একই সঙ্গে বন্যা খরা ঘূর্ণিঝড় অগ্নিকা-ে ক্ষয়ক্ষতি যাতে হ্রাস পায় তার জন্যও পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে এবং জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশ্বের অনেক দেশই মনে করে বাংলাদেশের কাছ থেকে এ বিষয়ে শেখার রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, ঘনবসতি ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত কোন না কোন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়। তাছাড়া ২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ফণী ও বুলবুল এবং ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান মোকাবেলা করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এসব ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সরকারের পূর্বপ্রস্তুতি থাকায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে। এ বছর ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ মোকাবেলায়ও সরকারের ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল। দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে সারাবিশ্বে।
দুর্যোগ ঝুঁকি-হ্রাস ও দুর্যোগ মোকাবেলা বিষয়ক কার্যক্রমকে সমন্বিত, লক্ষ্যভিত্তিক ও শক্তিশালী করা এবং সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২, জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০১৫, জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ২০১৬-২০২০, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০১১, মরদেহ ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা-২০১৬, দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী (এসওডি) ২০১৯ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ দলিল প্রণীত হয়েছে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রতিবন্ধী, নারী, বয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুসহ দুর্গত জনগোষ্ঠীর চাহিদা নিরূপণ ও বাস্তবায়ন। ২০১৫-২০৩০ সাল মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রণীত হয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)।
দুর্যোগে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দুর্যোগ সহনীয় টেকসই নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় পরিকল্পিতভাবে কাঠামোগত এবং অকাঠামোগত কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর উপকূলীয় অধিবাসীদের জানমাল ও সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি লাঘব করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী (সিপিপি) প্রতিষ্ঠিত হয়।
সূত্র জানায়, বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ুর ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য দুর্যোগ ঝুঁকি-হ্রাস বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে সরকার ১০০ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ প্রণয়ন করেছে। ২১০০ সাল নাগাদ স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাসমূহের সমন্বয়ে যোগসূত্র সৃষ্টি করবে এই ডেল্টা প্ল্যান।
গ্রামীণ এলাকায় যে সকল পরিবারের ঘর নেই, ভূমিহীন, কিংবা জমি আছে ঘর নেই তাদের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণে সহায়তা করেছে। ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে ঝুঁকির সম্মুখীন মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র প্রতিবন্ধিতা জেন্ডার বান্ধব করে নির্মাণ করা হচ্ছে। বন্যাপ্রবণ ও নদীভাঙ্গন এলাকায় বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা থেকে মানুষের জানমাল রক্ষায় মাটির কিল্লা নির্মাণ করা হয়। যা সর্বসাধারণের কাছে ‘মুজিব কিল্লা’ নামে পরিচিত। তারই আধুনিকরূপে উপকূলীয় ও বন্যা উপদ্রুত ১৪৮টি উপজেলায় ৩৭৮টি নতুন বহুমুখী মুজিব কিল্লা নির্মাণ এবং বিদ্যমান ১৭২টি মুজিব কিল্লার সংস্কার কাজের মাধ্যমে সর্বমোট ৫৫০টি মুজিব কিল্লার র্নিমাণ, সংস্কার ও উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ৬৪ জেলায় ৬৬টি জেলা ত্রাণ গুদাম কাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্য স্থাপন কার্যক্রমের আওতায় লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ইতোমধ্যে ৬৪টি কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা মানুষের দুর্দশার বিষয়গুলো আমলে নিয়ে ২০১৫ সালে একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয় এবং জাতীয় রিজিলিয়েন্স পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এটি সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক ও এসডিজির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এছাড়াও তার সরকার ২০১৫ সালে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (এনইওসি) প্রতিষ্ঠা করেছে।
বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য পূর্বাচলে একটি স্টেজিং এরিয়া নির্মাণ করা হচ্ছে। মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে সিভিল মিলিটারি সমন্বয়ে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিজিওনাল কনসালটেটিভ গ্রুপের (আরসিজি) মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রও সম্প্রসারিত করা হয়েছে।
যে কোন দুর্যোগের সময় তারা সকলে সেখানে উপস্থিত হয় এবং কাজ করে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি এবং তখনকার ক্ষমতাসীন সরকারের উদাসীনতা ছিল বলে সূত্র জানায়। একটা সরকার যদি সচেতন না থাকে, সজাগ না থাকে তাহলে কত বড় ক্ষতি হতে পারে সেটা একানব্বই সালের ঘূর্ণিঝড়ে দেখা গেছে। সরকার ইতোমধ্যে উপকূলে ৩ হাজার ৮৬৮টি বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে এবং আরও ১ হাজার ৬৫০টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ কাজ চলছে। যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে পূর্বাভাস দেয়া, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সেই লোকগুলোকে সাইক্লোন শেল্টারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়। দুর্যোগকালীন করণীয় বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ ও সচেতন করা হয়। এর ফলে এখন ঘূর্ণিঝড়ে মৃতের সংখ্যা একেবারে নাই।